আজ ঈদের দ্বিতীয় দিন,সকাল থেকে বাড়ী-ঘর সবকিছুতে পরিষ্কার অভিযান চলছে, কারণ আজ জলি নতুন জামাই নিয়ে বাবার বাড়ী আসবে।

রান্নাঘর থেকে সুঘ্রাণ আসছে, রাহেলা খানম পোলাও, গরুর মাংস রান্না শেষ করেছেন, রুই মাছ ভাজি করবেন, এজন্য মাছ হলুদ মরিচ মাখিয়ে রেখেছেন, কারণ মাছ আগে ভাজলে খেতে মজা লাগবেনা। সব প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। এখন সালাদ কাটতে বসবেন।

কলি দুলাভাইয়ের জন্য মুরগীর ঝাল ভুনা করেছে। আর পলি করেছে পায়েশ। বেশ আয়োজন হচ্ছে নতুন জামাইয়ের জন্য।

নাহিদ এসে বললো মা, আমি তো বাবুর জন্য একটা পাঞ্জাবি এনেছিলাম।
– দাদুর জন্য?
– হ্যা।
– খুব ভালো করেছিস। আমিও এক সেট কাপড় জাহিদ কে দিয়ে আনিয়েছি। ওরা যেতে সময় দিয়ে দিব।
– কত আদর করতে ইচ্ছে করে, ও আমাদের বাড়ীর প্রথম সন্তান!
– রক্তের টান, আসবেই আসবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা!

এরমধ্যে কলি এসে বললো মা, জলিপা চলে এসেছে।
নাহিদ আর রাহেলা খানম সাথে সাথে উঠানে বেড়িয়ে এলেন।

জলি মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। রাহেলা খানম দেখছেন তার কালো মেয়েকে ও শাড়ী গহনাতে কত্ত সুন্দর লাগছে!

পলি-কলি দুলাভাইয়ের সাথে গল্প করছে, আর হাসাহাসি করছে। দুলাভাই মোটামুটি রসিক মানুষ, তিনিও বেশ মজা পাচ্ছেন।

জলি সাথে করে তার চাচা শ্বশুড়ের মেয়েকে নিয়ে এসেছে। এসে মাকে বলছে জলি,
মা, ওর নাম তিন্নি, ইডেন কলেজে পড়ে।
– ভালো তো।
– তিন্নি যাও, ওদের সাথে গল্প কর, এখানে গরম বেশি লাগবে।
– যাও মা, রান্নাঘরে অত্যাধিক গরম।
– মা, ওর বাবা কত্ত বড়লোক জানো! ঢাকায় নাকি বড় বড় দুটি কাপড়ের দোকান। বাড়ীতেও একতলা বাড়ী।
– হুম।
– এই যে, শাড়ি এটা তো চাচা দিয়েছেন।
– সুন্দর শাড়ি দিয়েছেন।
– আমার শ্বশুর বাড়ীতে ঈদে কাপড় কেনার নিয়ম নাই। সত্যি কথা হলো সামর্থ্য নাই, তাই এই নিয়ম। এই জন্য তুমি যে শাড়ি আমাকে, ঈদের জন্য দিয়েছিলে, এটা আমি ঈদের আগের রাতে আমার শ্বাশুড়িকে দিয়ে দিয়েছি। চাচা আমাকে দিয়েছেন, আমার তো ঈদে নতুন কাপড়ে হয়েছে কিন্তু আম্মার তো নাই। তাই দিয়েছি।
– ভালো করেছিস।
– মা, আরেকটা কথা।
– কি?
– তিন্নি কে কিন্তু সম্মানী দিয়ে দিও, প্রথমবার আমাদের বাড়ীতে এসেছে।
– হ্যা।
আচ্ছা আমি যাই, দেখি তিন্নি কি করে!

রাহেলা খানম মাছ তেলে দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কি করবেন এখন? জাহিদ আজকের বাজার ও একজনের কাছ থেকে ধার করে দিয়েছে। আর এখন তিনি কি দিয়ে মেয়েটাকে সম্মান করবেন, চিন্তা করে কুল পাচ্ছেন না। তারা এই অবুঝ মেয়েটা এখনো অনেক কিছুই বুঝেনা। মন টা নরম, সবার কথা ভাবে, কিন্তু এত্তসব জঠিলতা বুঝেনা।

রাহেলা খানম, পলিকে ডেকে বললেন এদিকে আয়,
– কি?
– জলি যে, ননদ নিয়ে এসেছে, এখন কি করি বল?
– আমি কি বলবো মা? মেজ ভাইকে বলো।
– কোন মুখে বলি, আজকের বাজার টা কত্ত কষ্ট করে ধার-দেনা করে এনেছে।
– আমার কাছে কি টাকা থাকে? থাকলে তো দিয়ে দিতাম।
– আমার মাথা কাজ করছেনা, তোদের কি নতুন কোন জামা আছে? যেটা পড়িস নি?
– কি যে বলো মা! আমরা এতো বড়লোক হলাম কবে?
– আচ্ছা যা।

জাহিদ জানার পর, তার এক বন্ধুর কাছ থেকে তিনশো টাকা এনে, মাকে দিয়ে বললো হাতে দিয়ে দিও।

রাহেলা খানমের যেন বুক থেকে বড় পাথর নেমে গেল। যদিও ছেলের এতো ঋণ কেমন শোধ করবে, সেই চিন্তায় অস্থির লাগে। এই ছেলে, সবসময়ই মায়ের মন টা বুঝে। তাছেড়া মেয়ে একদিন এসেছে, খুশি মনেই যাক, কষ্ঠ যখন আছে কপালে, তাতো থাকবেই।

ঈদের পরে ছুটি কাটিয়ে সবাই সবার গন্তব্যে গিয়ে যার যার পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে….

পলি-কলি টাইপিং শেখা শেষ হতেই, অনার্সের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। গতকাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে, এই বছর তাদের ফাইনাল ইয়ার শুরু, এজন্য এখন আর টাইপিং এর কোন চাকরিতে ঢুকছেনা দুই বোন। মন দিয়ে পড়বে, যাতে ভালো রেজাল্ট আসে। যদি চাকরি করতে ইচ্ছে থাকতো তবে, তাদের একটা চাকরীর ব্যবস্থা হয়ে যেতো, যুবায়ের সাহেব করে দিতেন। কিন্তু এখন দুই বোন মনোযোগ দিয়ে পড়ছে।

সকাল বেলা, নাহিদ হলের নিচে এসে উপস্থিত, এসেই দুই বোনকে চমকে দিয়েছে নাহিদ, কারণ সে না জানিয়ে এসেছে। সে একটা দারুন সুখবর নিয়ে এসেছে, জাহিদের সককারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি হয়েছে।

পলি বার বার বলছে, ইশ কি যে ভালো লাগছে নাহিদ কি বলবো! আল্লাহ আমাদের মেজ ভাইকে অনেক বড় করুন।
– এর মধ্যে আমাদের গ্রামের স্কুল। ছোট ভাইয়া কম্পিউটারের দোকানের চাকরি ছেড়ে দিবে ভাবছে। এসে ভাইয়ার লাইব্রেরিতে বসবে, আর নিজেও ভালো করে পড়বে। এখন আমি টিউশনি করি, হলে উঠে গেলে চলতে পারবো।
– আমাদের ও আর এক বছর, পরে ভালো চাকরি করতে পারবো।
– হ্যা আপা। তাই! আম্মার যে ফিজিক্সের স্যার আছেন, যার বাসায় আমি পড়েছি। একটু দেখা করতে চেয়েছিলাম। এখন গেলে স্যার কে বাসায় যাবো। এক বার দেখা করে আসি?
– তুই দুপুরে কোথায় খাওয়া দাওয়া করবি?
– তোরা ডাইনিং অফ রাখিস তিন ভাই-বোন মিলে বিরিয়ানি খাবো। আমাদের ভাইয়ার চাকরি হয়েছে না!
– না না লাগবেনা।
– আরে, আপা আয় তো। কত্ত দিন আনন্দ হয়না! তোরা রেডি হ, আমি স্যারের বাসা থেকে ঘুরে আসি।

নাহিদ প্রফেসর শফিউল আলমের বাসায় গেল, তিনি তাদের কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের হেড। যার কাছে ছাত্ররা লাইন ধরে পড়তে আসে। চমৎকার করে পদার্থ বুঝান তিনি।

নাহিদ কে দেখেই বললেন, আরে নাহিদ কেমন আছ?

নাহিদ পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। ভালো আছি স্যার। আপনি?
– এই যে পোলাপান নিয়ে আছি ভালোই। এই তোমরা আজ চলে যাও, আমার প্রিয় ছাত্রের সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করি।

নাহিদ স্যারের বসারঘরে বসেছে। বেতের এক সেট সোফা আর প্রকান্ড বড় এক সাদাকালো টিভি আছে বসার ঘরে, আর এক সেলফ পদার্থের বই।

তিনি নাহিদের সামনে বসে বললেন, নাহিদ কেমন আছ?
– ভালো আছি স্যার।
– ভার্সিটি কেমন লাগছে।
– ভালো স্যার।
– তোমাকে দেখেই একটা কথা মনে হলো, আগে জিজ্ঞেস করি ফেলি, কারণ এখন অনেক কথাই ভুলে যাই।
– বলুন স্যার।
– তোমার ভাই কৃষি অধদপ্তরে কাজ করতেন?
– জি স্যার। এখনো আছেন।
– বাহ বাহ ভালো। আমার এক ছোট ভাই আছে, নাম যুবায়ের, ভার্সিটি জুনিয়র ছিল। তার বাসা মহিলা কলেজের পাশে। সে আমাকে বললো তার পরিচিত একটা ভালো মেয়ে আছে। মেয়ের ভাই ও নাকি কৃষি অধিদপ্তরে কাজ করে। একটু খবর নিও, তুমি আমার প্রিয় ছাত্র, তাই তোমাকে শেয়ার করলাম।
– জি স্যার।
– মেয়েটি সম্ভবত মহিলা কলেজে অনার্সে পড়ে। এরা দুইবোন এক সাথে পড়ে। আমার মেজ ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজছি সে, সরকারি স্কুলের গণিতের শিক্ষক, নবম-দশম শ্রেণীতে পড়ায়। তার জন্য মেয়ে দেখছি। তা তুমি বাবা, কি খাবে? আমার সকালের খাবার ডাল, আলু ভাজি আর ভাত। সকালে এছাড়া কিছুই আমি খাইনা। বহু দিনের অভ্যাস। একটা ডিম ভাজি করে দিতে বলি?
-জি না স্যার। ভাত আমি এখন খাবো না। সকালে নাশতা করেছি।
– তাহলে এক কাপ চা দিতে বলছি, এটা না করবেনা।
আমার সাত ছেলে দুই মেয়ে। সবাই বড় হয়ে যাচ্ছে। বিয়ে দিতে হবে। তাই একজন একজন করে শুরু করছি। তুমি বাবা আজ সন্ধ্যায় আমাকে খবর জানিও
ছেলে আবার চট্টগ্রাম থাকে, তুমি ভালো বললে, ছেলেকে মেয়ে দেখতে আসার জন্য চিঠি লিখবো।
– জি স্যার, অবশ্যই জানাবো।

নাহিদ যুবায়ের খালুর নাম শুনেই বুঝেছে, এটা পলির জন্য বিয়ের আলাপ। নিজের বোনের কথা কি বলবে সে! তার কাছে তার তিন বোন পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়ে। তাই কি বলবে সেজন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় নিল সে।

প্রফেসর সাহেবের টিন শেডের নিজের বাসা। সামনে বেশ বড় উঠান। ত্রিশ শতকের জায়গার উপর তার বাড়ীটি। বেশ সুন্দর বাড়ী। বাড়ীর বাইরে বড় করে লেখা, “শান্তি নীড়” প্রসেসর শফিউল আলম।

নাহিদ কলেজের দিকে যাচ্ছে, তার বোনেদের নিয়ে বের হবে। আবার ভাবছে, স্যারে কে বিকালে সে কি বলবে, হাঁটছে আর ভাবছে….

চলবে…

আন্নামা চৌধুরী।
২৩.১২.২০২১

About

Annama Chowdhury

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}