January 24, 2022

আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-২)

  • আজিমপুর টু উত্তরা
  • ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
  • আনোয়ার হাকিম।

(২)
ব্যাংক পর্ব শেষ করে সিটি কর্পোরেশনে গিয়ে যখন পৌছলাম তখন লাঞ্চ পিরিয়ড চলছে। অফিসের লাঞ্চ পিরিয়ড কখন শুরু হয় আর কতক্ষণ পর্যন্ত চলে তার টাইম টেবিল কাগজে আছে, প্র্যাক্টিসে নেই। যার কাছে কাজ তিনি চেয়ারে নেই। হঠাৎই চোখে পড়লো দূরে চেয়ারে বসে আছে ইলমার বড় বোন জেমি। পরনে হলুদ প্রিন্টেড কামিজ। ম্যাচ করা মাস্ক। সাথে সাদা ওড়না গলায় পেচানো। চুল হাল্কা সোনালী কালার করা। কানে দুল, সরু লতার মত । হাসি বিনিময় করে বললাম, “কতক্ষণ ধরে এখানে”?
— প্রায় ঘন্টাখানেক।
— কেন?
— নতুন ফ্ল্যাটের হোল্ডিং খুলবো।
— কি বলছে এখানকার লোকজন?
— যিনি করবেন তিনি নেই। কোথায় যেন গেছেন। এই এসে পড়বে বলছে সবাই। কিন্তু আসছেন না।
— এই হচ্ছে আমাদের অফিস কালচার।
— কি রকম?
— এই যে নামায আর লাঞ্চের নাম করে বারোটা থেকে তিনটা পর্যন্ত কাউকেই পাওয়া যায়না।
জেমি প্রসঙ্গ পাল্টালো, “ছাত্রীর পড়াশোনা কেমন চলছে”?
— সে তো আপনিই ভাল বলতে পারবেন।
— ইলমা তো তোমার গুণে মুগ্ধ
— আর আপনি? কথাচ্ছলে মুখ ফসকে বেরিয়ে যেতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। জেমি চোখটা ঈষৎ বড় করে কেমন করে যেন তাকালো। কি যেন ভাবলো। তার পর বললো, “তোমার কি মনে হয়”?
— জানিনা। স্যরি, বেয়ারা প্রশ্ন হয়ে গেল। রিয়েলি স্যরি।
এমন সময় অফিসের রেভেনিউ সেকশনের সেই ভদ্রলোক এলেন। এসেই চরম বিরক্ত। কোথাও কেউ কোন কাজ করেনা। কাউকে ডেস্কে পাওয়া যায়না ইত্যাদি খিস্তি আওড়াতে থাকলেন। আমি থ মেরে শুনছিলাম তার কথা আর ভাবছিলাম সেই প্রবচনের কথা, একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে? যাহোক, আমার কাজটা হলো। কিন্তু জেমির কাজ হলো না। কিছু পেপার শর্ট আছে। সেগুলো নিয়ে পরে আসতে হবে। জেমির মুখ কালো। আমার আলো। ভদ্রলোক নামাযের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন। বসে থাকা বৃথা। বললাম, “এখন কি করবেন”?
— বুঝতে পারছিনা
— দু’টো কাগজ লাগবে। তারপর অন্য কথা।
— সে তো শুনলামই। ঝামেলাই দেখছি।
— কেন? ঝামেলা কেন?
— এই যে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে
— কাউকে দিয়ে করিয়ে নেবেন
— সেরকম কেউ তো নেই এগুলো করার মত
— আমি করে দিতে পারি
— তুমি মিছেমিছি করতে যাবে কেন
— মিছেমিছি করবো বলিনি তো
— তো
— কন্ডিশন আছে। আমি বললাম।
— আমারো একটা কন্ডিশন আছে। জেমির পাল্টা উত্তর।
— কি?
— এখন থেকে তুমি করে বলবে। জেমি দুষ্টু হাসিতে, চোখের ফাঁসিতে আমাকে বাকরুদ্ধ করে দিলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “সে পরে দেখা যাবে”।
আমার অন্তরাত্মা ধক করে উঠলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রিয়দর্শিনী, প্রিয়ংবদা জেমি আমার উপর দশ মনি বস্তা চাপিয়ে দিয়ে সিঁড়ি ভাঙ্গতে লাগলো। আমি তার পিছু পিছু। নীচে তার গাড়ী প্রস্তুত। গাড়ীতে চেপে ইশারায় উঠতে বললো। ইতস্তত করতে দেখে বললো, “ভয় পাচ্ছো? বাসায় নামিয়ে দেবো তো”। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত চেপে বসলাম। ড্রাইভারকে কি যেন বললো বুঝতে পারলাম না। গাড়ী এসে থামলো ধানমন্ডির ‘পাইন উড’ রেস্তোরাঁয়। জেমির সাথে আজকের এই কাকতালীয় সাক্ষাৎ ও তার পরবর্তী অগ্রগতি অবিশ্বাস্যকর। খাবার খেতে খেতে বললো, “ভয় পাচ্ছো? কেউ দেখে ফেললে জাত যাবে”?
— কই নাতো।
— সে তো ভালই বুঝতে পারছি
— ইটস ওকে
— মোটেই ওকে না। ছাত্রীর সামনে তো টাইগার ভাব দেখাও
— আপনি তো ছাত্রী না
— আবার আপনি?
— আন ইজি লাগছে
— লাগুক। যতক্ষণ আমার সাথে আছো ততক্ষণ ভেবে নাও রিমান্ডে আছো
— রিমান্ডে কাউকে খেতে দেয়? জানতাম না
— বাহ। এই তো কনফিডেন্স লেভেল হাই হচ্ছে। বাকীটাও হয়ে যাবে
— কি হবে?
খাবার চলে এসেছে। কেতাদুরস্ত হয়ে কোন বিবাহিতা মহিলার সাথে একান্তে কোনদিন খাইনি। তাই গলা দিয়ে নামছে না।
বাসায় এসে দেখি বড় মামা হাজির। রিটায়ার্ড জেনারেল। রাশভারি। গোঁফধারী। সম্পর্কে মামা হলেও সম্পর্ক জাহাঁবাজ বসের মত। পারতপক্ষে আমি তাঁর মুখোমুখি হইনা। আম্মার মুখ কালো। বড় মামা গম্ভীর। কাগজগুলো আম্মাকে বুঝিয়ে দিয়ে রুমের দিকে যেতেই বড় মামার সাউন্ড সিস্টেম সশব্দে গর্জে উঠলো, “দাঁড়াও”। মিলিটারি কায়দায় কুইক মার্চের পর হল্টের মত শোনালো। আমি দাঁড়ালাম। বললেন, “বসো”। আমি চেয়ার টেনে বসলাম। তাতে মেঝেতে শব্দ হলো। তিনি বিরক্ত হলেন। এটিকেট আর ম্যানার সম্মন্ধে কিছু ছবক দিলেন। কর্কশ ঠেকলেও এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিলাম। তবে তাঁর শেষ কথাটা কানে গিয়ে ঢুকলো কিন্তু বেরোলো না। অনবরত ইকো হতে থাকলো, “তুমি নাকি এ বাড়ী বন্ধক দিয়ে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বিজনেস করবে”? চুপ করে রইলাম। লোন নেওয়ার কোন পরিকল্পনাই আমার ছিলনা কোন দিন। আম্মাকে জব্দ করার জন্য ফান করে বলেছিলাম মাত্র। চুপ করে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হলো। বড় মামা অবশ্য শোনার লোক না। কমান্ড করাই তাঁর কাজ। তাঁর কথাই যেন শেষ কথা। আর এজন্যই আমি তাঁকে এড়িয়ে চলি। কপালের ফেরে আজ সেই টাইগারের মুখোমুখি হয়েছি। নিরবতা ভেঙ্গে মেঘ ডমরু নাদে বললেন, “ওসব কল্পনা টল্পনা ছাড়ো। নো বন্ধক, নো লোন, নো বিজনেস। ওকে? ট্রাই টু গেট আ জব ইমিডিয়েটলি”। এই বলে বড় মামা বিদায় নিলেন। আমি আম্মার দিকে রাগ নিয়ে তাকিয়ে বললাম, “মামারে ভাড়া কইরা আনছো? আমি চাকরি করুম না। বিজনেসই করুম”। আম্মাও কম না। জেনারেলের বোন। তাই গলা চড়িয়ে বললেন, “টাকা পাবি কই”?
— লোন নিমু
— কে দেবে তোকে লোন “?
আমি মওকা পেয়ে গেলাম। বললাম, “ যারে বিয়া করুম সেই দেবে”?
— সে কে?
— এক বাচ্চার মা।
এই কথা বলা শেষ। আম্মার বড় মামাকে মোবাইল করাও শুরু। দু’জনের কি আলাপ হলো জানিনা। বাসার আবহাওয়া সেই থেকে থমথমে। বিকেলে শৈলীকে পড়াতে যাওয়ার কথা। মেজাজ চড়ে আছে। তাই, কমফোর্টার মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। গোল্লায় যাক সব।

চলবে…

About

Anwar Hakim

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}