ধীরে ধীরে সূর্য টা পুরো পুরি পুব আকাশে উঁকি মারলো।স্নিগ্ধ সকালের রূপ দেখে মৃন্ময়ী মুগ্ধ হয়ে গেল।কত বছর হয়ে গেল সে এরকম একটা সকাল দেখেনি।আর মাত্র তিন চার ঘন্টা বাকি আছে।এরপর জাহাজ থেকে নেমে বাসে করে কিংবা কোন গাড়ি ভাড়া করে যেতে হবে আরও ঘন্টা দুয়েক।তারপর কিসে করে বাড়ি অব্দি যাবে মৃন্ময়ী জানে না।কারণ পঁচিশ বছরে অনেক কিছু পাল্টে গেছে। বাড়িতে মৃন্ময়ী কে হয়তো কেউ চিনতে ও পারবে না। কি বলে পরিচয় দেবে এখনো ভাবতে পারছে না।ভাললাগা ভয় দুটোই পাশাপাশি মৃন্ময়ী কে ব্যাতিবস্ত করছে।চিন্তার মাঝে দরজায় নকের শব্দ শুনে আবার বাস্তবে ফিরে আসল।এর মধ্যেই মৃন্ময়ী ফ্রেশ হয়ে গিয়েছিল।দরজা খুলে দেখল নাস্তা নিয়ে এসেছে। মৃন্ময়ী বয় কে নাস্তা ভিতরে রেখে দিতে বলে আবার ডোর বন্ধ করে দিল।যদিও খাওয়ার রুচি নেই তবুও কিছু একটা খেতে হবে বলে সামান্য কিছু খেয়ে বাকিটা রেখে দিল।তবে কফিটা আরাম করে খেল অনেক ক্ষন ধরে।মনে মনে কফির প্রশংসা করল।মৃন্ময়ীর ইদানীং এই একটা জিনিসের উপর ভালো লাগা সৃষ্টি হয়েছে। প্রাণ ভরে দিনে দুবার কফি খাওয়া। তাই কফিটা সে তৃপ্তির সাথেই খেল। কফিটা ভালোই বানিয়েছে।এই কফি আবার জাহাজের সব প্যাসেঞ্জার কে দেয় না।কফি খেয়ে মৃন্ময়ী আবার ডুব দিল পুরানো স্মৃতি তে।

সেদিনের কথা মনে পড়লে মৃন্ময়ী এখনো শিহরণ অনুভব করে।কারণ তার ধর্মপিতা অর্থাৎ গার্মেন্টস মালিক সবচেয়ে নামকরা হোটেলে এক পাটি দেওয়ার আয়োজন করেছিল,অসুখ সেরে যাওয়ার প্রায় ছয় মাস পরে।সবার মধ্যেই কানা ঘুষা চলতে লাগলো কি ব্যাপার কি হতে যাচ্ছে।মালিক কি তার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি দান করে কিংবা বিক্রি করে দিয়ে নিজের দেশে ফেরত যাবেন নাকি অন্য কিছু।মালিক ছিল বিদেশি ক্রোয়েশিয়ান। বাংলাদেশি মেয়ে বিয়ে করে বাংলাদেশ কে ভালবেসে সে চল্লিশ বছর ধরে বাংলাদেশে বাস করছে। তাই সবাই ভয় পাচ্ছে এবার বুঝি তাদের চাকরি টা গেল। এরমধ্যে আবার মালিকের বোনের ছেলে ক্রোয়েশিয়া থেকে এসে মামার সাথে আছে দশ পনের দিন হতে চলল।

অবশেষে অতিথি সাংবাদিক অফিস স্টাফ এ যখন হোটেলের হল রুমটা গমগম করছে সবার কথোপকথনে তখন মাইকে এনাউন্স আসল সাইলেন্ট প্লিজ।মুহুর্তে হল রুমটার মধ্যে পিন পতন নীরবতা দেখা গেল।আজ মৃন্ময়ী বেশ সুন্দর করে সেজেছে পিতার অনুরোধে। সাধারণত মৃন্ময়ী সাজগোছ তেমন একটা করেনা।এমনিতেই অনেক সুন্দর। হালকা একজোড়া কানের দূর হাতে কালো ঘড়ি এবং ছোট্ট একটা গলায় চেইন পড়ে থাকে।চেইনের সাথে ছোট্ট একটা লকেট শোভা পায়।এই ছিল মৃন্ময়ীর সাজ।কিন্তু আজ বেশ গর্জিয়াস ভাবে সেজে হলরুমে প্রবেশ করেছে। অতিথি রা মৃন্ময়ীর সৌন্দর্য্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে।কিন্তু মৃন্ময়ীর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।পিতার অনুষ্ঠান যেন সফল হয় সে সেগুলো নিজ হাতে তদারকি করতে ব্যস্ত।সে জানে না তার ধর্মপিতা কেন এতবড় আয়োজনের ব্যাবস্থা করেছে।জিজ্ঞেস ও করেনি।কারণ মৃন্ময়ী শান্ত শৃষ্ট আত্ম্যপ্রত্যয়ী মেয়ে।

অবশেষে পিনপতন শব্দের অবসান ঘটিয়ে মৃন্ময়ীর ধর্মপিতা মিঃ ক্যালভিন নিজের সম্পর্কে কিছু বলে সরাসরি ঘোষণা দিলেন ‘আজ থেকে তার সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবে মিস মৃন্ময়ী মিত্র। এই ঘোষণা করে মিঃক্যালভিন সমস্ত দলিল পত্র মৃন্ময়ীর হাতে তুলে দিয়ে নিজে সমস্ত দায় দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন বলে ঘোষণা দিলেন।ক্যালভিনের ঘোষণা শুনে ভাগ্নে রাগান্বিত হয়ে হল রুম থেকে বের হয়ে গেল।কারণ সে আশা করে আসছিল মামা তাকেই সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে দেবে।মৃন্ময়ী এই ঘোষণা শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না।সবার সামনে ধর্মপিতা কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল।এ তো সম্পত্তি পাওয়া নয় এক বিদেশির শ্রদ্ধা, ভালবাসা বিশ্বাস পাওয়া।

সেদিনের পর থেকে মৃন্ময়ীকে আর পিছন ফিরে অজানা ভয়ে দিন কাটাতে হয়নি।তিন চারবছরেই সেই গার্মেন্টস দেশের সেরা গার্মেন্টস এর খাতায় নাম লিখাল।গার্মেন্টস শিল্পের পাশাপাশি মৃন্ময়ী অসহায় মেয়েরা যাতে দুটো রোজগার করে নিজের পরিবার পরিজন নিয়ে ভালো ভাবে চলতে পারে তার জন্য সে কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যাবসার উদ্ভব করল।আজ তার বিভিন্ন ফ্যাক্টরি তে প্রায় লাখ খানেক মেয়ে সম্মানের সাথে চাকরি করে। পাশাপাশি ছেলেদের জন্য ও মৃন্ময়ী আলাদা ফ্যাক্টরির ব্যাবস্থা করে দেশের এবং জনগণের সেবা করে যাচ্ছিল নিঃস্বার্থ ভাবে।

দুদিন আগে তাই ম্যাগাজিন হাতে পেয়ে মৃন্ময়ী মিত্র দেশের সেরা গার্মেন্টস শিল্প হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এবং সেরা করদাতা হিসেবে নাম ঘোষণা করার সুপারিশ দেখার পর যখন মিনিস্ট্রি লেভেল থেকে সরাসরি মৃন্ময়ী মিত্র কে সেরা শিল্পপতি খেতাব দিয়ে সম্মানিত করতে চাওয়ার অনুমতি চাইল তখন মৃন্ময়ী আর একবার বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল।এরপরই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল এবার সে গ্রামে যাবে।যদি মা বাবা বেঁচে থাকে সাথে করে নিয়ে আসবে ঢাকায়। পদক টা সে তার মা বাবার হাতেই তুলে দেবে।

সময় বয়ে যায় কালের স্রোতে। শত ঝড়-ঝঞ্ঝার মোকাবিলা করে মৃন্ময়ী আজ নিজেকে সম্মানিত এক স্টেজে নিজেকে দাঁড় করাতে পেরে পঁচিশ বছর আগে ঘর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কে যৌক্তিক মনে করল।
নানা কথা চিন্তা করতে করতে অবশেষে জাহাজ ঘাটে ভিড়ল।এবার মৃন্ময়ী নিজের মনকে আবার ও একবার ভালোভাবে ঘোচাতে শুরু করল।

জাহাজ থেকে নেমে ধীর পায়ে যখন সামনের দিকে চলা শুরু করল সে সময় চেকার মিজানের সাথে দেখা হয়ে গেল।মিজান কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করে ফেলল মৃন্ময়ী কোথায় যাবে? মিজান কে মৃন্ময়ী নিজের গ্রামের নাম বলার সাথে সাথে বিগলিত চিত্তে মিজান জানালো তার পাশের গ্রামেই তার নিবাস, এবং সে ও ছুটি নিয়ে আজ গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে। মৃন্ময়ী মনে মনে খুশি হয়ে গেল।কিছুটা পথ সে মিজান কে সাথে নিয়ে যেতে পারবে। মৃন্ময়ী কে চুপচাপ দেখে মিজানই বলে উঠলো ম্যাডাম আমি কি আপনার সাথে যেতে পারি।মৃন্ময়ী সানন্দে রাজি হয়ে গেল।কারণ সে মিজান কে এই কথাটাই বলতে চাচ্ছিল।

এরপর মৃন্ময়ী কে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য আর কিছু ভাবতে হয়নি।মিজানই সব বন্দোবস্ত করে মৃন্ময়ী কে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।

চলবে…

About

Smaranika Chowdhury

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}