বিবাহ উপযুক্ত মেয়েকে ঘাড় থেকে নামাতেই হয়তো মহাসমারোহে বোবা লোকটার সঙ্গে আমার বিবাহের আয়োজন চলছে।চারদিকে কন‍্যা বিদায়ের আনন্দে মাতোয়ারা শুধু আমার দুচোখে অশ্রু।কিছুক্ষণ পূর্বে এক বোবা নির্বোধ বালকের সঙ্গে আমার বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। কাউকে দোষারোপ করবো না সব আমার ললাটের লিখন। কপাল গুণে এরকম একখানা ভাই পেয়েছিলাম যে নিজের বউকে খুশী করতে প্রাণ প্রিয় বোনকে বলি দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি। মা গত হয়েছেন আমার জন্ম ক্ষণে।না থাকার মতো নাম মাত্র বাবা আছেন । মা গত হবার কিছুকাল পরেই উনি নতুন করে সংসার পাতেন।কিন্তু এক বৃক্ষের ছাল আরেক বৃক্ষে কখনও জোড়া লাগেনা কথাখানা সত্য প্রমাণ করে নতুন গৃহকর্ত্রী আমাদের দুভাই বোনকে অবহেলা করতে শুরু করলেন। অনাদর অবহেলায় বড়তো হলাম কিন্তু যখন ভাইয়া বিয়ে করলো তখনই শুরু হলো সংসারে আরেক অশান্তি। ভাবির সহিত ছোট মায়ের মোটেই বনিবনা হলো না।। বাবা উপায়ন্তর না পেয়ে আমাদেরকে আলাদা করে দিলেন। ভাইয়ের ভাগে পড়লাম আমি। এদিকে ভাই ভাবির সংসারে পরগাছার মতো অবস্থান হবার জন্য মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা চিরতরে হারিয়ে ফেললাম । তাই বড়লোক বাপের একমাত্র ছেলে দেখেই উনারা পাগল হয়ে গেলেন।আমার মতামত নেবার প্রয়োজন মনে করলেন না। তাছাড়া সেখানে যৌতুকের কোনো ঝামেলা নেই,কেই কোনো উপহার সামগ্রীর ঝামেলা।কিছুই দিতে হবে না। আবার মাঝে মধ্যে সাহায্য পাওয়া যাবে এমন সুযোগ হাতছাড়া করার মতো বোকা আমাদের বাড়িতে বর্তমানে কেউ নেই। ভাইয়া আমার শশুরের কোম্পানিতে চাকরি করেন। এমন প্রস্তাব প্রত‍্যাখান করার মতো সাহস ভাইয়ার ছিলও না। কিন্তু টাকা পয়সা দিয়েই কি সুখ কেনা যায়? স্বামী নামক লোকটার সঙ্গে যদি নিজের ভালো-খারাপ,সুখ-দুঃখের চারটি কথা ভাগাভাগি করতেই না পারি তাহলে ওরকম টাকা দিয়ে কি হবে?

অট্টালিকার মাঝে আমার হাহাকার ওই অর্থের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ঝঙ্কার দিবে। আমি সহ‍্য করতে পারবো না। এর থেকে মৃত্যু ভালো ছিল।কথাগুলো আনমনে ভেবে চলেছে আরশি। খুব ধুমধাম করে কিছুক্ষণ পূর্বে ঐতিহ্য জুনায়েদ চৌধুরীর সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে। ছেলেটা ওর পাশে বসে নিজের টুপির সুতা গুলো খুটিয়ে খুটিয়ে তুলছে। বিয়ে কি এসব বোঝার ক্ষমতা তার নেই। সে আছে আপন খেয়ালে। মা ছাড়া কাউকে ডাকতে পযর্ন্ত পারেনা। রাহাত চৌধুরী চেয়েছিলেন ছেলেকে কখনও বিয়ে দিবেন না তবুও দিতে হলো। মেয়েটা ভীষণ ভালো। উনার স্ত্রীর পছন্দ তাই বিয়েটা দিতে হলো। আরশী ছলছল চোখে ঐতিহ্যকে দেখছে। এই হাবা গোবা ছেলেটার সঙ্গে কিভাবে সংসার করবে এই চিন্তাই ওর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তাছাড়া ওর এরমর মানুষ দেখলে ভয় হয়। লোকটা যদি উন্মাদ হয় তখন কী হবে? মারবে নাকি খামচে দিবে?কথাটা ভেবেই ও শব্দ করে কেঁদে উঠলো। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ বিদায় পর্বের সূচনা।। আরশীর বাড়ির জন্য না নিজের জন্য কষ্ট হচ্ছে। ও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো ওবাড়িতে বেশিদিন থাকবে না। একটা থাকার জায়গা খুঁজে সেখানে পালিয়ে যাবে।। বোবা কালা লোকের সঙ্গে থাকার চাইতে সারাজীবন একা থাকাই ভালো। ও এসব বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে কিন্তু পরক্ষণেই ভেঙে পড়ছে। আদো কি সেখানে গিয়ে ও বের হতে পারবে নাকি বন্দী হয়ে যাবে?।? আরশীর পাশে ওর ভাবি সুলেখা বসে আছেন। উনি ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন,

বড়লোক বাড়িতে যাচ্ছ জীবনে আর যাইহোক টাকার অভাব হবে না। আরশী মানুষের জীবনে প্রচুর টাকার প্রয়োজন। টাকা ছাড়া জীবনে সুখ আসেনা। তোমার ভাইয়া তোমাকে সুখের রাজ‍্যে যাবার টিকিট দিচ্ছেন তাকে ভুল বুঝোনা।

ভাবির বলা কথাগুলো শুনে আরশীর খুব বলতে ইচ্ছা হলো,
“এই টিকিটের আমার প্রয়োজন ছিল না এটা বরং তোমাকে দিলেই ভালো হতো। নিজে যে সামান্য কৃষ্ণবর্ণের ছেলের সঙ্গে বিয়ে করবে না বলে বিয়ের আসর থেকে উঠে এসেছিলে সেই তুমি এখন আমাকে বোঝাতে আসছো?”

আরশী কথাগুলো বলতে গিয়েও চুপ থাকল। সর্বনাশ যা হবার কিছুক্ষণ পূর্বেই হয়ে গেছে এখন বিবাদ করে কি হবে?মা মারা যাবার সময়ই সব সৌভাগ্য উনি সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। এসব ভাবতে ভবাতেই ওদেরকে নিয়ে গেলো গাড়িতে তুলে দিতে। ফরিদের চোখের কোনে অশ্রু চিকচকি করছে। একমাত্র বোনটার বিয়ে হচ্ছে। একচোখে আনন্দ অশ্রু অন‍্য চোখে কষ্ট। উনি আরশীকে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলেন কিন্তু আরশী শক্ত পাথরের মূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। ওর এসব নেকামি বলে মনে হচ্ছে। বোনকে জলে ডুবিয়ে এখন লোক দেখানো নাটক করার কি মানে ওর মাথায় আসছে না। ওর বাবা আকবর হোসেন দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আরশী সেদিকে একবার তাকিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। কিন্তু সমস্যা হলো বর ঐতিহ্য ওর পাশে কিছুতেই বসতে চাইছে না। লোকটার নাকি ওকে দেখে ভয় করছে তাই কিছুতেই সে মায়ের আচল ছাড়তে চাইছে না। তাই একপ্রকার বাধ‍্য হয়েই ডালিয়া চৌধুরী ছেলেকে নিয়ে অন‍্য গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। আরশী চুপচাপ বসে আছে। কি অদ্ভুত বিয়ে। বউ একা একা শশুর বাড়ি চলেছে অথচ কাছে কোনো শুভাকাঙ্খী নেই। এসব দেখে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেলো আরশী। ওর ঘুম ভাঙলো কারো চিৎকার শুনে। ও তাড়াতাড়ি উঠে বসতেই লক্ষ্যে করলো কিছু মেয়ে ওকে ডাকছে। আরশী বাইরে বেরিয়ে আসলো। সামনে দোতালা বিশিষ্ট বিশাল বড় বাড়ি। ও একপা দুপা করে ফুলের পাপড়ির উপরে পা ফেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। দরজা থেকে ওকে বরণ করে বাসর ঘরে রেখে আসা হলো। আরশীর এখনো ঘুম কাটেনি। ও বিছানায় হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ বসে আবারও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।

গভীর রাত ঘুমন্ত আরশীর উপরে ঝাপিয়ে পড়লো কোনো এক ছায়ামানব। ধস্তাধস্তির এক পর্যায় আরশীর গলাই লোকটা তার লম্বা নক ফুটিয়ে দিলো। গলা থেকে পড়া রক্ত আর অজস্র যন্ত্রণায় ঘাবড়ে গেলো আরশী।।ও নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে ছায়াটাকে সরাতেই ওর ঘুম ভেঙে গেল।তারপর চোখ খুঁলে তাকিয়ে দেখল সোফায় ওর স্বামী ঐতিহ্য জুবায়ের ঘুমিয়ে আছে। কি মায়াবী ওই মুখখানা শুধু তাকিয়ে থাকতেই মন চাই কিন্তু লোকটা যে বোবা কথা বলতে পারেনা। নির্বোধ বোবাকে তো আর স্বামী হিসেবে ভালোবাসা যায় না। শুধু করুণা করা যায়। নিজের সুখ দুঃখের অংশীদার করা যায় না তার উপরে আবার কিসের ভালোবাসা? কথাটা ভেবেই আরশী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ঐতিহ্যের হাতের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। লোকটার ঝুলন্ত হাত থেকে টপটপ করে লাল রক্ত পড়ছে। আরশী দ্রুতপায়ে লোকটার দিকে এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো কারণ নীল দেওয়ালে একজন নববধূর ছবি অঙ্কিত আছে। আরশী একপা দুপা করে ছবিটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। টকটকে লাল বেনারসি পরা মেয়েটার চোখে মুখে কেমন রহস্যের ছাপ বিশেষ করে ওর হাসিটা। ছবির রঙ দেখে বোঝা যাচ্ছে কিছুক্ষণ পর্বেই ছবিটা আঁকা হয়েছে। নিখুঁত ছবির মেয়েটাকে দেখতে ঠিক ওর মতোই লাগছে। আরশী একবার ভাবলো ঐতিহ্য বুঝি ওর ছবিই এঁকেছে কিন্তু পরক্ষণেই মেয়েটার ঠোঁটের নিচের তিলটা দেখে বুঝলো না এটা ওর ছবি না। ছবিটা কোনো সুন্দরী রমনীর।

কিন্তু কে এই রমনী?

চলবে…

About

লাবণ্য ইয়াসমিন

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}