২৪শে নভেম্বর ১৯৮৬ তে আমার বি এ ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে।এরমধ্যে ই আমার বড়ো ননাসের (আমাদের চট্টগ্রাম নাসিরাবাদ কলেজের সমাজ কল্যাণের প্রফেসর) কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে বদলি হয়ে যাওয়ায় উনারা পুরো পরিবার কুমিল্লা শিফট করবেন। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যাবার আগে তাঁর কাছে থাকা ছোটো ভাই গাজী মওদুদূর রহমান বুলুর পছন্দের পাত্রীর সাথে এনগেজমেন্ট টা করিয়ে বিয়ের ডেট ঠিক করে যাবেন।
সেই মতো ২৩ শে নভেম্বর আমাদের বাসায় তারা আমাকে আংটি পরাতে আসবেন। আমার বড়ো ভাসুর ঢাকা থেকে আংটি নিয়ে যাবার কথা।সন্ধ্যার পর বড়ো আপা ও বড়ো ভাই আমাদের বাসায় আসলেন।বাইরে থেকে আমার হাসবেন্ড (তখনও হন নি) ঘুরঘুর করছিলেন যদি ডাকে তবে রুমাল মুখে হাজির হবেন কবুল পড়তে।
আমার পরিবার এনগেজমেন্ট এর বিপক্ষে ছিলেন। আর তাই ই হল।আমার ভাসুর অফিস থেকে ডিউটি শেষে (বাংলাদেশ বিমানের ফুয়েল অফিসার ছিলেন) বাসায় না ফিরে ফ্লাইটে চট্টগ্রামে যাওয়ায় আংটি নিতে ভুলে গেলেন।এমনি এমনিই বিয়ের দিন ধার্য্য করা হল।৯/১/৮৭ শুক্রবার দুপুরে। উনাকে (হাসবেন্ড) এক ফকির বাবা নাকি বলেছিলেন ১/১/৮৭ উনি মারা যাবেন। তাই ২/১/৮৭ প্রথম শুক্রবার হওয়া সত্বেও তিনি দ্বিতীয় সপ্তাহ টা বেছে নিয়েছিলেন। যদি বেঁচে যান তাহলে বিয়েটা মজা করেই।করবেন এই আশায়।
যাক পরেরদিন ক্যানটিন গেটে কলেজ বাসে উঠে বইয়ে ডুবে গেলাম।পাশে ঘটকিনি দুই বান্ধবী আপুনি ইশারা করে বাইরে দেখতে বল্লো, দেখেতো মরে যাই! মরে যাই!সামনে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন ভদ্রলোক! তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে বইয়ের পাতায় রাখলাম।পড়া কি আর মাথায় ঢুকে!
এভাবে নানা উছিলায় উনি কলোনিতে বাসার আশে পাশে কখনো কাপড়, আংটি, চুড়ির মেজারমেন্ট নিতে হাজির হয়ে যান।লজ্জায় মরি মরি অবস্থা আমার!
এরপর আসে সেই দিন।জানুয়ারির ৪ তারিখ পর্যন্ত ক্লাস করে পড়া এগিয়ে রাখলাম।তারপর আট তারিখ সন্ধ্যায় গায়ে হলুদ হয়ে গেল।৯/১/৮৭ দুপুরে বিয়ে হয়ে গেল।ইচ্ছে ছিলো পারলারে সাজার।কিন্তু পারলারে নিয়ে যাবার লোক পাওয়া গেলো না।বড়ো বোন এবং আমার হাসবেন্ড এর বান্ধবী মনি আপাই সুন্দর করে খোঁপা বেঁধে সাজিয়ে দিলেন।
সেজ দুলাভাই (ননাসের হাসবেন্ড পিডিবি ট্রেনিং ডাইরেক্টর ছিলেন) এর কল্যানে পিডিবি রেস্ট হাউসে উঠানো হল।ঐ সময় সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হল,সাথে সালাম। কাউকে চিনিনা তখনও। অবনত মস্তকে সবাই কে সালাম করে গেলাম।কারোরই চেহারা দেখিনি।বসানো হল দুজনকে। ফটোসেশন চল্লো।এরপর মিস্টিমুখ, বিভিন্ন রিউচুয়াল।
এবার দেখি আমার ছোটো ননাস (হাসবেন্ড এর এগারো মাসের বড়ো) রুবি আপা একটা ছোট্ট আলাউদ্দিন এর মিস্টির বাক্স, একদম ই মিনি প্যাক করা। আমার হাতে দিয়ে বল্লেন, ‘বেবি,ধর এটা খাও বুলু অর্ধেক খেয়ে রেখেছে বাকিটা তুমি খাও।এটা নিয়ম।আমি হাতে নিলাম না খুলে ই প্রথমবারের মতো কথা বললাম।’এটা তো খালি মনে হচ্ছে ‘
তখন আমার শ্রদ্ধেয় টিচার বড়ো আপা বল্লেন” মাশা আল্লাহ “বুলু হীরা চয়েস করেছে। কেউ ঠকাতে পারবে না তোমরা। ‘
এরপর আপা বল্লেন তুমি এবার ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।আর নরমাল একটা শাড়ি পর যাতে বউ বউ না লাগে।কেননা রাতের ট্রেনেই আমরা ঢাকা ফিরবো।
উনার কথামতো কাজ করলাম তারপর রেস্ট হাউসে রাতের খাবার খেয়ে স্টেশনে পৌঁছালাম।একটা বগিতে সবার সাথে গিয়ে বসলাম। মিয়াভাই ভাবি আসলেন বিদায় দিতে। ট্রেন প্রায় ছেড়ে দিয়েছে এমন সময় উনার বন্ধুরা আমাকে অন্য একটা সিংগেল ক্যুপ নিয়ে গেল ।যেখানে আমার হাসবেন্ড দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
ক্যুপে উঠার সাথে সাথেই কিছু বুঝার আগেই ট্রেন জোরে চলা শুরু করলো। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।উনি আমাকে ধরে বসিয়ে দিলেন। যেহেতু আমাদের প্রথম রাত বাসর রাত তা ট্রেনে ই হোক না কেন।বড়ো দের শেখানো মতো আমি তাকে টুক করে সালাম করতেই অপ্রস্তুত হয়ে তিনি প্রথমবারের মতো তার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে রাখলেন। দীর্ঘক্ষণ।
এরপর ছাড়াপেয়ে আমি বসে গেলাম জানালা ঘেঁষে। উনিও আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন।এবং প্রথম বার দুজনে প্রান খুলে কথা বলা শুরু করলাম।যদিও আমি শুনেছি বেশি উত্তরে হু হা ছাড়া কিছুই বলিনি। তিনি চেয়েছিলেন এই পবিত্র রাতকে পবিত্র অবস্থায় স্মৃতি মধুর করে রাখতে সেই খানে আমিও একমত ছিলাম।উনি সম্পর্কের শুরুতে কিছু কথা (তার জীবনের অজানা) আমায় জানতে চেয়েছিলেন। তারপর আমার প্রতিক্রিয়ার উপর সম্পর্ক তৈরি হউক।
এভাবেই ওর অতীত জীবনের মানুষটি আমাদের বাসর সংগী হয়ে আমাদের দুজনের সাথে ট্রেন জার্নি করেছিল!
ফাতেমা_হোসেন
১২/১/২২.
আজকের দিনে ছিলো বউভাতের প্রোগ্রাম।