হঠাৎ দেখা ডুলুটি লেক

ভ্রমণ কাহিনীর শুরু কোথা থেকে হওয়া উচিত, যখন গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম তখন থেকে, নাকি যখন থেকে কোথায় যাওয়ার চিন্তা ভাবনা চলছে তখন থেকে? আমার কাছে মনে হচ্ছে, কিছুটা আগে থেকে শুরু করলে হয়তো ভালো লাগবে। এখন এই কিছুটা আগে মানে কতটুকু আগে সেটাও ঠিক বুঝতে পারছি না।

আমরা তানজানিয়াতে এসেছি ১৫ দিনের মত হয়েছে। সোহান ১১ মাসের একটা কোর্সে এখানে এসেছে। তার সাথে লেজ হিসাবে আমরাও এখানে আসার সুযোগ পেয়েছি। এখানে এসেই সোহান বেচারা কোর্সের নানারকম চাপে পরে গিয়েছে। প্রতিদিন অন্ধকার ফুরিয়ে যাবার আগে বাসা থেকে বের হয়ে যায়, ফিরে আসে অন্ধকার নামে যখন। সাপ্তাহিক ছুটি আমাদের জন্য অতি কাংখিত। সেদিন মানে ১৫ তম দিনটা ছিল শুক্রবার, দেশে শুক্রবার ছুটির দিন, আমার কাছে তখনো শুক্রবার মানেই ছুটির গন্ধ; কিন্তু সোহান এখানে অফিস করছে; দেশের ঝলমলে ছুটির দিনের কথা মনে করে মনখারাপ ভাব নিয়েই সারাদিন পার করে; বিকালে ফোন দিলাম,
—‘কখন আসবা?? শনি, রবি দুইদিন ছুটি পাবা তো? কাজ দিবে না তো’??

সে জানান দিল, এখনো কিছু দেয় নাই, মনে হয় ছুটি পাব। তার এক ঘন্টা পর ফোন দিয়ে বলে, এসাইনমেন্ট দিছে, এখন আসতে দেরি হবে আর রবিবারও আসতে হবে। এইসব শুনলে, কেমন লাগে!! একদা একটা সময় পার করেছি জেনে, ডিফেন্সের লোকজন ইন্টারমেডিয়েট পাশ। ২০০৯ থেকে তার সাথে বসবাস করে জেনেছি যুদ্ধবিদ্যাও পড়াশোনার কম বড় ক্ষেত্র নয়; আমার পড়াশোনা কোন অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে, তার পড়াশোনা, এখনো চলছে।

রাত্রি অন্ধকার করে বাসায় ফিরে সোহান; তারপর কোনরকম রাত পার করে সকাল হতেই আমাকে বললো,
—আজকে অফিসে যাই, এসাইনমেন্টের কাজ আর লেখা শেষ করে একবারে জমা দিয়ে আসি, তাহলে আগামীকাল বেড়াতে যেতে পারবো।

জামাই অফিসের কাজে বেশি ব্যস্ত থাকলে, বউয়ের চারপাশে অভিমানের বাষ্প ঘুরে বেড়াতে থাকে। কথা বলার কোন ইচ্ছাই হচ্ছিল না, যা খুশি কর গিয়া।

সেই যে সে অফিস গেল আর আসে না; বিকেলে অভিমানেরা সরে গিয়ে কোথা থেকে মায়ার বাষ্প এসে হাজির হলো। ফোন দিয়ে শুধাই, ‘কখন আসবা, আজকে শনিবার, ছুটির দিন ছিল’। সে বলে ৬০ ভাগ কাজ হইছে, এখনো ৪০ ভাগ কাজ বাকি। এখন চলে আসতেছি বাসায়, রাত জেগে লেখা লাগবে মনে হয়। বাসায় এসে কাহিল বেচারা বলে সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে এসাইনমেন্ট কলেজে জমা দিতে হবে। একটা কাজ করি, সকালে সবাই একসাথে বের হয়ে যাবো, কলেজে এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে, বেড়াতে চলে যাবো।

কিন্তু মেয়ের অনলাইন স্কুল ঈদের পর তার পরদিন থেকেই শুরু হবে। বাংলাদেশের সময় ৯.৩০ টায় কিন্তু তানজানিয়ান সময় ৬.৩০ টায়। আমি বলি, এত অস্থির হওয়া লাগবে না। মেয়ের তো ১০ টায় স্কুল শেষ হবে, মেয়ের ক্লাস শেষ হলেই না হয় বেড়াতে যাই। এর মাঝে তুমি এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে এসো। তখন পর্যন্ত জানি না, আদৌ যেতে পারবো কিনা বা কোথায় যাবো।

পরদিন ৬ টায় মেয়েকে ঘুম থেকে উঠিয়ে স্কুলের জন্য রেডি করলাম। আর সোহান লেখা শেষ করে চা নাস্তা খেয়ে কলেজে রওনা হলো এসাইনমেন্ট জমা দিতে। আমি মজা করে বলেছিলাম কেউ কি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে ওখানে, সকালে জমা দিলা নাকি দেখার জন্য। সে বলে লকার ক্লোজ করে দিবে, পরে আর দেওয়া যাবে না। আমি ঠিক জানি না দুনিয়া এত কঠিন কিনা; সে সারা জীবন তার দুনিয়া এত কঠিন হিসাবেই দেখায় আমাকে।

সাড়ে নয়টার মাঝেই সে বাসায় চলে আসলো। ছোট মেয়ে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। তাকে খাওয়াতে শুরু করলাম। আমরা রেডি না দেখে, সোহান আবার তার কাজে বসে গেলো। আমরা সব গুছিয়ে রেডি হয়ে, তাকে জানালাম এইবার টেবিল থেকে উঠেন সাহেব। তার বেশিক্ষণ লাগলো না রেডি হতে কিন্তু বাসা থেকে বের হবো কিভাবে চাবি খুঁজে পাচ্ছি না। সারা বাসা তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলাম কিন্তু পাচ্ছি না। চারজন মিলে চারদিকে খুঁজতেছি কিন্তু নাই চাবি। শেষ আগের দিন বিকালে আমিই দরজা খুলেছি কিন্তু চাবি কই রাখলাম। কি এক যন্ত্রণা, সবসময় ভেজাল একটা লাগবেই। আমি ভয়ে ভয়ে কয়েকবার বলেই ফেললাম দরজা লক না করেই যাই। সোহান কিছু বলে না, চাবি খুঁজেই চলেছে। বুঝলাম দরজা না লাগিয়ে যাবে না।

বহুত সময় পার করে অবশেষে চাবি খুঁজে পেলাম, মজার ব্যাপার যেখানে সবসময় রাখি সেখানেই ছিল শুধু কিছু একটার নিচে ছিল।

মনে হলো অনেক কিছু পাড়ি দিয়ে অবশেষে গাড়ি নিয়ে বের হতে পারলাম। মাউন্ট মেরুর পাদদেশে আরুশা অদ্ভুত এক সুন্দর শহর যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০০০ ফুট উঁচুতে। কিন্তু আপনি যখন শহরে ঘুরে বেড়াবেন তখন আপনার মনে হবে না আপনি পাহাড়ে, পুরোটাই সমতল ভূমি মনে হবে। শহরের যে প্রান্তেই যান না কেন, দেখবেন মাউন্ট মেরু আলাদা রূপ নিয়ে আপনার সাথে ঘুরছে। প্রতিদিনই আমরা মাউন্ট মেরুর রুপে মুগ্ধ হই। সোহানের ভেজাল ছাড়া কোন সাপ্তাহিক ছুটি পাওয়ামাত্রই আমরা মাউন্ট মেরু দেখতে দৌঁড়াবো, ইনশাআল্লাহ। এই শহরের আরেকটা প্রশংসনীয় ব্যাপার হলো অল্প কিছু রাস্তা পরপরই নার্সারি।আমার কাছে তো মনে হয় সারা শহর জুড়ে নার্সারী। আপনার মনে হতে বাধ্য, ফুল গাছ হলেও কয়েকটা গাছ কিনে ফেলি। যেমন আমার মাথাতেও ঘুরছে। নিতান্তই গাছ লালন-পালনে খুবই খারাপ বলে, সোহানকে জোর দিয়ে বলছি না কিছু। গাড়ি এখন আরুশা শহরের একমাত্র গল্ফ কোর্সের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। গল্ফ কোর্সের বাহিরের রাস্তার বহু বছরের পুরানো গাছের দিকে উদাসী চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ল, গাড়িতে স্পেয়ার চাকা লাগানো। দুইদিন আগে খুব সকালে সোহান কলেজে যাওয়ার সময় খুব ভয়ানক ভাবে গাড়ির টায়ার পাংচার হয়েছে। তখন থেকে স্পেয়ার চাকা গাড়িতে লাগানো। পরে জানতে পারলাম, তাপমাত্রা অনেক বেশি উঠানামা হলে এরকম হতে পারে। আরুশাতে এখন শীতকাল চলছে। সকালে রাতে ভয়ানক ঠান্ডা থাকে, সূর্য উঠলে তাপমাত্রা বাড়ে। তাপমাত্রার উঠানামায় টায়ারের ভেতরের প্রেশারের উঠানামা হয়, প্রেশার কম থাকলে খারাপ দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। এসব জানার পর থেকে আমি খুবই ভয়ে থাকি; সোহান সেই সকালে অফিসে যায়, রাতে আসে; তাই তার আর সময় হয় না ঠিক করার।

এই বেড়াতে যাওয়ার সময় আমি যদি এটা নিয়ে কিছু বলি, ঝাড়ি খাওয়ার সমূহ চান্স আছে। তাই আমি ঘুরিয়ে সোহানকে বললাম, তোমাকে খুবই সাহসী বলতেই হয়। স্পেয়ার চাকা গাড়িতে লাগিয়ে বউ বাচ্চাসহ ঘুরে বেড়াচ্ছ।

সে হেসে বলে, ‘সাহসী না বেকুব মানুষ, বেকুব মানুষের সাহস বেশি থাকে।‘ আমি বললাম, ‘আমি এই কথা বললে তো মুখ বেজার হয়ে যাইত তোমার’।

প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্য তখন সে আমাকে জানালো আমরা ডুলুটি লেকে যাচ্ছি। আরুশা থেকে মাত্র ১৪ কি.মি দূরে। যেহেতু আমাদের হাতে সময় বেশি নাই, আমরা এখানে ঘুরে ফিরে বিকালের মাঝে বাসায় চলে আসতে পারবো। মেইন রোড থেকে আমরা শাখা রোডে এখন উঠলাম। আরুশার মেইন রোড খুবই ভালো, বাম-ডানহীন সোজা রাস্তা, কিন্তু শাখা-প্রশাখা রাস্তার অবস্থা বেশি ভাল না, সব মাটির রাস্তা। আগের সপ্তাহে আমরা ঝর্ণা দেখতে গিয়ে, পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে যেতে হয়েছিল। সে অভিজ্ঞতার আলোকে এখন মাটির রাস্তা দেখলেই ভয় লাগে। লেকের ১ কি.মি বাকি থাকতে সোহান বলল, গাড়িটা এখানে রেখে আমরা বাকি রাস্তা হেঁটে যেতে পারি। ড্রাইভার সাহেব এই কথা বললে তখন তো অন্য কিছু বলার অপশন থাকে না। আমার একটু খচখচ লাগছে, গাড়ি এমন রাস্তার পাশে রাখলে কি ভালো দেখায়, অন্য কোন জায়গায় রেখে যেতে পারলে ভালো হতো। ১২ বছর সংসার করে আমি এখন এটুকু বুঝে গেছি এসব বলে আসলে লাভ নাই, মাঝখান থেকে আমার বেড়ানো হবে বেজার মুখে। তারপরও আমার ভাল লাগে নাই এই খানে গাড়ি রাখা, এইটা তো জানানো উচিত; তাই এক/ দুইবার এসব বলে, দুই মেয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই। ছোট মেয়ে নিয়ে বেশি সমস্যা না, সে মনের আনন্দে দৌড়াবে আর মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য পোজ দিবে। সব সমস্যা বড়টাকে নিয়ে, সে হাঁটতে চায় না, পুরোটা সময় প্যানপ্যান করতে থাকবে, আর কত দূর হাঁটতে হবে, পা ব্যথা করতেছে, বাবা কেন গাড়ি নিয়ে আসলো না, ওখানে যাওয়ার কি দরকার ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি ছোটটাকে নিয়ে সামনে সামনে হাঁটতে থাকলাম। এক তানজানিয়ান বুড়া সাইকেল চালিয়ে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সোহানকে কি কি যেন বললো। ভাষা কিছু বুঝা যায় না। কিন্তু ভাব দেখে মনে হলো, আমাদের দেশের বুড়োরা রাস্তায় কাউকে দেখলে বলে না, ‘কই যাও?? লেকে যাবা?? হ হ সামনেই সামনেই, যাও যাও।‘ আমার দেখে মনে হলো এটাই বলছে। দুসপ্তাহ আফ্রিকায় বসবাস করে আমার মনে হয়েছে, আফ্রিকান মানুষজন সহজ-সরল। সাইজে একটু বড়সড় কিন্তু ওরা মানুষ খারাপ না।

খানা খন্দ পার হয়ে সোহান বললো, ঝরা এখান দিয়ে তো গাড়ি যাবে, তোমরা সামনে আগাও, আমি গাড়ি নিয়ে আসি।

আমি ভালো মানুষের মত বললাম, আচ্ছা। নয়তো এখানে আমি তো বলতেই পারতাম, গত সপ্তাহে কি ভয়ানক উঁচুনিচু রাস্তা পার হয়ে পাহাড়ে উঠে গেলা আর এই সপ্তাহে সমতলে একটু কাঁদাপানি দেখে গাড়ি রেখে আসতে হইলো! বয়স হয়েছে তো তাই এখন আর এইসব হাবিজাবি কথা বলি না। আমার সবকিছুতে সেও হুঁ বলে, আমিও তার সব কিছুতে হুঁ বলি।

সোহান গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে প্রায়, সেবন্তি গাড়ি দেখেই দাঁড়িয়ে গেল, গাড়িতে উঠবে। ছোট মেয়ে উঠবে না, সে হাঁটবে। আমি বললাম লেকে গিয়েও হয়তো হাঁটতে হবে, আগে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে যেও না। সে রাজি হইলো, আমরা সবাই আবার গাড়িতে উঠলাম। এই রাস্তাটা আমাদের গ্রামের মেঠো পথের মত। পার্থক্য হলো চারপাশে অনেক গাছপালা, সূর্য উঠে নাই বলে এক টার মত বাজলেও অনেক ঠান্ডা। চারপাশটা ভেজা ভেজা লাগছে। লেকে পৌঁছানোর ৫ মিনিট আগে সোহানের আবার মনে হলো গাড়ি সাইড করে রেখে যাবে। আমরা আবার গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। সে গাড়ি সাইড করে রেখে আমাদের সাথে, হাঁটা শুরু করলো। অল্প সামনেই একটা ক্যাম্প সাইট দেখতে পেলাম। ভেতরে রেষ্টুরেন্ট আছে। রেষ্টুরেন্টের সামনে শেড দেওয়া বসার জায়গা। লেকের চারপাশে অনেক গাছপালা আর উঁচু উঁচু পাহাড়। লেকের পাড়ে গাছের ফাঁকে ফাঁকেও বসার জায়গা আছে। আরো অনেক ইউরোপীয় টুরিস্ট ছিল। ওরা খোঁজখবর নিচ্ছিল বোটে করে ঘুরতে কত লাগে। লেকের চারদিকে সরকারি ভাবে ওয়াকওয়ে বানানো। সেখানে হাঁটতে হলে টিকেট কাটা লাগবে। বোটে ঘুরতে আমাদের কাছে জনপ্রতি ৩০ ডলার চাইলো। চারজনের নৌকাভ্রমণ খুবই ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। আমরা ওখান থেকে চলে আসছিলাম, তখন বললো আমাদের জন্য কমিয়ে ২০ ডলারে দিবে। সেটাও তো আমাদের জন্য অনেক হয়ে যায়। সেখান থেকে বের হয়ে হাঁটবো ভাবছিলাম কিন্তু পাশেই আরেকটা কিছুটা সাদামাটা ক্যাম্প সাইট দেখে ওখানে ঢুকে গেলাম। সেখানেও একটা রেষ্টুরেন্ট আছে, রেস্টুরেন্ট দেখলেই আমার বড় মেয়ের চিকেনের ক্ষুধা পায়, আর ছোট মেয়ের ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের ক্ষুধা। এখানে খাবার অর্ডার করতে করতে জানতে চাইলাম নৌকায় ঘুরতে কত লাগবে , তানজানিয়ান একটা ছেলে হোসেইন জানালো, পুরোটা ঘুরতে ৮০০০০ শিলিং আর অর্ধেক ঘুরতে ৪০০০০ শিলিং লাগবে। আমাদের জন্য খুবই চমৎকার প্রস্তাব। সোহান তার সাথে কথা বলে সব কিছু ঠিকাঠাক করে গেল গাড়ি ক্যাম্প সাইটে নিয়ে আসতে।

এতক্ষণে লেকের পাশে একটু শান্তিতে বসতে পারলাম। ডুলুটি লেক হচ্ছে ভল্কানিক ক্রেটার লেক। অগ্নুৎপাতের কারনে পাহাড়টা মাঝখানে গলে দেবে যায়, আর চারদিকে অবশিষ্টাংশ পাহাড় উঁচু পাহাড় হয়ে রয়ে যায়, অনেকটা বেসিনের মত। সোহান বলল তানজানিয়ায় এরকম অসংখ্য ভল্কানিক ক্রেটার আছে। বেশির ভাগই তৈরি হয়েছে আড়াই মিলিয়ন বছর আগে। আগ্নেয়গিরিগুলো সব মৃত। তবে দুটো নাকি এখনও মাঝে মাঝে ঝাঁকুনি দেয়। উঁচু পাহাড়ে ঘেরা সবুজ ডুলুটি লেকের সামনে দুই বাচ্চা নিয়ে আমি অতি সাধারণ এক বাংলাদেশি মেয়ে বসে আছি। আমি কখনো কল্পনাও করি নাই মহান আল্লাহতায়ালা আমাকে এইখানে আসার সুযোগ করে দিবেন। আমি ফিরে ফিরে শুধু এই লেকের সৃষ্টির সময়টাতে চলে যাচ্ছিলাম। কি ভয়ানক শক্তিমত্তার আস্ফালন চলেছে এখানে!! পৃথিবী তার ভেতরকার যত উত্তাপ, অস্বস্তি, উম্মাদনা বের করে দিয়ে শান্ত-শীতল লেক হয়ে গেল।

রোদ উঠেছে, রোদ উঠলেই সেটা তীব্র হয়ে যায়। গরম কাপড় খুলে ফেলতে হচ্ছে। প্লাস্টিকের টেবিলের উপর জড়ো করে রেখে দিলাম। বাচ্চারা বিরক্ত করছে। লেকের পাড়ের মাটিতে তারা নানারকম পোকা খুঁজে পাচ্ছে। ছোট মেয়ে পা মাটিতে ফেলতেই পারছে না আর বড় মেয়ে এক কুকুরের ভয়ে সেঁটিয়ে আছে। তাদের বাবা এসে বকা দেওয়ার চেষ্টা করছে, এত ভয় পাওয়ার কি আছে?? যথারীতি তার বকাঝকায় কোন কাজ হচ্ছে না, মেয়েরা আতংকিত হয়ে রয়েছে। অন্য পাশে একটু পাকা মত জায়গা ছিল, মেয়েদের নিয়ে সেখানে গিয়ে বসার পর তারা ঠান্ডা হলো। হোসেইন এসে জানালো চিকেন দিতে দেরি হবে। আমরা বললাম কোন সমস্যা নাই, নৌকাভ্রমণ শেষ করে চিকেন খাওয়া যাবে। আপাতত ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দিলেই হবে। সোহান মেয়েদের পাখি দেখাচ্ছে, আমরা যেখানে বসেছি তার খুব কাছেই বড় একটা মাছ রাঙ্গা পাখি বার বার ঘুরে ঘুরে আসছিল। বাবা মেয়েরা মহা উৎসাহে পাখি দেখা শুরু করলো।

ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দিয়ে গেলো। এ কয়দিন তানজানিয়ান বিভিন্ন রেষ্টুরেন্টে খেয়ে মনে হলো ওরা খাবারে লবণ কম দেয়। ফ্রেঞ্চ ফ্রাইতে একদম লবণ দেয় না। লবণ নিজেরা দিয়ে খেতে হয়। এখানে অনেক বানর গাছের ডালে ডালে লাফাচ্ছে। নৌকায় ঘুরার সময় অতিরিক্ত কাপড়গুলো লেকের পাড়ে রেখে যাওয়ার সাহস হলো না, সোহান গাড়িতে রেখে আসলো। হোসেইন নৌকা চালাবে। চার সিটের নৌকা, মেয়েরা তাদের পছন্দমত জায়গায় বসে গেল।

লেকের পাড় ঘেঁষে নৌকা চলছে। এত গাছপালা যে লেকের পাড়ে যে ওয়াকওয়ে আছে সেটা বোঝা যায় না। আমি হোসেইনকে জিগ্যেস করলাম, ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটার সময় কি লেক দেখা যায়, আমি তো কোন রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না। যেখানে গাছপালা একটু হালকা হয়ে আসে, সেখান দিয়ে লেক দেখা যায় জানালো সে। সোহান বললো আরেকদিন আসা লাগবে হাঁটার জন্য। হোসেইন জানালো ৪ কিমি এর মত ওয়াকওয়ে। টিকেট কাটতে লোকালদের জন্য লাগবে ২০০০ শিলিং আর টুরিস্টদের জন্য লাগবে ২৩০০০ শিলিং। ১০০০ শিলিং ৩৬ টাকার মত। সব জায়গাতেই টুরিস্টদের কাছে থেকে এত পয়সা নেওয়া হয়, খুব খারাপ দুনিয়া!!

মাথা উঁচু করে পাহাড় দেখছিলাম। পাহাড়ের উপরের বাড়িগুলো ছোট ছোট দেখা যাচ্ছে। ঐ উপর থেকে লেকটা কেমন দেখা যায় সেটাও যদি দেখা যেত! পাহাড়ের উপর চোখে পড়ার মতো সুন্দর একটা বাড়ি দেখা গেল, সেটা এক জার্মান ভদ্রলোকের বাড়ি। তানজানিয়ান সরকার তাকে এই বাড়ি দিয়েছেন। পরে গুগল করে জানলাম ১৯৫৯ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট গোরংগোরো ক্রেটার সংরক্ষণের কাজে তার অবদানের জন্য খুশি হয়ে তানজানিয়ান সরকার তাকে এই বাড়ি উপহার দিয়েছে। ওখানে তাকালে এরকম একটা বাড়ির লোভ আপনারও হবে। সোহান অবশ্য এখানে বাড়ি বানাতে খরচ কেমন হবে হোসেইনের সাথে হিসাব-নিকাশ করে জানান দিলো, এখানে সে একটা বাড়ি কিনতে পারবে; আমি বললাম, শুধু দেশ থেকে প্রতিবছর এত টাকা খরচ করে সে বাড়ি দেখতে আসা হবে না আমাদের।

লেকের পানি একদম সবুজ কিন্তু টলটলে পরিস্কার। আমাদের সামনেই একটা আফ্রিকান মেছো ঈগল বড় একটা মাছ শিকার করে দ্রুত নিয়ে গেলো। হোসেইন ধীর গতিতেই নৌকা বাই ছিল আর সোহানের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল। এই লেকে সাঁতার কাটা এবং মাছ ধরা নিষেধ। লেকটি ভি-শেপ, মাঝখানে বেশ গভীর; প্রায় ১৫০ মিটারের মত বলে জানাল হোসেইন। লেকটি পাড় থেকে ধীরে ধীরে মাঝ বরাবর গভীর হয়ে গিয়েছে। সারাবছরই লেকে এমন পানি থাকে, ভূ-গর্ভস্থ পানি আর সারাবছরের বৃষ্টিপাত লেকের পানির উৎস। লেকের পানির উপরেই যে গাছপালা তাতে অনেক বাবুই পাখির বাসা দেখতে পেলাম। এছাড়া বড় পুরানো একটা গাছের উপর দেখলাম বিশাল বড় একটা পাখির বাসা। সোহান জানালো এটা হামার কপ পাখির বাসা। অনেক প্যাপিরাস গাছ; ঐ যে ছোট বেলায় পড়েছিলাম আমরা, প্যাপিরাস গাছ থেকেই কাগজের উৎপত্তি। ঝোপের নিচ দিয়ে পানকৌড়ি আর ডাহুক পাখি ঘুরছিল, মানুষের সাড়া পেয়ে লুকিয়ে গেলো।

সোহান কথায় কথায় হোসেইনকে জানালো আমি সোহেলী ভাষা শিখছি। আমি কটমট চোখে সোহানের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার চোখের সাইজ খুব খারাপ, হাসলে বেশির ভাগ সময় চোখ বন্ধ হয়ে যায়। তাই কটমট তাকানো, বাসার লোক ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না। হোসেন খুবই আগ্রহ সহকারে আমার দিকে তাকালো। আমার তখন ‘হাবারি’ ছাড়া কিছু মনে পড়ছে না। হাবারি মানে হলো হাই বা হ্যালো। আরও বলতে পারলাম, ‘মিমি নি সুরাইয়া’আমার নাম সুরাইয়া, ‘নাইস টু মিট ইউ’ শিখেছিলাম কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না, শুধু শেষের ‘না উইয়ে উইয়ে’ মনে পড়ছিল। হোসেইন নতুন একটা শব্দ শিখালো, ‘পোলে’ সহেলি ভাষায় অর্থ দুঃখিত কিন্তু ‘পোলে পোলে’ অর্থ ধীরে। এছাড়া কারিবু মানে হলো স্বাগতম, আসানতে মানে ধন্যবাদ, আসানতে সানা মানে অসংখ্য ধন্যবাদ।

লেকের পাড় দিয়ে চলতে চলতে লেকের মাঝখানে চলে আসলাম, এখন মাঝ বরাবর আমাদের ফিরিয়ে নিবে ঘাটে। ততক্ষণে সূর্যের আলো চলে গিয়েছে, সূর্যের আলো চলে গেলেই এত পিনপিন করা ঠান্ডা লাগে,মেয়েদের জন্য টেনশন লাগছিল, গরম কাপড় তো সব রেখে এসেছি। এতক্ষণ এত ধীরে চলছিল নৌকা, লেকের মাঝখানে দিয়ে ফেরার পথ দেখে মনে হলো নৌকা বেয়ে এই পথ পাড়ি দিতে তো রাত নেমে যাবে। কিন্তু আসলে বেশিক্ষণ লাগেনি। আমি শুধু পাহাড়ের উপর তাকাই আর ভাবি, ওখান থেকে লেকটা না জানি কত সুন্দর দেখায়, একটু যদি দেখা যেত; আহা! আমার যদি থাকত পাখির চোখ।

আমরা ঘাটে চলে আসলাম। দিন শেষ হয়ে যায়নি কিন্তু নীল আকাশের রঙয়ে লেকের সবুজ পানিও নীল হয়ে গিয়েছে। ফিরে যাওয়ার আগে, আমি আর সোহান শুধু ছবি তুলছিলাম। ক্যামেরাবন্দী প্রতিটা ছবি অপরূপ লাগছিল। মেয়েরা বাবামায়ের এই ছবি তোলার আতিশয্যে অতিশয় বিরক্ত হচ্ছিল। অর্ডার করা চিকেন প্যাকেট করে দিল হোসেইন। সেটা নিয়ে, মেয়েদের গাড়িতে তুলে, আবার ফেরার পথ ধরলাম।

আহ শান্তি!! তিন/চার ঘণ্টার ডুলুটি লেকের এই ভ্রমণ মনকে চড়ুই পাখির মত চঞ্চল করে দিল। আবার কবে কোথায় যেতে পারবো, তা তো জানি না। ততদিন পর্যন্ত ডুলুটি লেকই না হয় মনের আঙিনায় ফিরে ফিরে আসুক।

চলবে…

About

সুরাইয়া ঝরা

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}