ট্রেন স্টেশন থেকে নেমে, রাহেলা খানম চারিদিকে দেখছেন। কোথাও মিষ্টির দোকান আছে কিনা! কিন্তু তিনি দেখতে পেলেন না।

জাহিদ বললো এই ভাবে কি দেখছো মা?
– মিষ্টির দোকান, আছে না?
– ট্রেন স্টেশনে মিষ্টি পাবে কি করে?
– নাতি দেখতে যাচ্ছি, মিষ্টি নিতে হবে না?
– ভাবীদের বাসার পাশের আছে, নিব।
– আচ্ছা।

পলির সারা শরীর বার বার গুলিয়ে যাচ্ছে, সারা রাস্তা কেমন যেন বমি বমি লাগছে। সে খুব বিরক্তি হয়ে বললো মা, আর দেরী কর না, আমার শরীর ভালো লাগছেনা।
– হ্যা, হ্যা। চল।

দুই কেজী মিষ্টি, এক কেজি রসগোল্লা, এক কেজী জিলাপি নিয়ে বেয়ানের বাসায় গেলেন রাহেলা।

কলিং বেল তিন বার দেওয়ার পর, কাজের বুয়া রহিমা দরজা খুলে দিল।

কলি বললো কি গো এতো দেরী খুলতে?
– আফনের ভাইজতা হারা রাইত জাইজ্ঞা তাহে, আর হক্কলে হের সাথে নানান ডং করে, আর সক্কাল হইলে হেরা ঘুমায়, আমি আছিলাম কাফর ধুইতে, হেই জইন্য হুনি নাই।
– ভাইজান কোথায়?
– দুলাভাই অফিসে। আসেন আফানারা তয় কতা কইয়েন হেরা চিক্কুর দিব, হেরার ঘুম ভাংলে।
– হুম।
বিশাল বড় বসার ঘর, তারা সবাই বসার ঘরে বসে আছে, বাকি রুম গুলো অন্ধকার করা, সম্ভবত সবাই ঘুমাচ্ছে। এই জন্য তারা বসার ঘরে বসে আছেন।

ঘন্টা খানেক পরে সাহেদা খানম বসার ঘরে এসে বসলেন।

আসসালামু আলাইকুম বেয়ান, আছেন কেমন?
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। নাতির যন্ত্রণায় রাতে ঘুম নাই।
– জোয়ান নানি,তাই এমন করে।
– নাতি বড় হয়ে গেল, দাদী এতো দিন পরে খবর নিতে আসলেন? নাতির মুখ আমি দেখাবো না।

রাহেলা খানম হাসছেন, কিন্তু কোন কিছু বলছেন না।

কলি দুই বার বললো, ভাবী আমি ওকে একটু কোলে নিই? তিনি বার বারই বলছেন, না না তুমি পারবেনা। ও ছোট মানুষ। অথচ ভাবীর ছোট বোন তারিন, মাত্র নাইনে পড়ে, সে কিন্তু দিব্যি বাবুকে কোলে রাখছে।

কলি এ নিয়ে মন খারাপ করে বসে আছে, সে বার বার পলিকে বলছে, আপা আমাদের কে কি একবার বাবু কোলে নিতে দিবেনা?
– অবশ্যই দিবে, এখন তুউ ছোট মানুষ এজন্য দিতে ভয় পাচ্ছে।
– তারিন কি?
– তারিন এই কয়েকদিন নিতে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে।
– আর কথা বলিস না তো! যত্তসব ফালতু যুক্তি।
– আচ্ছা বলছি না।

দুপুরে খেতে বসেছেন সবাই, সাহেদা খানম বললেন, বেয়ান আমরা তো জানিনা আপনারা যে, এখন আসবেন, তাই আর আকীকার মাংস রাখি নি! কিছু মাংস ছিল, এগুলো ও আমাদের কিছু আত্নীয় দের বন্টন করেছি।
– না না ঠিক আছে। আল্লাহ পাক আমার নাতিকে বড় করেন, হায়াত দিন। মাংস তো সবই এক।

জাহিদ, কলি-পলি যেন আকাশ থেকে পড়লো, তারা তিন ভাই-বোন সুক্ষ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু রাহেলা খানম তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে নিচের দিকে তাকি ভাত মাখিয়ে যাচ্ছেন, যদিও মুখে নিচ্ছেন না, কিন্তু ভাত মাখিয়ে যাচ্ছেন।

ভাত খাওয়ার পর পর, রাহেলা খানম শারমিনের রুমে বসে আছেন, কি বলবেন ছেলে-মেয়েদের তাই, তিনি ইচ্ছে করে তাদের এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

জাহিদ বারান্দায় পলি কে ডেকে বললো, কি রে ভাইজান আকিকা করে ফেললো অথচ আমার জানলাম না!
– মা জানেন কিন্তু!
– না, মাকে কিছু বলিস না, হয়তো এখানে এসে শুনেছেন। নিজেই কষ্ট পাচ্ছেন। তোরা মাকে কোন প্রশ্ন করিস না, মা আরও কষ্ট পাবে। মা,নিজেই কষ্ট পেয়েছেন এজন্য চুপ করে আছেন। আর কষ্ট দিস না!
– হুম।
– কলি কোথায়?
– মন খারাপ করে বসে আছে, ভাতিজা কোলে নিতে দিচ্ছে না, এজন্য।
– কলির এই আবেগের জন্য জীবনে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে৷ বুঝিয়ে বল ওকে। আর, আমি আজই চলে যাবো, তোরা থাক।
– না,আমরা ও চলে যাবো।
– তোরা দু/এক দিন থাক, মায়ের এখন গেলে কষ্ট হবে, এতো দূরের রাস্তা। আমি আজই চলে যাবো, পিরে তোদের নিতে আসবো।

সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত জাহিদ, কলি-পলি বসার ঘরে বসে আছে, অথচ এই বাসায় রুমের অভাব নাই চাইলে একটি খুলে দিলে, তারা কিছুক্ষণ রেস্ট নিতে পারে। অথচ এই বাসার মানুষ এড়িয়ে যাচ্ছে তাদের। জাহিদের এজন্য ভালো লাগছেনা, শুধু ভাইজানের সাথে দেখা করার জন্য সে, অপেক্ষা করছে…

বিকাল চারটার দিকে সাঈদ বাসায় এসে সবাইকে দেখে বেশ অবাক হলো।

খাওয়া দাওয়ার পর, মাকে বললো মা, আসবে বললে না তো আগে!
– নাতি দেখার জন্য মন ছটফট করছিল, তাই চলে এলাম। বাবা, তোর বাসা কি কাছেই?
– কেন?
– আমরা তোর বাসায় গেলে, ভালো হতো। এখানে কুটুম বাড়ী লজ্জা লাগছে।
– নাহিদ যাওয়ার পর, বদলির যন্ত্রণায় আমি বাসায় যেতেই পারিনি। এখান থেকে অফিস করছি। বাসায় গিয়ে কি করবে?
– কিছু জরুরি কথা ছিল?
– জমি বন্দক দিয়েছিলে?
– টাকা নিয়ে এসেছি।

এই কথা শুনে, সাঈদের বিরক্তি ভাব টা চলে গিয়ে, চেহারায় বেশ হাসি হাসি ভাব চলে এলো।

রাহেলা খানম বললেন, আমি নাতির জন্য একটা চেইন এনেছি, এটা বউমা কে দিয়ে দিস।
– চেইনের কি দরকার, তুমি এসেছো। তাই তো অনেক।
– না বাবা। খালি হাতে কি নাতি দেখা যায় নাকি! চাবি নিয়ে আয়, আমরা বাসায় যাই।
– এই ভাবে, চলে গেলে। আমার শ্বাশুরি অনেক কষ্ট পাবেন।
– আমি বুঝিয়ে বলবো।
– আচ্ছা, আমি চাবি নিয়ে আসছি।

চেইন দেখে শারমিন, সাঈদ কে বললো এটা চেইন নাকি সুতা?
– আরে বাবা, তুমি রেখে দাও। পরে যেকোনো কাজে লাগিয়ে দিও। চাবি দাও?
– চাবি দিয়ে কি করবে?
– বাসায় যাবে মা।
– বাসায় গিয়ে করবে? নাতি দেখতে এসেছেন, এখন চলে যাবেন।
– চলেই যাবেন, চাবি দাও।
– যত্তসব নাটক। আমি রহিমা বুয়া কে বলে দিচ্ছি, আমার রুমে যেন তালা দিয়ে আসে। আমার রুমে বাইরে কেউ ঘুরাঘুরি করুক, আমার পছন্দ নয়।
– আচ্ছা দিও তালা। এখন ঘরের চাবি দাও।
– দিচ্ছি।

সাঈদ হাসি হাসি চেহারা নিয়ে সবাইকে নিয়ে বাসার দিকে রওনা হলেন। যাওয়ার সময় বললেন আমার নতুন বাসার নিচে কলি-পলিদের স্যার ভাড়া থাকেন। তাকে বলে, আমি হলের ব্যবস্থা করছি।

এই কথা শুনেই কলি-পলির চেহারায় হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। যাক এতো দিন পর, পড়াশোনা চালু হবে।

বাসার গেইটে শফিউল আলমের সাথে দেখা হলো সবার। শফিউল আলম কলি-পলি দের শিক্ষক। কলি-পলি দুজন সালাম দিল।

আসসালামু আলাইকুম আলম ভাই কেমন আছেন?
– জি, সাঈদ ভাই। ভালো আছি, অনেক দিন পর বাসায় আসছেন দেখছি!
– জি। ভাইজান, আমার দুই বোন আপনার কলেজে পড়ে, এখন ওদের হলের ব্যবস্থা করে দিলে খুব উপকার হয়।
– জি, অবশ্যই। আপনার বোনেদের আমি দেখেছি কলেজে, ক্লাস ও নিয়েছি, এরা বেশ কয়েকদিন ধরে অনুপস্থিত দেখছি।
– জি, পারিবারিক ঝামেলা ছিল, সামান্য!
এখন ভাই হলের ব্যবস্থা হলে, খুব ভালো হয়।
– এখানে লোকাল স্টুডেন্ট বেশি, হলে সিট খালি আছে, আপনি ওদের পাঠিয়ে দিবেন, কিছু কাগজ পত্র ফিল আপ করে দিলে, দু/এক দিন পরে উঠতে পারবে। কাল এগারোটায় আমার সাথে দেখা করবে দুজনে কেমন!
পলি-কলি মাথা নাড়লো, এবং তারা খুব খুশি।

অনেক ধন্যবাদ ভাই
– না, না ঠিক আছে। আসছি, একটু বাইরে যাবো।
– জি।

বাসায় ঢুকে রাহেলা খানম বললেন, পলি পুরো ঘর ঝাড়ু দে, কেমন ময়লা হয়ে আছে।
– মা, আমার শরীর টা ভালো লাগছে না। রহিমা বুয়াকে বল, করে দিবে।

রহিমা বুয়া বললো, জিনা আমি এখন সময় নষ্ট করতে ফারুম না, আফা আমারে হের রুমে তালা দেওনের জন্য পাঠাইছিল, আমি তালা দিয়া বিদায় হচ্ছি।

রাহেলা খানম অবাক হয়ে দেখছেন, রহিমা বুয়া তালা দিয়ে হন হন করে চলে গেল। কলি ঝাড়ু নিয়ে বললো , দাও কলি বুয়া আছে, ঝাড়ু দিয়ে দিবে।

সাঈদ দোকানে গিয়েছেন, হয়তো কিছু আনতে। বাসায় ঢুকিয়ে দিয়ে, গিয়েছেন, এখনো আসেন নি।

জাহিদ মাকে বললো, মা আমি আজ রওনা দিব, তুমি ওদের হলে তুলে দিয়ে, গঞ্জের দোকানে ফোন দিও, আমি এসে নিয়ে যাবো।
-এক সাথে যাই বাবা।
– না, মা। আমার দোকান নতুন, টিউশনি আছে। তাছাড়া তালা দেওয়ার পরে এই ছোট্ট রুম আছে, তোমরা থাক, আমি যাই। ভাইজান আসলেই আমি বের হবো।

রাহেলা খানম আর কিচ্ছু বললেন না, সত্যি এই রুম বড় ছোট এখানে দুইজন মানুষের গাদাগাদি হয়ে যায়, আর চারজন সম্ভব নয়।

সাঈদ টাকার বিষয়ে সব জানার পরে, কি করবে, তার জন্য চিন্তা করছেন, তিনি। সব জানার পরে, মেয়েদের পড়াশোনা চালু রাখবে কি বড় ছেলে?, নাকি ঝামেলা করবে! তাই নিয়ে ভাবছেন রাহেলা, তিনি ছেলের বাসায় আসার অপেক্ষা করছেন….

চলবে…

আন্নামা চৌধুরী
০৭.১২.২০২১

About

Annama Chowdhury

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}