পালমার্সটন নর্থে আমার মা

জীবন আর জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ কত শহরেই না তার ক্ষুদ্র জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আংশ নিজ অজান্তেই রেখে আসে। আবার কিছু কিছু নিজ হৃদয়ে গেঁথে নিয়েও আসে। কিছু স্মৃতি মানসপটে আজীবন আঁকা থাকে আর অন্যসব কালের স্রোতে হারিয়ে যায়। ছোটকালে মনে আছে বাবার চাকুরী বদলীর সুবাদে কয়েকটা শহরে আমাদের থাকতে হয়েছে। এমনকি আমরা মা সহ চার ভাইবোন গ্রামে নানাবাড়িতে পুরো এক বৎসর কাটিয়েছি যখন বাবার ইংল্যান্ড আর আলজেরিয়াতে চাকুরীর প্রয়োজনে থাকতে হয়েছে।

পালমার্সটনের দেড় বৎসর সময় আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। আমাদের তখন অনেক ব্যস্ত সময়। প্রমার বাবা চাকুরীর শুরুতেই ফেলোশীপ পরীক্ষার আয়োজন শুরু করে দিয়েছে। সামাজিকতা রক্ষা, সাংসকৃতিক অঙ্গনে আমাদের চলাফেরা, ছোট বাচ্চা , সংসার এতোসবের মাঝেও আমি কখনো দিক ভ্রানত হইনি। ফাঁক পেলেই ক্লিনিক্যল পরীক্ষার জন্য মুরতাগ নিয়ে বসতাম। অতিকষ্টে সেখানে আর একজন পরীক্ষা্র্থী পাওয়া গেলো যার সাথে আমি মাঝেমধ্যে পড়াশুনা শেয়ার করতে পারি আর ক্লিনিক্যল পরীক্ষার ভাইভা প্র্যাকটিস করতে পারি। হাসপাতালে প্রমার বাবা যার সাথে একসময় কাজ করেছিল মেডিসিন স্পেশালিষট রিডার্ড ইভার্টস এর সঙ্গে কথা বলে আমার অবজার্ভারশীপ ঠিক করে দিলো।যাতে আমি আমার সুবিধামতন যেতে পারি আর সপ্তাহে মাত্র কয়েক ঘন্টা আমার উপসথিত থাকলেই চলে। তবে আমার ভীষণই বিব্রত বোধ হতো রাউন্ডের মাঝখানে গিয়ে পৌঁছুলে বা কিছুক্ষণ পরই বাচ্চার অজুহাতে চলে আসতে হলে।কেনো যেন মনে হয় উনি আমাকে বুঝতে পারতেন আর সেই স্বল্প সময়ের মধ্যেই চেষ্টা করতেন আমাকে কিছু না কিছু শিখিয়ে দিতে। আমি চিরকৃতজ্ঞ উনার প্রতি। বলা বাহুল্য যে প্রকৃত অবজার্ভারশীপের জন্যে সবাইকে প্রায় চল্লিশঘন্টা হাসপাতালে থাকতে হয় আর তা রোগীদের সার্বিক ব্যবস্থাপনা শিখতে দারুন সহায়তা করে। আমার জন্যে বিকল্প এ ব্যবস্থার পেছনে কারণ ছিল মূলত প্রমার দেখাশুনা।

আমার মনে আছে চাইলড কেয়ারের শিক্ষকের রেকমেনডেশনে আমার প্রমাকে কয়েকদিন একজনের কাছে রেখেছিলাম। ক’দিন না রাখতেই একদিন ওর ভীষণই বিরক্তিমাখা কন্ঠসবর ফোনের এপ্রান্তে পেলাম “ তুমি এক্ষুনি এসে তোমার বাচ্চাকে নিয়ে যাও। ও খামোখাই চিৎকার করে কেঁদে বাড়ি মাথায় করছে। থামতে বললে থামছে না।” আমি ভেবে পেলাম না শান্ত মেয়ে আমার যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয় কাঁদে সে কেনো এতো তারস্বরে কাঁদছে? আমি হনতদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে দেখি প্রমাকে কান্নার শাস্তিস্বরূপ করিডোরের এক কোণে বসিয়ে রাখা হয়েছে আর সে স্বভাবসুলভ ফুঁপিয়েই কাঁদছে। আমাকে দেখে যেন আমার চার বৎসরের প্রমা হাতে আকাশের চাঁদ পেলো- মূহুর্তেই আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।সেদিন প্রথম বাচ্চাকে কষ্ট দেবার জন্যে আমার বুকটা ভেঙগে টুকরো হয়ে গিয়েছিল। তখন আমি বুঝতে পারিনি যে আরও কত বুকভাঙগা গল্পের প্লটের জন্য প্রফেশনাল মায়েদের তৈরী থাকতে হয়।

আমি প্রতিজ্ঞা করলাম প্রমাকে বাঙ্গালী পরিচিত পরিবেশে রাখব আর সকল ভাবীদের জিজ্ঞেস করে ত্যক্ত করা শুরু করলাম।অবশেষে যিনি রাজী হলেন তিনি হলেন হাসিখুশী আর মিশুক ওয়াহাব ভাবী। আমি দুঃখপ্রকাশ করছি এজন্যে যে আমার উনার নামটি এখন মনে নেই যেহেতু উনি ওয়াহাব ভাবী নামেই পরিচিত ছিলেন। ভাই ভাবীর দুই মেয়ে আর এক ছেলে মোটামুটি বড় আর তাই উনার হাতে কিছু সময় ছিল যা আমাকে ধার দিয়ে চিরদিনের জন্যে ঋনি করেছেন। ওয়াহাব ভাই সম্পর্কে একটু না বললেই নয়। উনি ছিলেন পালমার্সটন নর্থ ইউনিভার্সিটির লেকচারার। উনার সবচাইতে বড় গুণ ছিল উনি জোকস বলে আসর মাতিয়ে রাখতে পারতেন আর তাই যে কোনো অনুষ্ঠানে উনি ছিলেন অপরিহার্য। আর আমরা সবাই যখন উনার জোকস শুনে হেসে গড়িয়ে পড়তাম ভাবীর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটতো কিনা সন্দেহ। উনাকে জিজ্ঞেস করলে একদিন বললেন “ উনিশ বৎসর একই জোকস শুনছি আর কত হাসব?” আমার ধারণা ভাই প্রথম প্রথম কেবল ভাবীকেই জোকসগুলো শুনাতেন আর উনি নিশ্চিত ভালবেসেই শুনতেন আর হেসে কুটিকুটি হতেন। আমার এখন খুব জানতে ইচ্ছে করে কেনো ওয়াহাব ভাই ভাবীকে নিভৃতে জোকস শুনানো বন্ধ করলেন আর কেনোই বা ভাবী বারে বারে একই জোকস শুনেও হাসতে পারতেন না!

আমার ক্লিনিক্যল পরীক্ষার সময় এগিয়ে এলো। প্রস্তুতি মোটামুটি খারাপ হয়নি বলেই আমার ধারণা আর তাছাড়া লিখিত পরীক্ষার চাইতে সন্মুখ পরীক্ষায় আমার পারফর্মেনস সবসময়ই ভালো ছিল। ইতোমধ্যে আমি ওয়েলিংটন শহরে ইংরেজী পরীক্ষা দিয়ে আসলাম পুরো পরিবারসহ। একেবারে হলিডে এর মত সেই দুদিন কাটল। এবার যেতে হবে ক্রাইস্টচার্চ কিন্তু একা কারণ প্রমার বাবার ঐ সময়ই পোস্টগ্রেজুয়েশন পরীক্ষার প্রিপারেশন হিসেবে একটা কনফারেন্সে যোগ দেবার অভিপ্রায় আগে থেকেই। আমার আর কোনো উপায় থাকলো না মাকে এসে আমাকে সাহায্য করতে বলা ছাড়া। আমার মা তখন সংসার, বাবা ছোটভাইবোন রেখেই পালমার্সটন আসতে এক মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা করেননি। যিনি জীবনে কোনোদিন তেমন ট্রাভেল করেননি উনি একা একা ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর হয়ে অকল্যানড হয়ে আমার জন্যে পালমার্সটন নর্থ এসে পৌঁছালেন। অবশ্য অকল্যানডে উনাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে বাসায় এনে, উর্মির মজাদার রান্না খাইয়ে আবার প্লেনে তুলে দেবার বাপপী ভাইয়ের সহযোগিতা আমার মা এখনো মনে রেখেছেন। এমনটি ই হলেন আমার মা যিনি এই একাত্তর বৎসর বয়স পর্যন্ত কেবল দিয়েই গেলেন কোনোরকম প্রতিদান ছাড়া।

About

Shahnaz Parveen

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}