জাহিদ বাড়ীতে এসে দেখলো, মা লাউ কাটছেন, তবে খুব আনমনে। পলি আলনার সব কাপড় নামিয়ে একটা একটা করে ভাঁজ করছে, কলি পড়াশোনা করছে।

জাহিদ বললো, মা আজ কি লাউ রান্না করবে?
– মাত্র এটা কেটে আনলাম।
– মা, লাউ এর খোসা দিয়ে ভাজি করবে, একদম কচি লাউ দেখছি।
– হ্যা, দেখি।
– সাঈদের সাথে কথা হয়েছে?
– নাহ, ভাইজানের নাকি আজ কি বাইরে কাজ, তাই অফিস থেকে বাইরে।
– ওহ, শোন, কাল টাকা পাওয়ার পর, দুই লক্ষ টাকা তুই ফিক্সড করে পলি আর কলির বিয়ের জন্য রাখবি।

– এটা ভালো বুদ্ধি মা, ওদের কে একটু ভালো উপায়ে যেন দিতে পারি।

– আর পঞ্চাশ হাজার দিয়ে তুই একটা লাইব্রেরি দে বাবা। এভাবে সংসার আর চলেই না। শাহিদ আর নাহিদ কে তখন সামান্য দিতে পারবি। ওদের কিছুটা সাহায্য হবে। আর যদি এমনি টাকা দিয়ে দিস তাহলে টাকার অংক কমে যাবে।

কিন্তু ব্যবসা করলে টাকা লাভ আসবে, তখন কাজে দিবে। আর ব্যবসা করলে পড়াশোনা টা করতে পারবি, চাকরির জন্য, সারাদিনের পায়ে হেঁটে টিউশনির কষ্ট অনেক খানি কমবে।
– মা, ঘর ঠিক করবে না?
– না বাবা। প্রয়োজন শেষ হয়না, আর ঘর!
– আর বাকি পঞ্চাশ কি করবে?
– তোর ভাইজানের বদলি নিয়ে ঝামেলা, সে এক লক্ষ টাকা চেয়েছে!
– কি? সে টাকার কথা জানলো কেমনে?
– না, তুই যাওয়ার পর চিঠি এসেছি। সে এই টাকার কথা জানেনা। সে জমি বন্দক দেওয়ার কথা বলছে।

জাহিদ চিৎকার করে বলছে, মা আমাদের তিন বেলা ডাল ভাত জুটেনা৷ আর তাকে তুমি জমি বন্দক দিয়ে দিবে? আমার মা, ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করছে।
– তোমরা চার ভাই সমান ভাগে পাও পঞ্চাশ করে, আর বোনেরা ২৫ করে। কিন্তু এখন আমার তিন মেয়ে, একজন বিয়ে হয়েছে। তাছাড়া জমি বিক্রি মাত্র শুরু হয়েছে, আমার আরো চার/সাড়ে চার লাখ টাকার সম্পত্তি আছে। তখন আমি পলি-কলিকে আর ভাগ দিব না, জলি আর তোদের চারজন কে দিব।আর সাঈদ কেও কম দিব, কথা দিলাম।
– ভালো।
– রাগ করিস না বাবা। যেভাবেই হোক কলি-পলি, নাহিদ কে রেখেছে তার বাসায়, খরচ যাই হউক দিয়েছে। এখন বাবা, তুই যদি না বুঝিস আমি কোথায় যাবো?
– মা, আমার পলি- কলির বিয়ের টাকায় কোন সমস্যা নাই। তোমার টাকা ভাইজান কে দাও, তাতে ও আমার দুঃখ নেই, কিন্তু জমি বন্দক দেওয়ার কথা কেন তার মাথায় আসলো?
– আমি তো বন্ধক দিচ্ছিনা। এখন সে, তোদের সবাইকে আগলে রাখে, এখন তাকেও দেখতে হবো, সেজন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা দিচ্ছি!
– মা, কি আগলে রাখে! জানা আছে।
– আজ দুই মাস মেয়ে দুটিকে কি পেরেছি হোস্টেলে দিতে? যেভাবেই হোক রাখে, আর তো কেউ বাবা, এই কাজ ও করেনা। থাক ঝামেলা করে লাভ নেই। তুমি বাবা, লাইব্রেরির জন্য ঘর দেখো!

জাহিদ আর কিছু না বলেই পুকুর ঘাটের দিকে গেল, তার অতিরিক্ত রাগ হলেই সে চুপ করে ঘাটের কাছে বসে থাকে।

পলি ঘর থেকে এসে বললো মা, ভাইজানের বদলির জন্য এতো টাকা দিবে? তার না, এতো বড়লোক শ্বশুরবাড়ী? তারা দেয় না?
– জামাই হয়ে খুঁজবে নাকি?
– বড়লোক শ্বশুর দেখেই তো বিয়ে করলেন, তোমার ছেলে!
– যেদিন মা হবি, সেদিন বুঝবি কি জ্বালা, এখন বুঝবি না।

সাতদিন পরে আজ রাহেলা খানম নাতি দেখতে যাচ্ছেন। তার ভাই আরও দশ হাজার টাকা বেশি দিয়েছেন। এজন্য তিনি পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে টয়লেট টা একটু উন্নত করেছেন। এক হাজার যাওয়ার রাস্তা ভাড়া। শাহিদের জন্য এক হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। আর তিন হাজার টাকা দিয়ে আট আনার একটি স্বর্ণের চেইন নাতির জন্য নিয়েছেন। বংশের প্রথম বাতি।

স্বর্ণের দাম হু হু করে বাড়ছে। এখন প্রায় ছয় হাজার টাকা হয়ে গিয়েছে। তবুও সামান্য একটু সোনা দিয়ে নাতির মুখ তো দেখতেই হয়।

কলি সারা রাস্তা শুধু বলছে ইশ ভাইজানের ছেলেকে আমরা আদর করবো, ভাইজানের মতো ফর্সা হয়েছে নাকি? ভাবীর মতো শ্যামলা? একই প্রশ্ন বার বার করছে কলি। আবার মাকে প্রশ্ন করছে, মা নাম কি রাখা যায় বাবুর? ভাইজানের নাম সাঈদ ছেলের নাম সামী রাখলে কি হয় মা?

রাহেলা খানম বলছেন, তাদের ছেলে তারা নাম রাখবে, তোর এতো চিন্তা কেন?
– ওমা, আমি ফুপু না? মা আমি কিন্তু তোমার একটা জিনিস চুরি করেছি।
– কি?
– সেদিন ব্লাউজের জন্য একটা সাদা কাপড় মামী দিয়েছিলেন আমাদের জামার সাথে। কি নরম তুলতুলে। আমি বাবুর জন্য কাঁথা সেলাই করেছি। আর লিখেছি সামী।
– এই কাজ কখন করলি?
– গত কাল রাতে, সব ঘুমানোর পর, হারিকেন জ্বালিয়ে এই কাজ করেছি। ভেবেছিলাম তাদের বাড়ী গিয়ে বলবো। কিন্তু এতোক্ষণ কথা পেটে রাখার ধৈর্য্য নেই।

পলি বললো, আমার ও ভাতিজা দেখার জন্য মন ছটফট করছে। আর দয়া করে কথা বলিস না, রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, চুপ করে থাক।

রাহেলা খানম মনে মনে ভাবছেন অথচ তার কত ধৈর্য্য নাতির আকিকা হয়ে নাম রাখা শেষ। এই কথা টি তিনি পেটে লুকিয়ে রেখেছেন, কারণ তারা কষ্ট পাবে।

জাহিদ লাইব্রেরির সাইন বোর্ড বানাতে দেয় নি। ভাতিজার নামে হবে, সেজন্য। না, দেখেই কত টান ভাতিজার জন্য। সবাই বলছে এখানে ব্যবসা খুব ভালো হবে, জাহিদ ও তাই আশা করছে।

গাড়ী দ্রুত গতিতে যাচ্ছে, রাহেলা খানম ভাবছেন সাঈদ কি বলবে পুরো টাকার কথা জেনে, যদিও সাঈদ এখন পরিস্থিতির কারণে বদলে গিয়েছে। কিন্তু এক সময় টিউশনি করে, নিজের ডাল-ভাত খেয়ে সব টাকাই এই সংসারব দিয়েছে। ঈদে ভাই-বোন দের জন্য হাত ভরে বাজার করেছে, এখন হয়তো পারছেনা, কিংবা বদলে গিয়েছে। কিন্তু আগে তো করেছে, এখন বিপদে এতোটুকু সাহায্য না করলে মনের অশান্তি দূর হবেনা রাহেলার।

সাঈদ কি অনেক ঝামেলা করবে? এরা আকিকা হয়েছে জানলে কি খুব কষ্ট পাবে? এদের কি হোস্টেলে ভর্তি করাবে সাঈদ? নাকি সব জট পাকিয়ে যাবে? এসব চিন্তা করছেন রাহেলা খানম….

চলবে…

আন্নামা চৌধুরী
০৪.১২.২০২১

About

Annama Chowdhury

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}