পলির মা, সৈয়দা রাহেলা বেগম বটিতে বসে, লাউ কাটছেন, আজকে তিনি লাউ দিয়ে তিন পদ রান্না করবেন। এজন্য আলাদা আলদা বাটিতে লাউ রাখছেন। লাউয়ের খোসার সাথে একটা আলু দিয়ে, লাউয়ের খোসা ভাজি করবেন, লাউ দিয়ে মশুরের ডাল দিয়ে ঝোল, আর লাউয়ের বিচি দিয়ে ভর্তা।

গত তিন দিন ধরে নিরামিষ চলছে এই বাড়ীতে, জাহিদের হাত পুরোপুরি খালি, তাই মাছ বাজার করার মতো টাকা হাতে নেই৷ তবে, আজ কিছু টাকা পেলে, হয়তো সন্ধ্যায় কিছু মাছ আনতে পারে, এটা সকালেই মাকে বলেছে জাহিদ।

পলি, কলি আর নাহিদ এসে মাকে জড়িয়ে ধরলো। ফাতেমা খানম বটি নিচে নামিয়ে রাখলেন। তিনি বেশি হতবাক হয়েছেন দেখে।

তিনি জানেন, শারমিনের বাবা মারা গিয়েছেন। সাঈদ নিজে ফোন করেছে গ্রামের দোকানে। কিন্তু এটাও বলেছে এখন আসার দরকার নাই। যেহেতু খবর দিয়েছে মারা যাওয়ার পরের দিন, তাই পরে যাওয়ার জন্যই বলেছে সাঈদ।

মা, কেমন আছ তুমি?
– ভালো আছি বাবা। তোরা কখন রওনা হয়েছিস?
– আজকে সকাল ছয়টার ট্রেনে।
– আর এখন দুপুর দেড়টা বাজে।
– রাস্তায় কিছু খেয়েছিস?

কলি বললো মা, আমরা রাস্তায় বাসায় কিছুই খাইনি, এখন কিচ্ছু দাও, ক্ষুধা লাগছে।
– হ্যা, হ্যা। এই শাহিদ গাছ থেকে দুইটা লেবু দে, শরবত করে দেই। আগে ঠান্ডা হ, আমি তরকারি বসাই।
– এখনো রান্না কর নি?
– এক হাতে এই সংসারের কাজ করতে হয়।
– মা, জলিপা কোথায়?
– এক বউল কাপড় নিয়ে ধুইতে গিয়েছে পুকুর পাড়ে, একদম গোসল করে আসবে। ওরে এক কাজ দিলে, কাজ শেষ করতে তিন ঘন্টা লাগে। না করলো পড়াশোনা, না পারে কাজ। আচ্ছা, শোন আমার বউমা কি করছে?
– কান্নাকাটি করছে!
– বাপ নাই যার, দুনিয়া অন্ধকার তার। বেয়ান আর বাকি মেয়েরা ভালো আছে? আর আমাই সাঈদ?
– সবাই ভালো আছে।
– আচ্ছা, যা আগে তোরা মুখ হাত ধুয়ে নে, পরে কথা বলবো।

মুখ হাত ধুয়ে, রান্নাঘরে পলি এসে মায়ের পাশে এসে বসলো,

মা, তুমি কেমন আছ?
– আলহামদুলিল্লাহ। আমি ভাবছিলাম এই মাসের শেষে বউমারে দেখতে যাবো, মেয়েটার বাবা মারা গেল, আবার পোয়াতি ও হইছে। এখনই যাইতাম, সাঈদ না করলো, এখন সত্য কথা ভাড়ার টাকাও হাতে নাই। গেলে আরও সাঈদের জন্য ঝামেলা তাই যাইনি।
– ভালো করেছো। ভাইজান, এখন ঝামেলায়। খালুজানের জায়গায় নতুন বস আসবে! তাই, আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছে, কয়েকদিন বাড়ীতে থাকতে।
– আল্লাহ তাড়াতাড়ি আমার বাচ্চারে ঝামেলা মুক্ত করুন।
– মা,
– জলিপার বিয়ে দিবা না?
– এই শ্যামলা মেয়েরে কে বিয়ে করবে? না আছে রুপ না আছে বিদ্যা!
– ভাইজান, আমার জন্য বিয়ের পাত্র নিয়ে আসে। এদিকে জলিপা বাকি।
– ভাইজানের নখের বুদ্ধি কি তোদের আছে? নিশ্চয়ই ভালো পেয়েছে তাই নিয়ে আসছে।

পলি আর কথা বললো না, কারণ সাঈদ তার মায়ের অতি আদরের সন্তান, তিনি তার কথা খারাপ কিছুই শুনতে পারেন না। এর পিছনে কারণ একটাই সাঈদ এর আফে আরও তিন সন্তানের মৃত্যু। সাঈদ তার যক্ষের ধন। এজন্যই তার এতো গুলি ছেলে-মেয়ে। তিনি ভেবেছিলেন, আগের তিন জনের মতো এরাও হয়তো বাঁচবেনা। সন্তানের জন্য পাগল ছিলেন রাহেলা।

নাহিদ মায়ের শাড়ীতে মুখ মুছে বলছে, মা এতো মজা করে কেমনে রান্না কর গো?
– কি এতো মজা হইছে? নিরামিষ রান্না।
– আমার কাছে অমৃত। কতদিন পর এতো আরাম করে খেলাম।

কলি, পলির দিকে তাকিয়ে আছে, কারণ টা সত্যি। গত কয়েক মাসে, এতো যত্ন নিয়ে কেউ তাদের খাওয়ায় নি। মায়ের এমন যত্ন ভালবাসায় নুন ভাত ও ঘি ভাত লাগছে।

জলি বার বার বলছে, আমার যে কি আনন্দ লাগছে, আমরা তিন বইন একসাথে, কত্ত দিন পর। আজকে সারা রাত গল্প করবো।

রাহেলা বেগম তিন ছেলে-মেয়েকে বললেন, তোমরা বাড়ীতে একটু সময় ও জলির কথায় নষ্ট করবেনা। বই খাতা নিয়ে পড়বে। এই সময় আর আসবেনা। ওর শুধু গল্প, আর আড্ডা, কাজ নাই তো।

সপ্তাহে খানেক পরে, জাহিদ এসে মায়ের কাছে রান্নাঘরে বসে বললো, মা জলিপার জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব ভাইজানের কাছে গিয়েছে। ভাইজান কল দিলেন, ছেলে পাশের গ্রামের।
– সাঈদ কি বলে?
– ভাইজান তো বলছে দিয়ে দিতে।
– কি করে ছেলে?
– বিস্কুট কোম্পানিতে চাকরি করে, বেতন খুবই সামান্য, ছেলে দেখতে ভালো। কিন্তু বাড়ীর অবস্থা সুবিধার নয়, টিনের বেড়ার এক চালা ঘর। ডাল-ভাত খেতে পারবে, কোন মতে। তাদের অবস্থা তেমন ভালো নয়, তাই তারা ১০/১২ জন মানুষ এসে, আপাকে কাবিন করে নিয়ে যাবে।
– কাবিন করে?
– ভাইজান এজন্য রাজী, বিয়েতে খরচ নাই।
– মেয়েরে কিছু দিব না?
– তাদের ঘরে জায়গা নাই, তারা স্পষ্ট না করে দিয়েছে। তারাও তেমন কিছুই দিতে পারবেনা। ও মা, এতো হত দরিদ্র পরিবারে কি জলিপা সুখী হবে?
– বয়স ২৭ পার হয়েছে, শিক্ষা নাই। এইট পর্যন্ত পড়ছে, বাপ নাই, দেখতে ও শ্যামলা। ওর কি যোগ্যতা আছে?
– মা, আরেক বার ভাববে?
– সাঈদ যখন ভালো বলেছে, তবে ভালোই হবে। সাঈদ কোন দিন আসবে?
– বিয়ের দিন আসবে, ওই দিন ই চলে যাবে। ভাবীর নাকি শরীর ভালো না, তাছাড়া আরও নাকি সমস্যা আছে।
– বুঝলাম।

চলবে…

আন্নামা চৌধুরী
২১.১১.২০২১

About

Annama Chowdhury

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}