নাহিদ সকাল বেলা ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। পলি-কলি সব ঠিক ঠাক ভাবে গুছিয়ে দিচ্ছে।
রাহেলা খানম কৌটায় করে নিজের হাতে বানানো চিড়েরনাড়ু আর তিলের নাড়ু, দিলেন। দুটি কৌটা দিয়ে বললেন, একটা বউমা কে দিবি, আর আরেকটা তোর, পড়তে বসলে ক্ষিদা লাগলে খাবি। কলি-পলি যাওয়ার সময় আরও দিয়ে দিব। বাবা, মন দিয়ে পরীক্ষা দিবি, যেন খুব ভালো ফল আসে।
নাহিদের চোখ ছলছল, দুই আপা ছাড়া এই প্রথম ভাবীর বাসায় যাচ্ছে সে। খুবই চিন্তা হচ্ছে তার।
পলি নাহিদের পিঠে হাত রেখে বললো, ভাবী যা দিবে, তাই খাবি। খুব ভালো করে সব বিষয় পড়বি, যেন পরবর্তীতে ভর্তি পরীক্ষার কাজে আসে। আর মাথা ঠান্ডা করে পরীক্ষা দিবি।
– দোয়া করিস আপা।
– অবশ্যই। আর আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট হলে, গঞ্জের দোকানে কল দিস। যেকোনো দিন রেজাল্ট হয়ে যাবে।
– আচ্ছা জানাবো, তোদের সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস চলছে যাবিনা?
– আরেকটি চিঠির অপেক্ষা ভাই। তুই খুব ভালো করে পরীক্ষা দিস।
– হুম।
নাহিদ কে বিদায় দিয়ে, খুব বেশি কান্নাকাটি করছেন রাহেলা খানম। ছোট ছেলেকে নিয়ে দুঃচিন্তা বরাবরই বেশি করেন রাহেলা।
নাহিদ ভাইয়ের বাসায় পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। নতুন বাসা না চেনায়, বই খাতা সব নিয়ে ভাবীর বাবার বাসায় গেল নাহিদ।
শারমিন দরজা খুলেই বললেন চিঠি পেয়েই রওনা হয়েছো বুঝি?
– ইয়ে মানে, আমার পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে…
– হ্যা হ্যা জানি জানি। এই আয়মন দরজা আটকে দে, আমি বাসায় যাচ্ছি, আমার আরামের দিন শেষ।
– ভাবী চাবি দিয়ে দাও, বাসার নাম্বার বললেই হবে, আমি চলে যাবো।
– না, চলো।
নাহিদের বেশ লজ্জা লাগছে, আয়মন দরজা খট করে লাগিয়ে দিল,কিন্তু কুশল বিনিময় পর্যন্ত করলো না। ওদের অহংকার আগের মতোই আছে। ভাবী ও খুব বিরক্তি নিয়ে তার সাথে যাচ্ছেন।
এই বাসার ছোট্ট একটি রুমে নাহিদের থাকার ব্যবস্থা হলো, ড্রয়িং রুমে চাইলে সিংগেল খাটে একজন থাকা যাবে, কিন্তু ভাবীর ধারণা সে হয়তো রুম এলোমেলো করে দিবে, সেজন্য আট ফিট বাই আট ফিটের ছোট্ট রুমে নাহিদের থাকার ব্যবস্থা হলো।
ঠিক পাঁচ দিন পর, পলি আর কলির ১ম বর্ষের রেজাল্ট হয়েছে পলি দ্বিতীয় বিভাগ, আর কলি প্রথম বিভাগ পেয়েছে।
শারমিন রেজাল্ট শুনে নাহিদ কে বললো এতো আরামে থেকেও পলি সেকেন্ড ডিভিশন পেল, আমাদের হামিদা বুয়ার ছেলেও ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে।
– ভাবী, আপনি অনার্সে ভর্তি হবেন নাকি?
– সংসার করি আগে, আর পড়াশোনা! দুদিন পরেই আবার বাবু হবে।
– ভাইজান একজন বিসিএস ক্যাডার আর আপনি ইন্টারমিডিয়েট পাশ থাকবেন?
– নাহিদ বেয়াদবি করবেনা, ছোট মানুষ, ভদ্র ভাবে থাকবে।
নাহিদের এই কথা বলতে পেরে বেশ শান্তি লাগছে কারণ ভাবী ইন্টারমিডিয়েটে তৃতীয় বিভাগ পেয়েছেন। অথচ পলি আপার রেজাল্ট নিয়ে ঠিকই মজা নিচ্ছেন।
তিনি নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে ভাইজান কে বিচার দিবেন , আবার নিজের সম্মানের কথা ভেবে নাও দিতে পারেন।
জাহিদ বাজার থেকে বাতাসা কিনে নিল, দুই বোন খবর শুনে গলায় জড়াজড়ি করে হাসছে, আর কলি বলছে আপারে, আমরা পাশ করে ফেলেছি। সত্যি পাশ করে ফেলেছি।
জাহিদ বলছে ৯৭ সালের পরীক্ষা নাকি কঠিন হয়েছিল, সবাই বলাবলি করছিল, যাক পাশ করে ফেলেছিস শান্তি। আর মাত্র কয়েক বছর কষ্ট করলে গ্রেজুয়েট হয়ে যাবি!
– তাই যেন হয়, তাই যেন হয়।
দুই মাস পরে নাহিদ পরীক্ষা শেষ করে বাড়ী আসলো, কিন্তু সাঈদ পলি-কলি যাওয়ার ব্যাপারে এখনো কিছুই জানায় নি। এজন্য দুই বোন বিরাট টেনশনে আছে, তাদের পড়াশোনা হয়তো আর হবেই না, এইটা ভাবছে তারা!
শারমিনের বাবু হবে এই মাসে, পলি ভাবছে হয়তো বাবু হওয়ার পরই ভাইজান তাদের নিয়ে যাবে। আশায় বুক বেঁধে আছে দুই বোন।
ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং করার জন্য নাহিদ ঢাকা যাবে, কিন্তু জাহিদ কোন ভাবেই তাকে টাকার জন্য দিতে পারছেনা।
শেষ পর্যন্ত শাহিদ তার এক বন্ধুর কম্পিউটারের দোকান আছে মতিঝিলে, সেখানে চাকরীর ব্যবস্থা করলো, বেতন সাড়ে তিন হাজার টাকা। এই বেতনে দুই ভাই ডাল-ভাত খেয়ে মেসে থাকতে পারবে কোন রকম।
শাহিদ সরকারী ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়েছে কিছু দিন আগে, কিন্তু ক্লাস একদিন ও করেনি, তার চিন্তা এখন নাহিদ কে নিয়ে, সে যেন ভালো জায়গায় চান্স পেতে পারে। সেজন্য সে চিন্তা করছে সে শুধু পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিবে, আর বাকি সময় কম্পিউটারের দোকানে চাকরি করবে, আর নাহিদ এক /দুই টা টিউশনি পেলে টেনেটুনে চলে যাবে।
দুই ভাই বিদায়ের সময় জাহিদ বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে পাঁচশো টাকা দিল শাহিদ কে। কারণ প্রথম কয়েক দিন তো তাদের চলতে হবে।
রাহেলা খানম আল্লাহর নামে দুই ছেলেকে বিদায় দিলেন। দুজনের বয়সই কম, কিন্তু এই অবস্থায় তার এছাড়া কোন পথ নেই।
পরেরদিন গ্রামের বাজারে ফোন আসলো সাঈদের এক ছেলে সন্তান হয়েছে। কিন্তু এই মুহুর্তে পরিবারের কেউ তার ছেলে দেখার জন্য, যাওয়ার দরকার নাই, তিনি যাওয়ার সময় হলে চিঠি দিবেন, বললেন জাহিদ কে।
খবর শুনে পলি-কলির সময় যাচ্ছেনা কখন ভাতিজার মুখ দেখবে। তাদের বংশের প্রথম সন্তান।
কলি বার বার বলছে আমার এখনই উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কি করছে বাবাটা! কার মতো হয়েছে মা?
রাহেলা খানম বলছেন আমার প্রথম নাতি আমার কেমন লাগছে বল, কেন যে সাঈদ না করে বুঝিনা। আমার কি নাতি দেখতে ইচ্ছে করেনা, সে চিঠি দিবে তখন যাবো!
জাহিদ বললো ভাতিজারে দেখতে আমার ও মন চায় মা। হয়তো ভাইজান ঝামেলায় আমরা গেলে হয়তো ঝামেলা বাড়বে, তাই না করছে। হাসপাতাল থেকে বাবুকে আনলেই হয়তো চিঠি দিবে। চিন্তা করো না। আচ্ছা মা, আমি যাই দুই কেজী জিলাপি কিনে আনি, সবাইকে দিবে। গরীব চাচা সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতে পারছেনা, জিলাপি মুখ করাই।
– তোর যেমন অবস্থা, সেভাবেই করতে হবে বাবা। নাতির মুখ দেখে কি দিব, সেই চিন্তা লাগছে এখন!
– ব্যবস্থা হবে চিন্তা করো না!
পলি প্রতিদিন দুই/,তিন বার করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে, এই ভেবে, হয়তো ভাইজান চিঠি লিখবেন বাবুকে দেখতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আজ পাঁচ দিন হয়ে গিয়েছে এখনো চিঠি আসেনি। পলির তার ভাতিজাকে দেখার জন্য মন ছটফট করছে, সাথে পড়াশোনা কবে শুরু হবে তার জন্য চিন্তা হচ্ছে, কিন্তু কোন খবরই আসছেনা…..
চলবে…
আন্নামা চৌধুরী
২৭.১১.২০২১