টয়া আজ রাতের বাসেই ঢাকায় ফিরতে চায়। তার মামী কল করে ফিরে যেতে বলেছে জরুরি ভিত্তিতে। মুমুর কাছ থেকে এ কথা শুনে বাসায় চলে আসি। রিসোর্ট থেকে ওদের বাসায় ফিরতে বলে আমি দোকানে গিয়েছিলাম।

কি কারণে, কেন যেতে বলেছে জিজ্ঞেস করে কোনো সদুত্তর পেলাম না। বরং রাতের বাস আছে কিনা উল্টো জিজ্ঞেস করলো। পরদিন যেতে বলেও লাভ হলো না। শেষে দশটার দিকে বাস স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বাস রাত দুটোয় ছাড়বে। কি যেন গাড়ির সমস্যা হয়েছে।

টয়া মুখ কালো করে বলল, এতক্ষণ বসে থাকবো! বাসায় আণ্টির কাছ থেকে কত আদর নিয়ে বিদায় নিলাম এখন আবার ফিরে যাবো?
— না, বাসায় ফেরার দরকার নেই। একটা সুন্দর কফি শপ আছে টিলার উপর। এতোক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে তবে আমি বললে পেছনে চেয়ার পাতা খোলা অংশে বসা যাবে। টিলার উপরে বসে জোছনায় ভেজা সবুজ গাছপালা দেখতে তোমার হয়তো ভালো লাগবে। যাবে?
— বাহ্ শুনেই তো লোভ হচ্ছে।

আমি পরিচিত বন্ধুর বাইক কল করে আনাই। ব্যাগ কাউন্টারে জমা রেখে টয়াকে নিয়ে রওনা হই।

উচু টিলার উপর আধো অন্ধকারে টয়ার পাশে বসে আছি। নীচের ঘন গাছপালা একে অপরকে জড়িয়ে আছে। টয়া মুগ্ধ হয়ে জোছনায় ভেজা প্রকৃতি দেখছে।
— ভালো হয়েছে বাস লেট করবে। এতো সুন্দর দৃশ্য মিস হয়ে যেত।
— তোমার আজ যাওয়া কি খুব জরুরি ছিল? থাকলে আরো জায়গা ঘুরে দেখাতাম।
— আছে না লামিয়া, কংকা। ওদের দেখান। ওরা খুশি হবে।
— টয়া, তুমি আজকের ঘটনায় রাগ করেছো?
— না না, রাগ করবো কেন? আপনার ভালো লাগা সেটা একান্ত আপনার। আমি কেন রাগ করবো?তাছাড়া আপনি এতো কৈফিয়ত দিচ্ছেন ই বা কেন?

আমি চুপ হয়ে যাই। সত্যি তো!
— টয়া!

  • জ্বি!
    — তোমার মামী এতো জরুরি ভিত্তিতে কেন ডেকেছে?
    — জানি না তো।
    — বিয়ে বিষয়ক কি?

টয়া হেসে উঠে বলে, কার বিয়ে, আমার? কি যে বলেন। আমার কেন বিয়ে হবে? আমার মামাতো বোন পিউর আগে বিয়ে হবে। ও বেশ সুন্দরী। আমার মতো বেশভূসা বা চলন বলনও না। দেখা মাত্রই পছন্দ হওয়ার মতো। ওকে রেখে আমাকে কে বিয়ে করবে?
— তোমার আগে তোমার ছোট বোনের বিয়ে হবে?
— হবে, এ আর এমন কি।
— আর তোমার?

  • আমারও একসময় হবে। আসলে যার বাবা মা ভিন্ন ভিন্ন সংসারে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাদের মেয়ের বিয়ে দেয়া কি আর সহজ কথা, বলেন?
    — এটা কি তোমার কথা নাকি তোমার মামা-মামীর কথা?
    — তারা কেন বলবে? তারা আমার ভালো চায়। এটা সমাজের কথা। সমাজ বড্ড খারাপ জিনিস। যারা একা, অসহায়, সমাজ তাদের আরো একা করতে পছন্দ করে।
    — কিন্তু তুমি বললে তোমার পরিবার তোমাকে অনেক ভালোবাসে। পরিবার এক থাকলে সমাজ তো পাত্তা পায় না।

টয়া আমার দিকে চেয়ে হঠাৎ হেসে ওঠে। অন্ধকারে মুখ ফিরিয়ে বলে সে পরিবারের অংশ নিজেকে ভাবাই ভাগ্যের ব্যাপার। বাদ দেন তো। মামা মামী যখন বিয়ে দেবে আমি চুপচাপ করে নেবো কোনো কাহিনী ছাড়া।
— তোমার কোনো মতামত নেই?
— ওদের মতই আমার মত। আমার নিজেস্ব কোনো পছন্দ তো নেই। কাউকে আজ পর্যন্ত প্রেমেও ফেলতে পারি নি। টয়া হাসতে থাকে।

আমি চুপ করে টয়ার দিকে চেয়ে থাকি। ওর হাসিটা কেমন যেন প্রাণহীন।

হাসি থামিয়ে বলে, আমি আসলে আমার পরিবারের ব্যাপারে কোনো দ্বিধা মনের মধ্যে বসতে দেই না। তারা ছাড়া আমার আছে কে? পরিবার ছেড়ে একা হয়ে চলা আমি ভয় পাই। আমার কাছে পরিবারের প্রাধান্য অনেক বেশি, সবচেয়ে বেশি।

টয়ার দৃষ্টি কেমন যেন উদ্দেশ্যহীন, বিভ্রম জড়ানো।
— মইন ভাই, আগেও বলেছি আপনার পরিবারের প্রতিটা মানুষ ভালো। মুখে সারাক্ষণ ভালোবাসি ভালোবাসি বলার প্রয়োজন পড়ে না। এটা উপলব্ধির ব্যাপার। আপনার কোনো একটা ভুল সিদ্ধান্ত কিন্তু সব শেষ করে দিতে পারে।
— বিয়ের কথা বলছ তো, ভালো মেয়ে কোথায় পাবো?
— আপনি চাহিদা বিহীন নির্ঝঞ্জাট মানুষ। আপনার পাত্রীর অভাব হবে না।
— তাই? দু একটা পাত্রীর সন্ধান দাও তো।
–শুনেছি প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা মানুষের মন অনেক বড় হয়। এ শহরের কাউকে বেছে নিতে পারেন।
— তেমন কাউকে কখনো মনে ধরে নি।
— কোনো অপরিচিত নতুন মুখ বেছে নিন।
— আগ্রহ নেই।
— লামিয়া ভালো হতো। কিন্তু ফাজিলটা তো প্রেম করে।
–আফসোস! এতো ভালো মেয়ে হাত ছাড়া হয়ে গেল।

টয়া হেসে ওঠলো । আমি মৃদু হেসে বলি, আর কেউ আছে?
— আমার মামাতো বোন পিউকে করবেন? মেয়ের জামাই হিসাবে মামা-মামীর অনেক আদর পাবেন। পিউ একটু ডিমান্ডিং তবে মন্দ না। এখানে নিয়ে বসলে পিউ বলবে আমাকে সামনের পাহাড়গুলো কিনে দাও না প্লিজ!

আমি হেসে বলি ওতো বড়লোক আমি নই। আর কারো নাম বলো।
–আর কে? যে আপনাকে যত্ন করে রেঁধে খাওয়াচ্ছে, আপনার আলাদা খেয়াল রাখছে….তার নাম শুনতে চাইছেন?
— তোমার কেন মনে হচ্ছে আমি কংকার প্রতি আগ্রহী?
— নয় তো কি? আমার প্রতি আগ্রহী তো আর না।

আমি চুপ করে টয়ার চোখের দিকে তাকাই ।

টয়া চোখ নামিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, আমাদের ফেরা উচিত। আপনি কল করে দেখেন গাড়ি ঠিক হয়েছে কিনা।
— হুম দেখছি।

বাস একঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দেবে। স্টেশনে ফিরতে বললো।

টয়ার নাম্বারটা নিয়ে নিজেরটাও দিলাম। বাসায় পৌঁছে কল করে জানাতে বললাম।

বাস ছেড়ে দিলে আমি একা হাঁটতে থাকি নির্জন রাস্তায়। কেন যেন বাসায় ফিরতে মন চাচ্ছে না।

অদ্ভুত শূন্যতা ভর করেছে মনে।

আরো কথা বলতে ইচ্ছে করছে টয়ার সাথে। কিন্তু কি বলবো কল করে। কিছুক্ষণ আগেই তো চোখের সামনে ছিল।

বাসায় ফিরে চুপচাপ রুমে ঢুকে পড়ি।

কিছু ভালো লাগছে না। ঘুম আসছে না। মনটা অস্থির হয়ে আছে। রাত যত বাড়ছে দীর্ঘশ্বাস ততো আষ্টেপৃষ্টে ধরছে।

হঠাৎ মোবাইল বেজে ওঠে।

এতোটা অপ্রত্যাশীত ছিল যে মনে হলো বুকের স্পন্দন ব্যস্ত গতিতে ছুটতে শুরু করেছে।
— হ্যালো!
— গাড়ির টায়ার প্যাংচার। বসে বসে বোর হচ্ছি। ঘুম ভাঙ্গালাম কি?
— না, ঘুম আসছিলো না।
— গাড়ি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত কথা বলা যাবে?

আমি হেসে ফেললাম।

টয়ার বাড়ি ফেরা পর্যন্ত আমাদের কথা চলল। ওর মামী দরজা খোলার আগ মুহুর্তে ফোন রাখলাম।

ঘুম ভাঙ্গলো দেরীতে তবে মিষ্টি একটা রেশ রয়ে গেল মনে। নিজেকে কেন যেন সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে রইলো নিজের অজান্তে। বাগানে হাঁটতে বেরুলে লামিয়ার হাতে ধরা পরলাম।
— ভাইয়া আপনাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে কেন?
— কি রকম?
— খুব সুখী মানুষ লাগছে। অথচ গতকাল মুখ কেমন অন্ধকার করে ঢুকেছিলেন।
— তাই নাকি? কি জানি!

কদিন ধরে নিজের মাঝে বুদ হয়ে আছি আমি। দিনের বেলা দোকানে ব্যস্ত থাকি রাতে চুপচাপ খেয়ে ঝটপট রুমে ঢুকে পড়ি। মুমু নিজের মতো করে ঘুরচ্ছে কংকা আর লামিয়াকে নিয়ে। ওদের ফিরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে।

রাতের খাবারে বসলে কংকা একটা পাঞ্জাবি এগিয়ে দেয় আমার দিকে।
— এটা আপনার উপহার।
— কি দরকার ছিল কংকা?
–বা-রে, আপনি সেদিন আমাদের এতো সুন্দর শাড়ি গিফট করলেন আমাদেরও তো আপনাকে কিছু গিফট করা উচিত, তাই না?

মাহিন এবং আন্টিকেও দিয়েছি। এটুকু তো করতেই পারি। টয়া তো আগেই পালিয়েছে আর লামিয়ার মাথায় এসব নেই। তাই আমিই আজ মুমুকে নিয়ে এসব কিনে কানলাম।

লামিয়ার মুখ মুহুর্তে লাল হয়ে ওঠে। বিব্রত হয়ে বলে, আমাকে তো বলে যাসনি। তাহলে আমিও কিছু কিনতাম।
— বলে যাবো কেন? সবার ভাষ্য অনুযায়ী তোর মাথায় অনেক বুদ্ধি। কিন্তু জায়গা মতো কাজে লাগাস না কেন? নাকি লাগাতে চাস না?

আমি লামিয়াকে বললাম, লামিয়া তোমার কিচ্ছু গিফট করা লাগবে না। তবে এমুহূর্তে এককাপ চা নিজ হাতে বানিয়ে খাওয়ালে আমি সবচেয়ে খুশি হবো। পারবে?

লামিয়া হেসে বলল, জ্বি ভাইয়া।

কংকা তড়িঘড়ি করে বলে, চা আমিই দিচ্ছি। লামিয়ার কষ্ট করার দরকার কি? তাছাড়া আপনি এতো রাতে ঘুমানোর সময় চা খাবেন কেন? এসব বাজে অভ্যাস…

কংকার দিকে না তাকিয়েই আমি বলি, আমি লামিয়ার হাতের চা-ই খেতে চাই। লামিয়া, চা হলে আমাকে ডেকে দিও। আমি রুমে গেলাম।

আজকাল রাতগুলো কেন যেন অনেক ছোট হয়ে গেছে। টয়ার সাথে কথা শুরু হলে কিছুক্ষণেই দুটা তিনটা বেজে যায়। খুব সাধারণ কথা হয় আমাদের, প্রতিদিনের কথা। তবু সারাদিন অপেক্ষা করি কখন রাত হবে। মনের মাঝে চাপা আনন্দ কাজ করে। টয়ার মামী কেন জরুরি ভিত্তিতে টয়াকে ডেকেছিল জিজ্ঞেস করি নি। জিজ্ঞেস করেই বা কি হবে? দূরে থেকেও টয়া যেন এখন অনেক বেশি কাছে।

আজ দোকান মালিক সমিতির মিটিং ছিল। মিটিং শেষে প্রতিবারের মতো বিয়ে কবে করছি এই নিয়ে হাসি ঠাট্টা শুরু হলো। আগে এ ধরনের প্রশ্নে গম্ভীর মুখে এড়িয়ে যেতাম কিন্তু আজ শুনতে খারাপ লাগছিল না।

ইনকাম ভালো বলে পরিচিত অনেকেই আকার ইঙ্গিতে তাদের বোন শালীদের ছবি দেখাতে চায়।

বিয়ে নিয়ে আসলে ভাবা দরকার। বয়স তো কম হলো না। সমবয়সীরা সব বউ বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

রাতে খাওয়ার সময় লামিয়া গম্ভীর মুখে বলে, মইন ভাই, জানেন কিছু?
— কি?
–টয়া কল করেছিল। ওকে আজ আংটি পরিয়ে গেছে ছেলেপক্ষ।

আমি এতোটা অবাক হই যে হা হয়ে ওর দিকে চেয়ে থাকি।

কংকা ঠেস দিয়ে বলে, এমনই হওয়ার কথা। বললাম না মামা- মামী স্বার্থপর, লোভী। আমার কথা তো টয়া পাত্তা দিতো না।

আমি দ্বিধা জড়ানো কণ্ঠে লামিয়াকে জিজ্ঞেস করি, টয়া রাজি এ বিয়েতে?
— জানি না ভাইয়া, ও ব্যাপারে কিছু বলল না। আমাকে শুধু আংটি পরানো হয়েছে জানিয়ে রেখে দিলো।

কংকা বলল, দেখ টয়া মনে মনে খুশি হয়তো। দেখামাত্র যে ছেলে টয়ার মতো মেয়েকে আংটি পরিয়ে দেয় সে একটা গর্ধব। কাজে কম কথায় ফটং ফটং বেশি যখন দেখবে তখন আংটি ফেরত নিয়ে পালাবে দেখিস।

আমি প্রচন্ড ক্ষেপে ধমকের সুরে বললাম, কংকা সবকিছুর এতো বাজে মন্তব্য করো কেন তুমি?

কংকা অপমানিত হয়ে লাল মুখে চেয়ে থাকে আমার দিকে। কিছু বলার আগেই আমি নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দেই।

সবকিছু অসহ্য লাগছে। কংকার চেয়েও শতগুন রাগ হচ্ছে টয়ার উপর। একবার বলতে তো পারতো! গতকাল বলল মেহমান আসবে তাই সারাদিন ব্যস্ত থাকবে। মেহমান বিদায় হলে নিজে কল দিবে। কিন্তু কোথাও একবারো বলেনি ওকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে।

এতোবড় ঘটনা আমাকে পুরোই চেপে গেলো টয়া?

রাগে ক্ষোভে টয়াকে আমি আর কল করলাম না। মনে মনে আশা ছিল টয়া হয়তো কল দিবে কিন্তু ওর কোনো কল এলো না।

এরপর দুরাত কেটে গেল টয়া কল করেনি। আমিও অভিমানে কল দেই নি। তবে ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভেঙে পড়লাম।

আমাদের কোনো প্রতিশ্রুতি হয়নি, একসাথে দুজন বিশেষ কোনো স্বপ্ন দেখিনি। তবু কোথাও না কোথাও একটা অধিকার জন্মেছিল। একবার কি বলা যেত না?

মনের শূন্যতা আবার আমাকে পেয়ে বসলো। সাথে যোগ হলো আকাশ সমান অভিমান।

বুঝে নিলাম একা ছিলাম, একাই চলতে হবে বাকিটা পথ। কাউকে পাশে পাওয়া, মন খুলে কথা বলার মতো বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই।

চলবে…

ঝিনুক চৌধুরী

About

ঝিনুক চৌধুরী

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}