রাহেলা খানম মেয়ের চিঠি এই নিয়ে তিন বার পড়লেন, এবং চিঠি হাতে বারান্দার বেঞ্চিতে বসে জাহিদের জন্য অপেক্ষা করছেন। এখন দুপুর বেলা, জাহিদ বাড়ী আসবে!

তিনি এক দৃষ্টিতে দুটি শালিক দেখছেন, তিনি কুংসস্কার বিশ্বাস করেন না, তবে তিনি জোড়া শালিক দেখে ভাবলেন হয়তো সুসংবাদ তার জন্য কিছু অপেক্ষা করছে।

জাহিদের সাইকেলের শব্দে তিনি জাহিদের দিকে ফিরে তাকালেন।

জাহিদ বললো এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছো মা?
– না, বাবা। পলি চিঠি লিখেছে।
– কি? জামাই পছন্দ হয়নি।
– আরে না! সাঈদ ছেলে পছন্দ করেনি, না করতে যাইতে চাচ্চে, এখন পলি ওই ছেলেকেই বিয়ে করতে চায়।
– আলহামদুলিল্লাহ! ছেলে খুব ভালো মা। শুধু টাকা পয়সা কম, কষ্ট করেই চলতে হবে।
– সারা জীবন এই টানাটুনির সংসারের ঘানি ঠেলেছি, এখন মেয়েদের এই ঘানি ঠেলতে দিতে, ভয় লাগে। সাঈদ কে তুই ফোন কপ্রে বল, যেন সে এখানেই বিয়ে ঠিক করে, আমি পাক্কা মত দিয়েছি।
– তাই ভালো। ছেলে ভালো হলে, সুখ এবং শান্তি দুই থাকবে। টাকা একদিন হবেই, সেটা সময়ের অপেক্ষা।
– তাই যেন হয়।

সাঈদ খবর শুনে, খুব বিরক্ত হয়েছে। কারণ এই ছেলের কাছে বিয়ে দিতে তার একদম মন টানছে না। কিন্তু যেহেতু মা নিজে হুকুম দিয়েছেন, তাই সাঈদ শফিউল আলম সাহেব কে কল করে জানিয়ে দিয়েছে, তাদের কোন আপত্তি নেই। মেয়ের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলেই, বিয়ে হবে।

পলি এই খবর শুনে, খুব শান্তি পেয়েছে। যাক, একজন সৎ মানুষের সাথে বিয়ে হবে।

দুই মাস পরে, আবিদ ছুটিতে এসে, মহিলা কলেজের সামনে হাঁটাহাঁটি করছে, এক নজর পলিকে দেখবে বলে। কিন্তু পলির দেখা মিলছে না। কারণ আজ পলি ক্লাসেই আসেনি, রাত থেকে তার জ্বর। কলিও বোনের কাছে কাছে থাকছে। এখন কলি একটু নাপা কিনতে হলের বাইরে যাবে, এজন্য বের হবে।

আবিদ প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে কলেজের গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি, বাদাম, খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পলির দেখা পাচ্ছেনা!

হঠাৎ কলিকে দেখে আবিদ হাতে চানাচুর নিয়েই দৌড়ে সামনে এলো, কিন্তু এভাবে দ্রুত পায়ে এসে, নিজেই লজ্জা পেয়ে গেল।

আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া, কেমন আছেন?
– জি ভালো, আপনি?
– ভালো আছি। এদিকে কি মনে করে।
– আমি, এদিকে বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।
– তা, বন্ধু কি মহিলা কলেজে পড়ে?
– হ্যা, না না। ও মহিলা কলেজে পড়বে কেন?
– না, কলেজের মামার চানাচুর খাচ্ছেন, তাই ভাবলাম।
– এমনি, এমনি নিয়েছি।

কলি নিজে ভিতরে, ভিতরে হাসছে, বেচারা বউকে দেখতে এসেছে, তাও লজ্জায় বলতে পারছেনা।

আপনি চানাচুর খাবেন?
– আপনি আপনি করছেন কেন? তুনি বলুন।
– হ্যা, তাই। তুমি খাবে?
– না, আমি খাবো না। বউয়ের কথা জিজ্ঞেস করবেন না?
– হ্যা?
– বলছি, আপনার হবু বউ, মানে আমার আপার, কথা কিচ্ছু জিজ্ঞেস করবেন না?
– কেমন আছে সে?
– ভালো নেই, অসুস্থ। রাত থেকে জ্বর।
– এখন কি অবস্থা?
– ঔষুধ কিনতে যাচ্ছি।
– আমি আসি সাথে?
– জি অবশ্যই।

আবিদ পলির জন্য এক কেজী মালটা, কমলা লেবু ,আঙ্গুর, স্যালাইন, ঔষুধ কনে দিয়েছে। কলি অনেক না করার পরেও!

যাওয়ার সময় বললো, তোমার আপার যত্ন নিও, আমি আজই রওনা হবো। দুদিনের ছুটিতে এসেছিলাম। আমার ঠিকানা দিয়ে দিলাম, পলিকে দিয়ে দিও। আজ আসি!

কলির খুব ভালো লাগছে, এই মানুষটির ভালবাসা দেখে, সে সত্যি আপা কে ভালবেসে ফেলেছে। এজন্য পলিকে এক নজর দেখার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল, আবার ফল ও কিনে দিয়েছে, অসুস্থ শুনেই মন ভার করে ছিল।

পলি এতো ফল দেখে বললো কি রে, এতো সব কি দিয়ে আনলি? টাকা নিল ত্রিশ টাকা।
– দুলাভাই দিয়েছে।
– জলিপার দুলাভাই? কিভাবে আসলো?
– আপনার জামাই, মিস্টার আবিদ।

পলি জামাই শব্দ টা শুনেও বেশ লজ্জা পেয়ে চমকে উঠেছে, গাল দুটি লাল হয়ে আছে।

কেন উনি এসব দিলেন?
– উনি তো প্রায় কেঁদেই দিচ্ছিলেন, তুই অসুখ শুনে।
– ফাইজলামি করবি না তো!
– এই নে, ঠিকানা, পত্র লিখতে বলেছে।
– নিজে লিখে নিয়ে এসেছিস! ফাজিল মেয়ে।

আমার লেখা কি এতো গুটি গুটি করে হয়, দেখো ভালো করে।

ছোট্ট চিরকুট,

আবিদুল আলম আবিদ, আগ্রাবাদ, নুর ম্যানশন, ৩য় তলা, চট্টগ্রাম।

পলির লেখা টা অনেক বার পড়তে ইচ্ছে করছে, আবার রাগ ও লাগছে, কেন সে তাকেই প্রথমে চিঠি লিখতে বললো, নিজেই আগে একটা চিঠি দিত!

শফিউল আলম বিয়ের তিন মাস আগে, রাহেলা খানম কে চিঠি লিখলেন।

আপা,
আসসালামু আলাইকুম, আমি আবিদের আব্বা। আল্লাহর ইচ্ছায় ভালো আছেন। সব ঠিকঠাক থাকলে, আগামী তিন মাসের মধ্যে আমার পুত্রবধূকে আমি ঘরে নিব। কন্যার পিতা-মাতার চিন্তা বেশি, কন্যাকে নিয়ে। কন্যা কে বিদায় দেওয়া অনেক বেদনার। আমার দুই কন্যা আছে, এদের বিবাহের কথা মাথায় আসলে, আমি চোখে অন্ধকার দেখি, আবার ভাবী, দুই কন্যা দিয়ে সাত কন্যা ঘরে আনবো। আমার একটা বিশেষ অনুরোধের কথা জানানোর জন্য চিঠি দিলাম।
আমি আমার ছেলেদের বিয়ে দেওয়ার আগেই তাদের রুম বানিয়ে দেই, আবিদের রুমের রঙের কাজ চলছে এখন, আমার বাড়ীর কাঁঠাল গাছ কেটে বউমার জন্য একটা খাট, ড্রেসিং টেবিল, আর কাপড় রাখার জন্য একটা আলমারী বানানো চলছে, ইনশাআল্লাহ বিবাহের আগে সব বানানো শেষ হবে।

দয়া করে, কোন প্রকাশ আসবাবপত্র দিয়ে আমাকে ছোট করবেন না। আমি আপনার মেয়ে আমার ঘরে নিব,তাই আমার সৌভাগ্য! আপনি মাত্র ত্রিশ জনের খাবার আয়োজন করবেন, আমি বিয়ের পরের ফিন, আমার বাড়ীতে প্যান্ডেল করে ওয়ালিমা করবো, আপনার সব আত্নীয় নিয়ে আসলে খুশি হবো। আমার জন্য দোয়া রাখবেন, আর আমার মেজ পুত্র আবিদের জন্য দোয়া রাখবেন। বাড়ীর বড়দের সালাম, আর ছোটদের জন্য স্নেহ রইলো। আজ এই পর্যন্ত, ভালো থাকুন।

ইতি,
আপনার ভাই,
প্রফেসর শফিউল আলম।

রাহেলা খানম চিঠি পড়ে খুশিতে কাঁদছেন, এতে ভালো একজন পিতার সন্তানের সাথে তার মেয়ের বিয়ে হবে, যিনি মেয়েদের এতো সম্মান করেন, ভালোবাসেন। রাহেলা খানম চিঠি বন্ধ করে চিন্তা করছেন, মেয়েকে তিনি তাহলে কি উপহার দিয়ে শ্বশুড় বাড়ী পাঠাবেন! সময় আর বেশি নেই, চিন্তা লাগছে, কি করবেন তিনি মেয়ের খুশির জন্য, আর তো তিনি চাইলেও বিবাহিত মেয়েকে বেশি কিছু দিতে পারবেন না। এখনই যা দেওয়ার দিতে হবে, কি দিবেন এই চিন্তায়ই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে….

চলবে…

আন্নামা চৌধুরী।
০২.০১.২০২২

About

Annama Chowdhury

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}