দীর্ঘ তিন ঘন্টা ভাড়া গাড়িটা চলার পর অবশেষে মৃন্ময়ীর গ্রামের মাটিতে পৌঁছে মৃন্ময়ী কে যখন কোনদিকে যাবে জিজ্ঞেস করল ড্রাইভার তখন মৃন্ময়ী নিজের মধ্যে ছিল না।সে ক্রমাগত ভাবছিল কি হবে কিভাবে সকলে তাকে দেখে কি আচরণ করবে।ড্রাইভার বুঝতে পারল মৃন্ময়ী ড্রাইভার এর কথা শুনতে পায় নায়। ড্রাইভার এবার একটু জোরে যখন কোনদিকে যাবে জিজ্ঞেস করল মৃন্ময়ী প্রকৃতস্ত হয়ে লজ্জা পেয়ে গেল।কারণ সে নিজে ও পথঘাট কিছুই চিনতে পারছে না। এত সময় ধরে চেকার মিজান মৃন্ময়ী যে চিন্তিত মনে বসে ছিল তা খেয়াল করছিল।

তাই সে তাড়াতাড়ি বলে উঠলো ম্যাডাম আমাকে বলুন কোন পাড়ায় কার বাড়িতে যাবেন। আমি ব্যাবস্থা করছি। মৃন্ময়ী মিজান কে মৃন্ময়ীর বাবা ভাই এবং কোন পাড়া বলে চুপ করে বসে রইল।আসলে যতই বাড়ির কাছে যাচ্ছিল মৃন্ময়ী ততই মনের সাথে যুদ্ধ করে সাহস সঞ্চয় করছিল।

চেকার মিজানই জিজ্ঞেস করে করে অবশেষে মৃন্ময়ীর বাড়ির সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করাল।

পাশাপাশি কয়েকটি ঘর দেখে মৃন্ময়ী বুজে উঠতে পারছিল না কোন বাড়িটাতে মা বাবা ভাই বোন থাকে।

তখন দুপুর গড়িয়ে দুটো তিনটা বাজছিল।মৃন্ময়ী কতক্ষন যে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছিল মনে নেই। হঠাৎ মিজানের ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে কিছুটা লজ্জিত স্বরে বলে উঠল বুঝতে পারছি না কোনটা আমার বাড়ি।

মিজানকে কিছু বলতে হয়নি।কারণ এমন সময় সামনের এক বাড়ি থেকে পনের ষোলো বছরের যে মেয়েটিকে বের হয়ে আসতে দেখল সে অবিকল দেখতে মৃন্ময়ীর মতো। যে বয়সে মৃন্ময়ী বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল।

মেয়েটি ও মৃন্ময়ী কে দেখতে পেয়ে এবং বাড়ির উঠোনে গাড়ি দেখতে পেয়ে সামনে এগিয়ে আসল কিছুটা। বিশ পঁচিশ কদম সামনে এগিয়ে এসে পিছন ফিরে একটা চিৎকার দিয়ে দৌড় দিল।কারণ সে তার প্রতিচ্ছবি সামনে দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মৃন্ময়ী এক কদম ও সামনে এগোতে পারলো না।কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছে তার সমস্ত কর্মশক্তি। যে মৃন্ময়ী দু চারটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি নানাপ্রকার মানুষ জনকে সামলিয়ে দিন পার করে সে এই মুহুর্তে যেন অন্য এক মৃন্ময়ী।

মেয়েটি ভিতর বাড়ি দৌড় লাগানোর পরে আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়নি। একে একে সবাই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসছিল কি ব্যাপার।

সবার লাস্টে মৃন্ময়ী লাঠি ধরে তার বাবাকে আসতে দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। দৌড়ে গিয়ে বাবার পায়ে উপুড় হয়ে পড়ে ক্ষমা চাইতে লাগল। ভাইয়ের বউরা মৃন্ময়ীকে চিনে না। শুধু এর নামে নানা রটনা শুনেছিল।তাই তিন ভাইয়ের বউ মৃন্ময়ী কে দেখতে পেয়ে কিছুটা বিরক্ত প্রকাশ করতে গিয়ে আবার সামলে নিল।কারণ মৃন্ময়ীর বেশ ভুষায় একটা আভিজাত্যের ছাপ ছিল।ভাইরা ও এতদিন পরে বোনকে দেখতে পেয়ে সমস্ত রাগ অভিমান ভুলে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে সংকোচে আবার পিছিয়ে গেল।কারণ ভাইরা মোটামুটি ভাবে সংসার চালায়।তাদের কাপড়ে চোপড়ে দারিদ্র্যতার ছাপ রয়ে আছে।

মৃন্ময়ীর কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই।নিজেই দু ভাইকে চিনতে পেরে জড়িয়ে ধরল।আর এক ভাই ছোট ছিল বলে তাকে চিনতে পারল না।

মৃন্ময়ী কে দেখার জন্য আসে পাশে ক্রমশ লোক জড়ো হতে লাগলো। সবার মাঝে মৃন্ময়ী মাকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞাসু নেত্রে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে কয়েক বছর আগে মা বিনাচিকিৎসায় মারা গেছে শুনে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল।

ড্রাইভার আর চেকার মিজান এতক্ষন হতম্ভব হয়ে সব কিছু নিরীক্ষণ করছিল চুপচাপ। তাছাড়া ভাড়া ও বাকি আছে।মৃন্ময়ী ও ভুলে গেছে ভাড়া দিতে। এদিকে প্রায় বিকেল হয়ে যাচ্ছিল।উঠোনের মধ্যেই এতক্ষন ভাই বোন বাবার সাথে মিলনের মাঝে ভুলে গিয়েছিল মৃন্ময়ী সব কিছু।অকস্মাৎ মনে পড়ায় ড্রাইভার কে ভাড়ার চাইতে দেড়গুন টাকা বেশি দিল।আর চেকার মিজান কে অনেক অনেক ধন্যবাদ দিয়ে তাকে ও জোর করে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে বাচ্চাদের জন্য ফলমূল কিনে নিয়ে যেতে বলল।

বোনের এত উন্নতি দেখে ভাইয়ের বউরাই মৃন্ময়ী কে খুশির সাথে ঘরে নিয়ে গেল।

সারা গ্রামে রটে গেল মৃন্ময়ী মস্ত বড়লোক হয়ে গ্রামে ফিরে এসেছে।

আজ সেই মৃন্ময়ীর জন্য এক ইতিহাস গড়ার দিন।স্বপ্নের মতো।যে মেয়ে জীবনে বড় হওয়ার জন্য পরিবারের ভালবাসাকে উপেক্ষা করে সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে পালিয়ে রাজধানীর বুকে একটু ঠাঁই পাওয়ার জন্য নিজের জীবনকে বিপদের মাঝে নিক্ষেপ করেছিল সেই মৃন্ময়ী কিনা এত বড় রাজনৈতিক প্লাটফর্মে সেরা শিল্পপতির পদক নিতে এসেছে পরিবার সমেত।আর সেই পদক কিনা মৃন্ময়ীর হাতে তুলে দিবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ।মৃন্ময়ী যত ভাবে ততই নানা স্মৃতির ভান্ডার একে একে মনের দরজায় এসে জানান দেয় সত্যিকারের স্বপ্ন দেখতে চাইলে এবং সে স্বপ্ন পূরণের জন্য যদি কঠোর অধ্যাবসায় থাকে তবে সৃষ্টিকর্তা কাউকে নারাজ করে না।আজ তাই তো মৃন্ময়ীর জীবনে প্রতিস্টিত হওয়ার স্বপ্ন জয় লাভ করেছে।বঙ্গবন্ধু আর্ন্তজাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয়ভাবে পদক অনুস্টানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।মৃন্ময়ী নানা অনুস্টানে আগেও এই হলে যোগদানের জন্য এসেছে নানা মিটিং এ কিন্তু আজকের আয়োজন সম্পুর্ন অন্য একপ্রকার ভালো লাগা সৃষ্টি করেছে।আজ যে তার পাশে তার পুরো পরিবার সাথে আছে।বাবা বুড়ো হলেও বাবার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে বাবাকে গ্রাম থেকে রাজধানীতে আনার ব্যাবস্থা করেছে।মৃন্ময়ীর দু পাশে আজ দু পিতা বসে আছে।একজন জন্মদাতা পিতা আর একজন মৃন্ময়ী কে নতুন জীবন দানকারী ধর্মপিতা। মৃন্ময়ী আবেগে দু পিতার হাত ধরে বসে আছে। আজ তার স্বপ্ন পুরণের দিন।আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নকে যে আজ সে তার যোগ্যতা আর শ্রমের দ্বারা নিজের মুঠোয় নিতে পেরেছে।শুধু কি তাই মৃন্ময়ী সপ্তাহ খানেক নিজ গ্রামে থাকার সময় গ্রামবাসী কে কথা দিয়ে এসেছে গ্রামে সে একটা মায়ের নামে হাসপাতাল বানাবার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাবে।যাতে আর কেউ যেন মৃন্ময়ীর মায়ের মতো বিনাচিকিৎসায় মারা না যায়।সেদিন সবার হাততালিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়েছিল।মৃন্ময়ীর নামে জয়ধবনি রব উঠেছিল।

অবশেষে সেই মহেন্দ্রক্ষন মৃন্ময়ীর সামনে উপস্থিত হলো।ক্লিক ক্লিক হাজারো ছবি উঠানোর মধ্যে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে শ্রেষ্ঠ শিল্পপতির পদক নিয়ে মৃন্ময়ী গর্বিত প্রতিস্টিত নারীর মর্যাদায় নিজেকে সমাজ দেশ সবার কাছে জয়ীতা হিসেবে প্রমান করলো। হাজারো করতালিমুখর পরিবেশে নতুন আর এক আত্মপ্রত্যয়ী মৃন্ময়ীর জন্ম হলো।

সমাপ্ত

About

Smaranika Chowdhury

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}