শুক্রবার৷ সপ্তাহিক ছুটি৷ এই অবসরে কোথায় যাওয়া যায়? হঠাৎ স্মরণ হল বড় আপার বাসা৷ অনেক দিন যাবো যাবো করে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে যাওয়া হয়ে উঠেনি৷ যথারীতি মিরপুরে আপার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম৷ বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি৷ আধা ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি কোন বাসের দেখা নেই৷ এরই মাঝে যে দু একটা বাসের দেখা পাইনি তা নয়৷ কিন্তু বাসে উঠা নিয়ে রীতিমত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় দাঁড়িয়ে থাকা অন্যান্য যাত্রীদের সঙে৷ যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে তাই পরের বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম৷ দেখতে দেখতে একটা বাস এসে গেল৷ এবার কয়েকজনকে পরাস্ত করে বাসে উঠলাম৷ কিন্তু বাসে উঠেই ঠিক মত দাঁড়াতে পারছিলাম না৷ পেছনের সারির লোকদের ধাক্কা ধাক্কীতে পা ঠিক ঠিক ঠাক মত রাখতে পারছিলাম না৷ একবার ডানে চাপ খাই তো একবার বামে৷ বাসটি একটু পর পর ব্রেক কষছে৷ আর পেছনের লোকজন যেন আমার উপর হুমরি খেয়ে পড়ছে৷ একটা রড ধরে কোন রকমে বাদরর ঝোলা হয়ে ঝুলতে লাগলাম৷ এর মাঝে সিট পাওয়া যেন সোনার হরিণ পাওয়া সমান কথা৷ বাসটি ছোট ছোট ব্রেক কষে সামনের গাড়ির সঙে সামঞ্জস্য রেখে চলছে৷ এরই মাঝে দেখলাম একটা সাত আট বছরের ছেলে হাত উচিয়ে গাড়ি থামাতে ইশারা করছে৷ গাড়ি হামাগুড়ি দিয়ে চলছে৷ ছেলেটি পা এগিয়ে দেয় আবার পিছিয়ে নেয়৷ গাড়ি থামবে কি না বুঝে উঠতে পারছিল না৷চঞ্চল হরিণীর মত ওর পায় ও চোখের আচরণ৷ শেষে ড্রাইভার হাতের ইশারায় যেতে বললে ছেলেটি এক দৌঁড়ে রাস্তা পার হল৷
যন্ত্রগুলোর সঙে মানুষের সহ গমন দেখছিলাম৷ গাড়ি গুলো শ্লত গতি শামুকের মত৷ মানুষ গুলো রাস্তা পারাপার দরকার৷ হাত উঁচিয়ে এঁকেবেঁক চলে যায় গন্তব্যে৷ নদীর কথা মনে হল৷ পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুষ্টু ছেলের দল যেমন টুপটাপ ঝাঁপ দিয়ে দেয় তেমনি এই রাস্তা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে এপার ওপার করে শহুরে মানুষ৷ আমার সামনের সিট থেকে একজন ভদ্র লোক উঠে গেল৷ যেন আকাশের চাঁদ পেলাম হাতে৷ এরই মাঝে দু একজন সিটটাকে দখল করার জন্য পা বাড়াল৷ কিন্তু তাদেরকে পরাস্ত করেই সিটটাকে দখল করে ফেললাম৷ সিটে বসার আশ্রয় লাভ করে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম৷ হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার পাাশের সিটেই একজন সুন্দরী রমনী৷ তার বেলীফুলের মত নরম দেহের সঙে আমার দেহের স্পর্শ হতেই আমার ভেতরটা কেমন শূন্য হয়ে গেল৷মেয়েটি নিবিষ্ট মনে তার আইফোনের দিকে ঝুকে আছে৷
বুঝতে পারলাম সে ফেসবুক চালাচ্ছে৷ কি নামে আইডি খোলা দেখার জন্য মনটা আকুপাকু করতে লাগল৷ তাই আঁড় চোখে দেখার জন্য জিরাফের মত গলাটা বাড়ালাম৷ মেয়েটি আমার অভিসন্ধি বুঝতে পেরে তার ফোনটা একটু আড়াল করল৷ মেয়েটির চুলগুলো বাতাসে উড়ছিল৷ কয়েক গাছা চুল আমার মুখে এসে পড়ল৷ মৃগনাভীর কস্তুরীর মত একটা সুঘ্রাণ আসছিল চুল থেকে৷ তার চুল যেন কোকিলের ন্যায় কালো আর সাপের ন্যায় ঠান্ডা৷ একটু আঁড় চোখে মেয়েটিকে দেখছিলাম জানি এটা অন্যায় এটা অপরাধ৷ কিন্তু অপরাধ কি শুধু আমার একই সঙে হাজারটা মেয়ের রূপ সে একাই ধারণ করে আছে সেটা কোন অপরাধ নয়৷ ইচ্ছে করছে আমার ফেসবুক আইডিটা মেয়েটিকে দেই৷
কিন্তু অচেনা একটা মেয়েকে কিভাবে দেই বুঝতে পারলাম না৷ হঠাৎ উর্বর মস্তিষ্কে একটা উপায় গজে উঠল৷ একটা বন্ধুকে ফোন করলে কেমন হয়৷ কিন্তু ফোনে তো কোন ব্যালেন্স নেই৷ তাই একটু মিথ্যের আশ্রয় নিলাম৷ ফোনটা কানের কাছে নিয়ে বললাম হ্যালো দোস্ত Alauddin Lovelu এটা আমার নতুন ফেসবুক আইডি৷ নামের বানানটাও কয়েকবার রিপিট করলাম যেন মেয়েটি ভাল করে বুঝতে পারে৷ এবার মোবাইলে স্বজোরে রিং বেঁজে উঠল৷ বেশ লজ্জাকর পরিস্থিতির মধ্যে পরে গেলাম৷ এবার মেয়েটির ঠোঁটে মুচকি হাসি দেখতে পেলাম৷ হাসি তো নয় যেন দুফালি চাকু যা হৃদয়কে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়৷ পরের বাস স্টোপিজে মেয়েটি নেমে পড়ল৷ যাবার আগে একবার ঘুরে তাকালো মিস্টি মুখে হেসে বলল এরপর থেকে সেলফোন সাইলেন্ট করে রাখবেন যেন এই লজ্জাকর পরিস্থিতিতে না পড়তে হয়। এর কিছুক্ষণ পর অনলাইনে আসতেই সমুদ্র কন্যা আইডি নামে একটা রিকুয়েস্ট আসল৷ প্রোফাইল পিকচার দেখে নিজের চোখকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না৷ পাশে বসা এই মেয়েটাই আমাকে রিকুয়েস্ট পাঠালো৷ তারপর মেয়েটির সঙে চ্যাট করলাম কখন যে আমার গন্তব্য পৌছে গেলাম বুঝতে পারলাম না৷ ছয়তলা ফ্লাটে বড় আপা থাকে৷ কয়েকটা গেটে জবাব দিহি করে তবেই মেলে প্রবেশের ছাড়পত্র৷ সিকিউরিটি বললেন বৈদ্যুতিক গোলযোগের জন্য সাময়িকভাবে লিফ্ট বন্ধ আছে৷ উপায়ন্ত না দেখে সিঁড়ি ভেঙেই ছয় তলা উঠতে হল৷ ছয়তলা উঠতেই কেমন হাপিয়ে উঠলাম৷ কলিং বেলে হাত রাখতেই বাসার গৃহকর্মী দরজা খুলে দিয়ে মিষ্টি মুখে বলল, ভাইজান আপনি? ম্যালা দিন হইল আহেন না। আহেন ভেতরে আহেন। ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলাম। এ বাড়ির দীর্ঘ দিনের পুররো গৃহকর্মী সে, নাম তার ফুলজান। প্রচন্ড ঘুম কাতুরে মেয়েটা। সুযোগ পেলেই যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়ে। অতি প্রয়োজনেও তাড়া দিলেও তার সাড়া মেলাভার। আর প্রচন্ড আত্নভোলা। একটা কথা মনে করতে তার দু দিন লেগে যায়। এর জন্য গাল মন্দও কম খেতে হয় না ফুলজানের। একদিনের ঘটনা, আপা ডালে ফোড়ন দেওয়ার জন্য ফুলজানকে কালোজিরা আনতে বলল, পথিমধ্যে ফুলজানের সঙ্গে আমার দেখা। জিজ্ঞেস করলাম,
— কোথায় যাও ফুলজান?
— কথা কয়েন না ভাইজন, নইলে যেটা আনতে কইছে ভুইলা যামু কিন্তু।
— তোমাকে কি আনতে বলেছে ফুলজান?
এবার ফুলজান চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, কি যেন আনতে কইছে? তারপর কালজিরার পরিবর্তে ভাল চিড়া নিয়ে হাজির।
ড্রইং রুমে বসে ফুলজানকে বললাম,এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারবি?
পারুম না ক্যান, আমি অক্ষুনি আনতাছি। গ্লাসে পানি ঢালতে গিয়ে অসাবধানতাবশত ফুলজানের হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে যায়। সাথে সাথে গ্লাসটি ভেঙ্গে কাঁচের টুকরো গুলো বিদ্যুৎ বেগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
আঁতকে ওঠে ফুলজান!!
উচ্ছ্বলতায় ভরা মুখটা মুহূর্তেই ভয়ে অম্লাণ,পাণ্ডুর হয়ে যায়। গ্লাসের টুকরো গুলো উঠাতে গিয়ে কাঁচের টুকরো হাতে ফোটে। বেশ রক্তক্ষরণ হতে থাকে। ভেতর থেকে আপা হাঁক দিয়ে বলে, আবার কিছু ভাঙ্গলি?
আপা অগ্নিশর্মা হয়ে ড্রইং রুমে আসে। আপার দামি প্রিয় গ্লাসটি ভেঙ্গে যাওয়ায় রাগান্বিত স্বরে বলে, ভেঙ্গে ফেললি তো? জানিস এর দাম কত? মামা বিদেশ থেকে পাঠিয়েছে। বাপের জন্মে এতো দামি গ্লাস চোখে দেখেছিস?
এই বলে ফুলজানেরর মুখে সশব্দে চড় বসিয়ে দেয় এবং তার বেতন থেকে গ্লাসের দাম কেটে নেওয়ার ঘোষনা জারি করে। কিন্তু ফুলজানের যে হাত কেটে রক্তক্ষণ হচ্ছে সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
আমি বললাম, আপা ওর তো হাত কেটে রক্ত পড়ছে। আপা বলল, ওসব ছোটলোকের এক আধটু কাটলে কিছু হয় না। ফুলজান কাঁদতে কাঁদতে রান্না ঘরে চলে গেল। আপা বলল, এক্ষুনি এলি?
এই একটু আগে।
তুই একটু বস, আমি আসছি।
এই বলে আপা ভেতরে চলে গেল। তখনো আমার তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেঁটে যাবার উপক্রম। এবার আমি নিজেই পানি ঢেলে খেতে গেলাম। অসাবধানতাবশত এবার আমার হাত থেকেও গ্লাসটা পড়ে গেল। এবার আপা আরো রাগান্বিত হয়ে তেড়ে আসল। কী! আবার কিছু ভাঙ্গলি? নাহ্ এই মেয়ে দেখছি আমাকে একেবারে ফতুর করে ছাড়বে। ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো গুলো তুলতে গিয়ে এবার আমারও হাতটা কেটে গেল। আপা আসতেই বললাম, আমার হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে ভেঙ্গে গেছে।
ও, তাই!! সামান্য একটা গ্লাসই তো! ও কিছু না। ওকি! তোর তো হাত কেটে গেছে। রক্তও গড়িয়ে পড়ছে।
ও কিছু না আপা।
কিছু না বললেই হলো। যদি কিছু একটা হয়ে যায়। আপা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, স্যাভলন ডেটল এনে ভাল করে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বললেন, আমি এক্ষুনি ডাক্তারকে ফোন করছি। ইনজেকশন দিতে হবে না হলে ইনফেকশন হতে পারে। আপাকে খুব অস্থির দেখাচ্ছিল। রান্না ঘর থেকে ফুলজানের ফুঁপিয় ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ আসছিল। সে কান্নার আওয়াজ যেন নিঃশব্দে ধীক্কার দিচ্ছে। ফুলজানের জন্য মনটা খারাপ লাগছে। একই রক্তে মাংসে গড়া মানুষ অথচ দু’জনের মধ্যে কত বৈষম্য।
আলাউদ্দিন লাভলু
কথা সাহিত্যিক