শফিউল আলম সাহেব খাওয়ার টেবিলে বসেছেন, ডাল ভাত ভর্তা ভালো করে একসাথে মেখে, খাচ্ছেন। পলি পাশে বসে আছে।

বউমা!
– জি।
– নিয়াজ কে বলেছি, তোমাকে চট্টগ্রাম দিয়ে আসতে। নিয়াজের এখন ভার্সিটিতে ক্লাস নাই। কয়েকদিন থেকে আসো। পরে, তোমার মাস্টার্সের ক্লাস আরম্ভ হয়ে গেলে, আর যেতে পারবেনা।
– ও তো মেসে থাকে।
– সে ব্যবস্থা করে নিবে। তুমি কাল নিয়াজ কে নিয়ে রওনা হও। ওর স্কুলে চলে গেলে, ওকে পেয়ে যাবে। আমি স্কুলের ল্যান্ড লাইনে আজ কলেজে গিয়ে কল দিব। বাসার ফোন টা কেন যে এতো ডিস্টার্ব করে! লাইন ঠিক করলেও বার বার নষ্ট হয়, নয়তো বাসা থেকেই কল দিতাম।
– আব্বা কালই যাবো?
– হ্যা কালই যাও। কিছু বাজার সদাই সাথে নিয়ে যাও।
– জি আব্বা।

পলি শ্বশুরের সাথে আর কিছুই কথা হয়নি, তিনি মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছেন। আর কথা না বললেও পলির মনের ভিতরে বেশ খুশি লাগছে। শ্বশুরের খাওয়ার পরে, পলি প্লেট হাতে রান্নাঘরের বেসিনে প্লেট রাখলো।

শ্বাশুড়ি মুচকি হেসে বললেন কি গো এখন খুশি?

পলির বেশ লজ্জা লাগছে। সত্যি সে ভীষণ খুশি।

গতকাল বললাম, আবিদের আব্বাকে তোমাকে পাঠাতে। মাস খানেক থেকে আসবে। মন ভালো করে এসে পড়তে বসো। আর আমার ছেলেটা একা একা থাকে, আমার ও মন পুড়ে, কি খায় না খায়। তুমি গেলে একটু যত্ন পাবে। আমি সব কিছু বাজার হালকা দিয়ে দিচ্ছি, সপ্তাহ খানেক খেতে পারবে।
– লাগবেনা আম্মা।
– লাগবে, আমার ছেলেটার আর কত টাকা ইনকাম বলো, তুমি যাচ্ছ কত জিনিস কিনতে হবে।
– আম্মা, আপনিও চলেন।
– সাত বউ ঘরে এনে, বুড়া বুড়ির ছুটি হবে। আপাতত ছুটি নাই মা। যাও, ব্যাগ গুছিয়ে নাও।
– জি।

পলির আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছে, আবিদ আজ ফোন পেয়ে, হয়তো না করেই দিবে, যাওয়র দরকার নাই। সে একটু বেশি পন্ডিত, সারাক্ষণ ভাবে, তার কাছে গেলেই বুঝি মা-বাবা অসন্তোষ হবেন। তার সব প্রেম দেখায়, চিঠির পাতায়! এতো কিছু চিন্তার মাঝেও এটা ভেবে ভালো লাগছে, কাল সে আবিদের কাছে যাচ্ছে….

বিকেল বেলা, সাঈদ বড় এক ফ্রিজ নিয়ে বাসায় এসে উপস্থিত। রাহেলা বেগম দেখে চমকে গেলেন। কলি দাঁড়িয়ে হা করে দেখছে।

দুই জন লোক ধরাধরি করে রাখলো। সাঈদ তাদের টাকা দিয়ে বিছানায় বসলেন।

কলি বললো ভাইজান, এতো বড় ফ্রিজ!
– হ্যা। এখন একটু আরামে থাকতে পারবি।
– এটা কি নতুন?
– ফ্রিজ, নতুন পুরাতন দিয়ে কি করবি?

রাহেলা বেগম বললেন বাবা কেন এই টাকা নষ্ট করলে? ফ্রিজ দিয়ে আমরা কি করবো?
– আহা! থাকুক সমস্যা নাই। এটা আমার এক বন্ধুর দোকান থেকে এনেছি। এক বড়লোক বিক্রি করে নতুন ফ্রিজ নিয়েছে। নাহিদ আসলে চালু করবে! এখন এভাবেই থাক। মা, আমি এখন যাই।
– একটু লেবুর শরবত দেই, অফিস থেকে এসেছিস।
– না না। এই বাসায় প্রচন্ড গরম। নিচের দিকে বাসা দেখো। এখন আসি। সময় নেই।

সাঈদ যাওয়ার পর পরই বাড়ীওয়ালা চাচা আসলেন। ফিজ দেখে বললেন, ভাবী সাহেবা আপনার রাজ কপাল দেখি! এতো বড় ফ্রিজ? সেকেন্ড হ্যান্ড লাগছে, দেখে। কিন্তু কত বড় ফ্রিজ!

আপনাকে আর এই ছাদে মানায় না, দুই তলার ফ্ল্যাট আগামী মাসে খালি হবে, এটায় উঠে পড়ুন। ভাড়া সামান্য বেশি, এই আর কি!
– ভাই এখানেই হয়ে যায়, বাচ্চাগুলো পড়াশোনা করুক।
– আপনি এতো বড় অফিসারের মা, আপনাকে এইখানে মানায় না!
– সময় আসুক ভাই দেখি।

কলি বললো ব্যাপার কি মা? ভাইজান হঠাৎ ফ্রিজ নিয়ে আসলেন? খুলে দেখবো নাকি?
– না, নাহিদ আসুক। এতো কথা বলিস কেন? ভালো করলেও তোরা দোষ ধরিস।

নাহিদের রবিবারে একটু দেরী হয়ে আসতে, তিন টা টিউশনি থাকে সন্ধ্যার পরে। শাহিদ বাসায় এসে বলছে, মা এই আলমারি কখন আনলে?
– এটা ফ্রিজ। কি বলছিস আলমারি?
– তাই নাকি? দেখি!
– হাত দিবি না, নাহিদ আসুক, ও কানেকশন দিবে।
– কবে কিনলে মা? মেজ ভাই এনেছে নাকি?
– সাঈদ কিনে দিয়েছে।
– সত্যি?
– হ্যা।
– সত্যি?
– একবার বলেছি না? আমি কি মিথ্যা বলি। এই যা, মুখ হাত ধুয়ে নে, আর ফ্রিজ ধরবিনা।

শাহিদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আটটা বাজে, নাহিদের আসতে আসতে এগারো টা হবে। ততক্ষণ এই জিনিস না দেখেই থাকতে হবে, হাত দিল্রি মা চিৎকার করে উঠবেন।

দশমিনিট পরে, তিন তলার এক মধ্যেবয়েসী মহিলা দরজায় নক করলেন।

নাহিদ খুলতেই বললেন, বাসায় মহিলা কেউ নেই?
– জি আছেন। আমি তিন তলায় থাকি, সুহেলের আম্মু।
– আসুন, ভিতরে আসুন।

রাহেলা বেগম কে দেখে বললেন আসসালামু আলাইকুম আপা, আমি তিন তলায় থাকি।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। বসুন আপা।
– বিকালে দেখলাম, এক ভদ্রলোক ফ্রিজ নিয়ে উপরে উঠছেন। আমরা তো ভেবেছি এখানে ব্যাচেলর থাকে, তাই আসিনি।
– ওহ। ভালো আছেন?
– আছি। আপনার ফ্রিজের কালার সুন্দর হয়েছে অনেক।

ছেলে মেয়ে কয়জন, কে কিসে পড়ে সব খবর নিলেন এই মহিলা। অনেকক্ষণ গল্প করে বললেন, আপা, আমার মামাতো ভাইয়ের ছেলে চকবাজারে ব্যবসা করে, মিরপুরে নিজেদের বাড়ী। ছেলে দেখতে সুন্দর, ডিগ্রি পাশ। আপনার এই মেয়ে কে কি বিয়ে দিবেন?
– আপা, মেয়ে মাস্টার্স পড়ছে, পড়া শেষ করুক। আর ছেলেদের সাথে আলাপ করি।
– সমস্যা নাই, জানাবেন। আমাদের ও ফিজ আছে, তবে অনেক ছোট। ভালো হয়েছে, আমার সাহেব বাজার বেশি আনলে আপনাকে এসে ডিস্টার্ব করবো।
– কোন সমস্যা নাই, আসবেন।
– আপনার ছেলের রুচি ভালো এই জলপাই রঙ আমার ও খুব পছন্দ। আসি!

মহিলা যেতেই শাহিদ বললো কিরে কলিপা ফ্রিজ দেখে তোর বিয়ের প্রস্তাব চলে এসেছে। বুঝ, এক ফ্রিজে তোর কদর কত বাড়লো।
– চুপ থাক। কে বিয়ে করছে চক বাজারেএ ব্যবসায়ী কে!
– আলাপ তো আসলো, তোকে দেখে নয়, এই ফ্রিজ দেখে।
– চুপ থাক।

রাতে নাহিদ এসে একদম থ হয়ে তাকিয়ে দেখছে, ২৯০ লিটারের ফ্রিজ! বাবারে! এতো বড়!
– তুই এখন কানেকশন দে, আমার তোর অপেক্ষায় আছি।
– সত্যি কি ভাইজান দিয়েছে?
– এই কথা কম বলে, কাজ কর।

নাহিদ ফ্রিজ খুলতেই এমন বিশ্রি একটা গন্ধ নাকে লাগছে, মনে হচ্ছে বিড়াল পচে মরে ছিল! অনেক চেষ্টা করেও কোন ভাবেই ফ্রিজের কানেকশন হয়নি। ফ্রিজ খুললেই সবার বমি চলে আসছে, এমন বাজে গন্ধ!

নাহিদ রাগে গজগজ করছে, কে বলেছো ফ্রিজের কথা? এই বাসায় কার ফ্রিজ লাগবে?
– কে বলবে?
– তবে কেন এই নষ্ট ফ্রিজ বাসায় আসলো? এতো বিশ্রি গন্ধ, নাক মুখ বেঁধেও বমি আসছে।
– হয়তো বন্ধ ছিল, অনেকদিন। এজন্য!
– মা, এটা নষ্ট ফ্রিজ। ভাইজানের এক বন্ধুর ফ্রিজ ঠিক করার দোকান আছে, আমি জানি। ভাইজান সেখান থেকে এই শো পিস এনেছে, আমি শিওর।
– থাক, দেখি সাঈদ কি বলে।
– এই জিনিস শো পিস হিসাবে রাখতে পার মা। আর কিছুই না!

রাহেলা বেগমের এখন সত্যি রাগ লাগছে, কি দরকার এই জিনিস কেনার? এখন নষ্ট কি ভালো কে জানে? সত্যি যদি নষ্ট জিনিস সাঈদ আনে, তবে তিনি তাকে এবার ভালো করে বকে দিবেন, এই চিন্তা করলেন। আবার ভাবলেন, হয়তো ফ্রিজ ভালো, কিন্তু নাহিদ ই কানেকশন দিতে পারছে না। তিনি কাল ছেলের অফিসে কল দিয়ে জানাবেন, বাড়ীওয়ালার বাড়ী থেকে এই ভেবে রাখলেন।

শাহিদ বললো এই নাহিদ ফিজ দেখে, তিন তলার আন্টি কলিপার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এনেছে।
– এজন্য তো বললাম শো পিস, মানুষ দেখবে আর বলবে আহা! কত হড় ফিজ, ছেলের হ্রদয় না জানি কত বড়!

পলির রাতে এক ফোটাও ঘুম হচ্ছেনা। কাল সে চট্টগ্রাম যাবে, নিয়াজ চুপচাপ থাকে, খুবই লাজুক ছেলে। তার সাথে এতো লম্বা জার্নি খারাপ হবেনা, শুধু মুখ বন্ধ করে রাখতে হবে এই আর কি! আপাতত আবিদের কাছে ত্রিশ দিন থাকা যাবে, তাই শান্তি। শফিউল আলম সাহেবের আজ ফোন দেওয়ার কথা, ভুলে গিয়েছিলেন, এটা ভালোই হয়েছে, নয়তো আবিদ নিষেধ করতো হয়তো। কাল যখন জানবে, তখন তারা ট্রেনে থাকবে! শুনে কি করবে, আর দেখে কি করবে, তাই ভাবছে পলি! ঘুম একদম আসছেনা…..

চলবে…

আন্নামা চৌধুরী।
০৪.০২.২০২২

About

Annama Chowdhury

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}