March 8, 2022

আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-২০)

আজিমপুর টু উত্তরা
ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
আনোয়ার হাকিম।

(২০)
কেবলমাত্র অসুস্থ হলেই সবার জীবনবোধ জাগ্রত হয়। মনে হয় দুনিয়াবি জীবন খেল তামাশা মাত্র। যে ঔজ্জ্বল্যের মোহে আমরা প্রাণান্তকর দৌড়ঝাঁপ করি দিন শেষে তা অধরাই থেকে যায়। দৌড়ের মাইল পোস্টটা কেবল সামনে সরে যায়। পৃথিবীর সকল সুস্থ মানুষকেই মনে হয় সবচেয়ে ভাগ্যবান। আর নিজেকে জীবন যুদ্ধে পরাস্ত সৈনিক বলে মনে হয়। ইমাম সাহেবের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। এক বয়ানে তিনি বলেছিলেন সুস্থতা যেমন আল্লাহর নিয়ামত তেমনি অসুস্থতাও। সুস্থতা মহান আল্লাহর নিয়ামত এটা সহজবোধ্য। তাই বলে অসুস্থতাও? তিনি ব্যাখ্যা করলেন। অসুস্থ হলে আমরা সুস্থতার মজা উপলব্ধি করতে পারি। অসুস্থ হলে আমরা সৃষ্টিকর্তাকে যেমন প্রতি পদে পদে স্মরণ করে থাকি তেমনি তাঁর কাছে উপুর্যুপরি মিনতিও করে থাকি। যে যতটুকু পারি এবাদত-বন্দেগীতে, তাওবা-এস্তেগফারে মশগুল হয়ে পড়ি। অথচ সুস্থ থাকলে, এত গভীরভাবে কোনদিনই আমল করা হয়ে উঠেনা। সত্যিই তো! অসুস্থতাও তো একপ্রকার নিয়ামত। আর অসুস্থ হলেই মানুষ নানাবিধ বিষয় নিয়ে সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে। চারপাশের অতি আপনজনের ছোট খাটো বিষয়গুলোও তখন প্রকট হয়ে দেখা দেয়।

ঢাকায় যাওয়া বিশেষ জরুরি হয়ে পড়েছে। নিউরো ডাক্তারের ফলো আপ ভিজিটের আগেই কাউন্সেলিং করা দরকার। তৌহিদের কল্যাণে তার পরিচিত দুরসম্পর্কীয় আত্মীয় সায়ক্রিয়াট্রিস্টের কাছে বুকিং দেওয়া হয়েছে। মোট ছয় সেশন দিতে হবে। প্রগ্রেস ভালো হলে চারেই শেষ হতে পারে। প্রথম দিন ব্রিফিং এন্ড ইনফরমেশন কালেক্টিং। প্রতিদিন এক দেড় ঘন্টার সেশন। এ ধরণের কাউন্সেলিং এর কথা শুনেছি। কিন্তু নিকটজন কেউ করেছে শুনিনি। না শুনলেও, কেন জানি নেগেটিভ একটা ইমপ্রেশন মননে-মগজে ছায়াপাত করে আছে। এরা নাকি ম্যাসমারিজম জানে। নীলাভ আলোতে বসিয়ে কি-সব বলে কয়ে ঘুম পারিয়ে দেয়। তারপর রুগী আপন মনে তার ভেতরগত ব্যাথার অকথিত কাহিনী গড়গড় করে বলে যায়। সায়ক্রিট্রিস্ট তার নিজের উত্তর পাওয়ার জন্য নিজেও কিছু প্রশ্ন করে সেগুলো বের করে আনে। এগুলো রহস্যোপন্যাস বা গল্প-কাহিনী, সিনেমা ইত্যাদি দেখে-শুনে জেনেছি। প্রথম দিন তৌহিদকে নিয়েই সায়ক্রিয়াট্রিস্টের চেম্বারে গেলাম। চেম্বারের সামনে কয়েকজন বসা। সবাই চুপচাপ। তবে তাদের চোখের নড়াচড়া পাগল পাগল টাইপের মনে হলো। ভয় ঢুকে গেলো মনে। কাউকে কাউকে পায়চারি করতেও দেখলাম। মনে হয় ভেতরে প্রবল স্যুনামী হচ্ছে। কাউকে দেখলাম আত্মীয় স্বজনরা ঘিড়ে ধরে বসে আছে। আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে। তৌহিদ সাথে থাকায় কিছুটা ভরসা পাচ্ছি। কতক্ষণ পর আমার ডাক এলো। রুমে ঢুকলাম। সাদা এপ্রোন পড়া একজন এসে আমার চৌদ্দ গুষ্ঠির কুষ্ঠি টুকে নিয়ে গেল। রুমে আমি একা। আলো কম। এসির বাতাস যথেষ্ট বলে মনে হলো না। কিছুক্ষণ পর সায়ক্রিয়াট্রিস্ট এলেন। ডিটেক্টিভ টাইপের প্রশ্ন করা শুরু করলেন। আমার কাছে তাকেই উদ্ভ্রান্তের মত মনে হলো। মধ্যবয়সী। মুখে হাসির বালাই নেই। চোখ পানসে। কথা বলেন আর হাতের কলম কিছুক্ষণ পর পর নাকে ঠেকান। হয়ত এটা তার বদ অভ্যেস। আমাকে কেন কাউন্সেলিংয়ের জন্য প্রেসক্রাইব করা হয়েছে আমি জানিনা। আমি তো পাগল না। মাথার বিষয়টা আগের চেয়ে অনেক ইমপ্রুভ করেছে। মনে মনে ধরেই নিয়েছি উনি আমার ভেতরের কথা বের করে মাথার ব্যামোর উৎস খুঁজবেন। আমি নার্ভ টান টান করে তার মুখোমুখি বসা। তিনি শুরু করলেন, “কিছু বলুন”।
— কি বলবো? ডেসপারেট ভঙ্গিতে আমার উত্তর।
— যা মনে চায়
— মন জানতে চাচ্ছে, আমাকে এখানে কেন রেফার করা হয়েছে?
— যিনি রেফার করেছেন উনাকে জিজ্ঞেস করেন নি?
— প্রফেসররা রোগীর কথা শুনে না
— গুড। তো বলুন কি জানতে চান?
— মনোরোগ নিয়ে বলুন।
— পরিসংখ্যান অনুসারে পৃথিবীতে প্রতি চারজনের একজন মানুষই মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত।
— তাহলে এতে উদ্বেগের কি আছে?
— কিছু অদ্ভুত, রহস্যময় আর বিরল মানসিক রোগ আছে পৃথিবীতে, যেগুলোর কথা আমাদের বেশিরভাগ মানুষেরই অজানা।
— ভেরি ইন্টারেস্টিং।
— এই যেমন ধরুন ফিলোফোবিয়া। যারা প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বা ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রতারণার শিকার হয়ে জীবনে আর কখনোই প্রেমের সম্পর্কে না জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। আবার এমনও কিছু মানুষ আছে, যারা এরকম কোনো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন না হয়েও কখনোই প্রেম করতে চায় না। প্রেম সংক্রান্ত এই ভীতি কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। এটি একটি রোগ। পৃথিবীতে প্রায় প্রতি দু’শ মানুষে একজন এই রোগে আক্রান্ত।
— আমি এই ক্যাটাগরিতে পড়িনা। বরং আমার প্রেম রোগ আছে মনে হয়। আমি তার কথার মধ্যেই উত্তর দিলাম।
সায়ক্রিয়াট্রিস্ট নিরুত্তাপ ভাব নিয়ে আমাকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করছেন। আমি এখন পর্যন্ত শক্ত অবস্থানেই আছি। কাগজের টোকা দেখে শান্ত কন্ঠে বললেন, “আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনি প্রেমিক পুরুষ”? “ঠিক সেরকম না” আমার ঝটপট উত্তর। তিনি হাতের কলম নাকের ডগায় ঠেকিয়ে বললেন, “কেন আপনার এমন মনে হয়”?
— জানিনা
— কি করেন?
— চাকরি
— কতদিন হলো?
— দুই
— দুই মানে কি?
— বছর
— পড়াশোনা?
— ইঞ্জিনিয়ারিং
— কোথায়?
— বুয়েট।
সায়ক্রিয়াট্রিস্ট পানসে চোখ খানিকটা বড় করে তাকালেন। তারপর হাতের কলম আবার নাকের ডগায় ঠেকিয়ে বললেন, “ গুড। প্রেম করেছেন”?
— জানিনা
— জানেন না কেন?
— কনফিউজড
— ক্যান ইউ এক্সপ্লেইন ফারদার? বিশেষ কাউকে পছন্দ আছে? মুখ ফুটে তাকে বলতে পারছেন না?
— আছে
— তিনি কি করেন? ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড
— ম্যারিড।
সায়ক্রিয়াট্রিস্ট এবার নড়েচড়ে বসলেন। হাতের কলম নাকের ডগায় ঠেকিয়ে বললেন, “পরকীয়া”?
— ডোন্ট নো।
— বিয়ে করে ফেলুন
— প্রবলেম আছে
— যেমন?
— ডোন্ট হেভ এনি কানেকশন রাইট নাউ
— কেন?
— আই থিংক ইটস এ ডেড ইস্যু রাইট নাউ। লিভ ইট।
সায়ক্রিয়াট্রিস্ট এখনো বরফ শীতল। কিছু কিছু নোট নিচ্ছেন। আর হাতের কলম নাকের ডগায় ঘন ঘন ঠেকাচ্ছেন। তাকে আরো অনুসন্ধিচ্ছু মনে হলো। বললেন, “লিভ ইট। লেট’স প্রগ্রেস। মানসিক দুরাবস্থার অন্য অবস্থাগুলো হচ্ছে প্যারিস সিনড্রোম, এরোটোম্যানিয়া, ক্লেপটোম্যানিয়া, অ্যাপটেমনোফিলিয়া,পেডোফিলিয়া, নেক্রোফিলিয়া—-

আমার মাথা আর কাজ করছে না। শরীর অবশ হয়ে আসছে। যখন হুঁশ হলো তখন দেখি সেই নিরামিষ সায়ক্রিয়াট্রিস্ট নেই। সিস্টার টাইপের একজন বললেন, “আপনি এখন আসতে পারেন। আপনার নেক্সট সেশন-ডেট কার্ডে লেখা আছে”। বের হয়ে দেখি তৌহিদ বসা। এগিয়ে এসে বললো, “এতক্ষণ কি করলো”? বললাম, “জানিনা । তবে এখন অনেকটাই হাল্কা বোধ করছি”। এভাবে চারদিন সেই সায়ক্রিয়াট্রিস্টের মুখোমুখি হলাম। শেষ দিন সেশন শেষে কিছুটা হেসে বললেন, “ইয়াং ম্যান। বিলিভ ইন ইওরসেলফ। সুন্দরীদের ভালো লাগবেই। পুরুষের সহজাত বৈশিষ্ট্যই এটি। নাথিং রঙ ইন ইট। ডু হোয়াটেভার ইউ ওয়ান্ট টু ডু। বাট ইউ পজেস সাম পিকিউলারিটিজ অলসো। ভেরি সিমিলিয়ার টু সো মেনি। বাই দা ওয়ে হু ইজ সাবরিনা”? আমি চমকে উঠলাম। সাবরিনার কথা এলো কিভাবে? বললাম, “হাও কাম ইউ নো হার”? তিনি হাসলেন। সে হাসিতে অনুসন্ধিচ্ছা নেই, নেই উদ্বিগ্নতা। আছে উদ্ঘাটনের আনন্দ। বললেন, “গেট ম্যারিড সুন এন্ড বি হ্যাপী। ডোন্ট বোদার হোয়াট আদার্স উইল সে”।
মনটা যেন আজ পিওর অক্সিজেনে ওয়াশ করা হয়েছে। মাথা সুন্দর কাজ করছে। শরীরে ক্লান্তি নেই। তৌহিদকে বললাম, “ব্যাটা সায়ক্রিয়াট্রিস্ট খাসা চীজ। চাঙ্গা করে দিয়েছে। ফিলিং ড্যাম বেটার”। তৌহিদ হাসলো। বললো, “বাসায় চলো। খালাম্মার সাথে আলাপ আছে। তোমার বিয়ে জরুরি”। “কাকে? সাবরিনাকে”? মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো। তৌহিদ আশ্চর্য হয়ে বললো, “কাকে মানে? এতদিন জানতাম জেমি আর শৈলী। আর এখন সাবরিনা এলো কোত্থেকে”? আমি চট করে বাধা দিয়ে বললাম, “লিভ ইট। ফিলিং আনইজি নাও”। তৌহিদকে আর বাসা পর্যন্ত নিয়ে এলাম না। কি থেকে কি বলে পরিস্থিতি আরো সংকটাপন্ন করে তুলবে কে জানে?

খাবার টেবিলে আম্মাকে খুব খুশি খুশি লাগছে। মলির ইডিডি দিন-দশেক এর মধ্যেই। হয়ত সে কারণেই নানী হওয়ার আনন্দে। হঠাৎই বলে বসলো, “সাবরিনা টা কে”? আমি যেন আকাশ থেকে পড়েছি। পরক্ষণেই বললাম, “কেন, কি হয়েছে”? আম্মা খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, “বল না”? সেলিম সামনে থেকে সরে গেলো। মলি এসে যোগ দিলো। আমার বুঝতে বাকি নেই যে বাসায় ইত্যবসরে সাবরিনা বিষয়ে গবেষণা হয়ে গেছে। তৌহিদই সেলিমকে বলে দিয়েছে। পরিস্থিতি নরমাল করার জন্য বললাম, “মামার অফিসে চাকরি করে”। বুঝতে পারলাম আম্মার আশার টিউব লাইট জ্বলে উঠেছে। বললো, “কথা হয় ওর সাথে”? উত্তরে বললাম, “হাই- হ্যালো হয়েছে। তাও মামার অফিসেই”। “তোর পছন্দ হয়েছে”? আম্মার স্ট্রেট ড্রাইভ। আমি ব্যাকফুটে গিয়ে বললাম, “যে কারোরই পছন্দ হবে”। আম্মা কি বুঝলো কে জানে? কথা এখানেই শেষ। মলি খুশি। সেলিম দরোজার পাশ থেকে সরে ভেতরে চলে গেলো। জানি আম্মা এখনই ছোট মামাকে ফোন দেবে। আমি রুমে গিয়ে কাপড়চোপড় গুছাতে লাগলাম। কাল ভোরে খাগড়াছড়ি যেতে হবে।

চলবে…

About

Anwar Hakim

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}