কাশেমের বাবা যখন যুদ্ধে যায় তখন কাশেমের মা চারমাসের গর্ভবতী। আষাঢ় মাস প্রচন্ড বৃষ্টির রাত
চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে গর্ভবতী স্ত্রী আর বৃদ্ধ বাবা মা বোনেদের রেখে হাশেম মিয়া গ্রামের কয়েক জন যুবকের সাথে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে ঘর থেকে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।
হাশেমের পিতা ছিলেন কিশোর গঞ্জের প্রত্যান্ত অঞ্চলের কোনো এক গ্রামের মসজিদের ইমাম। চারিদিকে হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত কর্মকাণ্ড দেখে তিনি নিজেই তার একমাত্র ছেলে কে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেন। আর সুন্দরী বউমা আর নিজের কন্যা দের নিরাপত্তার জন্য হাওড়ের দিকে তার এক বন্ধুর বাড়ি পাঠিয়ে দেন।
কিছুদিনের মধ্যে হাশেমের যুদ্ধে যাবার কথা জানাজানি হয়ে গেলে রাজাকার বাহিনী এসে তার ইমাম বাবাকে মেরে ফেলে এবং ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।তার মা কোনো রকমে পালিয়ে বাঁচে।
যুদ্ধ শেষ হবার আগেই অসম্ভব রূপবতী ফুলজান বেগম একটা সুন্দর পুত্র সন্তান এর জন্ম দেয়।জন্মের পর সেই সন্তান না বাবাকে না দাদাকে দেখতে পায়।একদিন যুদ্ধ শেষ হয়।তারা গ্রামে ফিরে আসে।গ্রামের লোকজন এর সহযোগিতায় পোড়া ঘরবাড়ি কোনো রকম ঠিক ঠাক করে বাস করতে থাকে। আর অপেক্ষা করে হাশেম মিয়ার ফিরে আসার।কিন্তু হায়, অনেকে ই ফিরে আস কিন্তু ফুলজানের হাশেম আর ফিরে আসে না।
শ্বশুর ও নেই স্বামী ও নেই। এমতাবস্থায় শাশুড়ী অসম্ভব রূপবতী যুবতী বউকে রাখতে না চাইলে ফুলজান বাবার বাড়ি চলে আসে।সেখানে ও অভাব। ছোটো ছোটো ভাই বোন এ ভরা সংসারে সে আর তারছেলে বোঝার উপর শাকের আঁটি হয়ে গেলে বাবা আবার তার বিয়ে দিতে চাইল।ফুলজান রাজি হয় কি করে। তার স্বামী যদি কোনো দিন ফিরে আসে তখন কি হবে তার। তাই সে অন্য কথা ভাবতে চায় না।
একসময় সে গ্রামের জরিনা খালার সাথে শহরে চলে আসে।ময়মনসিংহ শহরে এক ওসির বাসায়। বছর কয়েক থাকার পর ওদের সাথে দেশের বিভিন্ন জাগায় যায়। একসময় ওসি সাহেব রিটায়ার্ড করে বরিশালে নিজের দেশের বাড়ি চলে যান।ততদিনে বিশ বছর কেটে গেছে। বেতন ও বখশিশের টাকা জমা করে আর কিছু লোন নিয়ে ফুলজান বিবি কাশেম কে একটা রিক্সা কিনে দিয়েছে। দেশের বাড়ি গিয়ে ননদের মেয়ের সাথে সখ করে ছেলে র বিয়ে দিয়ে রেখে এসেছে। কাশেম মিয়া বাপের ভিটায় থেকে রিক্সা চালিয়ে সংসার চালায়।ফুল জান বিবি ঢাকায় সাহেব দের বাসায় থেকে যা আয় করে তা দিয়ে তার চলে যায়। বেতনের টাকা জমায় ছেলে র ভবিষ্যতের জন্য।
বিভিন্ন বাসায় কাজ করে চলে ফুলজান বিবি ।ভালো লাগলে দুএক বছর থাকে। ভালো না লাগলে দু ছ’মাস থাকে। এভাবে এখন যে বাসায় আছে এখানে প্রায় দুইতিন বছর হয়ে গেছে। সাহেব অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা! অতি সজ্জন সুহৃদয় ব্যাক্তি। খালাম্মা ও খুব ভালো। তাদের একছেলে এক মেয়ে।মেয়ে ডাক্তার হাসবেন্ড এর সাথে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে।সে নিজেও ডাক্তার। খুবই ভালো। প্রথমে তার ই বাচ্চা কে দেখভাল করার জন্য কাশেম এর মা কে দুই মাসের জন্য রাখা হয়েছিল। এনাদের ব্যবহার এ মুগ্ধ হয়ে সাহেবের মেয়ে নাতি চলে যাবার পরেও সে পার্মানেন্টলি এবাসায় থেকে যায়।
খালুর একমাত্র ছেলে বউ এবাড়িতেই থাকে।উপরের তলায় তাদের আলাদা সংসার। ছেলে প্রাইভেট চাকরি করে আর বউ ইঞ্জিনিয়ার।সমাজ সেবা ও করেন। নিজের অফিস আছে। এহেন উচ্চশিক্ষিত বউ বড়োই বদমেজাজি।নিজেরা প্রেম করে বিয়ে করেছে।প্রথমে বাবা মা রাজি না থাকলেও পরে বাধ্য হয়ে আশ্রয় দিয়েছেন নিজ বাড়িতে। কিন্তু বউমার ঔদ্ধত্য পূর্ণ আচরণে তারা সর্বদা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকেন।
বিশেষ করে কাজের লোকেরা। মালি থেকে দারোয়ান সবাই। ছোটো ছোটো কাজের মেয়েদের তো অত্যাচারের উপর রাখে।
বউমা’টি প্রেগন্যান্ট। শ্বশুর শাশুড়ী অস্ট্রেলিয়ায় মেয়ের কাছে বেড়াতে গেছে। মেয়ের ডাক্তারি কি একটা পরীক্ষা তাই মেয়ের বাচ্চা সামলাতেই তাদের ওখানে যাওয়া।বউমা এর ডেলিভারির আগেই তারা চলে আসবেন। আর কাশেমের মা মুরুব্বি তো আছে ই।তাছাড়া তারা যতদিন না আসেন ততদিনের জন্য বউমা র মাকেও এনে রেখে গেছেন।
সময় টা এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে।সেদিন শুক্রবার দিন ছিলো দেশের থেকে খালাম্মার বোন আর বোন জামাই তাদের ছেলে আরমান কে নিয়ে ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে এসেছে। ভাইয়া বাজার থেকে বিশাল এক মাছ নিয়ে এসেছে। খুব মজা করে রান্না করা হয়েছে,মুরগী ও অন্যান্য তরকারি ও আছে। মেহমানের প্লেটে মাছ দিতে গিয়ে কাশেমের মা এর হাত ফস্কে মাছ টা সহ চামচ টা হাত থেকে পড়ে যায়। লজ্জা ও ভয়ে কাশেমের মা হাসি মুখে দোষ স্বীকার করে জায়গাটা পরিস্কার করতে যাই, ঠিক তখুনি সাহেবের ছেলের অন্তঃসত্ত্বা বউটি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এবং ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। গালিগালাজ এর মধ্যে একসময় তাকে বলে লাথি দিয়ে তিন তলার থেকে নিচে ফেলে দিবে। বাড়ির মেহমানের সামনে নিজের কন্যাসম একজনের কাছে এইধরনের অপমানজনক কথা শুনে কাশেমের মা সহ মেহমানরা সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। টেবিল ভর্তি খাবার পড়ে থাকে কারোর আর সে খাবার মুখে ওঠে না।কাশেমের মা লজ্জায় দৌঁড়ে রান্না ঘরে পালিয়ে বাঁচে মেহমানরা বিভিন্ন বাহানা বানিয়ে উঠে চলে যায়।
বিকেলে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে মেহমানরা একেবারে বাইরে থেকে খেয়েই আসেন।সে রাতে তারা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন। মাঝরাতে শুনতে পায় কাশেমের মা এর কান্না মিশ্রিত বিলাপ! ঘুম ভেংগে যায়। সারারাত কাশেমের মা বিলাপ করে করে আল্লাহর কাছে বিচার দেয়।আল্লাহ যেন এর একটা বিচার করেন। উচিৎ বিচার।
একজন নিখোঁজ মুক্তি যোদ্ধার বউ হিসেবে এতোদিন সবাই তাকে যথেষ্ট সন্মান দিয়ে এসেছে। এমন কি এবাড়ির খালাম্মা খালুজান ও তাকে যথেষ্ট সন্মান করেন।তাই এখনো এখানে থাকা। কিন্তু আজকের পরে আর সম্ভব নয়। এখানে এভাবে থাকা র চেয়ে ভিক্ষা চেয়ে খাওয়া ও ভালো। খালাম্মা খালুজান আসলে এতো কথা সে বলতে পারবে না, আর এতোদিন থাকাও সম্ভব নয়। তাই সে একটা সিদ্ধান্ত নেয়।
সকালে উঠে কেউ আর কাশেমের মা কে খুঁজে পায়না। এর বিশ বাইশ দিন পরে জরুরি ভিত্তি তে বাড়ির কর্তা গিন্নীকে দেশে ফিরে আসতে হয়। কেননা হঠাৎ করেই সময়ের আগেই বউমাটিকে হসপিটালে নেয়া হয়। সেখানে সিজারিয়ান এর মাধ্যমে বধুটি একটি বিকলাঙ্গ মৃত সন্তান জন্ম দেয়।
ফাতেমা হোসেন
৯ই মার্চ, ২০২২ইং