স্কয়ার হাসপাতালে বসে আছি, একজন ডাক্তার দেখিয়েছি। আর একজনকে দেখাবো। মাঝে যেই বিরতিতে ও বললো- চা খাবে? বললাম -খাবো। আমি লেমন টি নিলাম ওকে বললাম তুমি কি চা খাবে? ও একটু হেসে বললো – তুমি যেটা খাবে তাই খাবো। হঠাৎ করে ওর চোখের মাঝে জলের মতো জমে থাকা ভালোবাসাটা আমায় ছুঁয়ে গেলো। ছোট্ট একটা কথা যে বলে সে হয়তো জানেই না কি ভিষণ মায়া জাগানো কথা। আমরা মেয়েরা মনে হয় এমনি ছোট ছোট সব কিছুর মাঝে ভালোলাগা এবং ভালোবাসা খু্ঁজে নেয়ই।আবার ছোট ছোট কষ্টে গভীরে দুঃখে মন ভাসে অপর পাশের মানুষ টা জানতেই পারে না।

আজ কাল প্রতিটি দিন কোন না কোন হাসপাতালে যাচ্ছি। চারপাশে পরিচিত অপরিচিত করোনা মৃত্যুর মিছিল। তবুও যাচ্ছি, উপায় নেই। ও অনেক অনেক ব্যস্ত। তবুও ছুটেতে ছুটতে ঠিক হাজির হয়, বলি – আমি একাই পারবো, তবুও ভিষণ বিষন্ন মুখে আমার সাথি হয়।

ওকে বলি আমায় সাদা বাড়িতে পাঠিয়ে দাও এক সপ্তাহে জন্য, দেখ আমি ঠিক ভালো হয়ে যাবো। সাদা বাড়ির এবং জগতপুরের সকাল, দীর্ঘ দুপুর এবং গোধুলীর যে রূপ থাকে তা যেন আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। প্রতিটি ঋতুর রূপ রং সুবাস আমায় বার বার ছুঁয়ে যায়।

আমার তখন বয়স কম নতুন সংসার। অনেক কিছু বুঝে উঠা হয় নি। মনটা বড় বেশি অভিমানি। কথায় কথায় অভিমান জমে। ওকে তখন প্রায় বলতাম আমি মরে গেলে কিন্তু আমার কবর দিবে আমার বাবার বাড়ির কবরস্থানে। ও হাসতে হাসতে বলতো- তা হয় না তোমার কবর হবে আমাদের বাড়িতে। আমি খুব মন খারাপ করতাম, এটা কেমন কথা? আমার কবরটা আমার ইচ্ছে মত হবেনা? কঠিন অভিমানে মনটা আমার ভাসতো।

সময়ের সাথে সাথে কতকিছু বদলে যায়। আমার ডাল পালা শিকড় ছড়িয়ে যায় জগতপুরের মুহুরি নদী, পানুয়া পাথার, জঙ্গলা পুকুর, কবিরা পুকুর, মনিপুর গ্রামের পথে। আমি যেন হয়ে যাই মুহুরী নদীর পাড়ের সেই মাটির পথের পাশের ফুটে থাকা বইছি ফুল।

আমার রুমের বারান্দা থেকে দেখা যায় কবিরা পুকুর পাড়ে এই বাড়ির কবরের স্হান। এই গ্রামের সব চাইতে হাসি খুশি প্রিয় কন্যাটি শ্রদ্ধেয় ফাতেমা বেগম এখানেই চির নিদ্রায় শুয়ে আছেন – আমার শাশুড়ি মা।

জগতপুর কিংবা সাদা বাড়িতে গেলে রাতে প্রায়ই ঘুম আসে না। ইচ্ছে করে রাতের প্রতিটি প্রহর আমি ছুঁয়ে দেখি।

সেই রাতটি ছিল শীতের রাত। হঠাৎ করেই যেন রাতটা গভীর হয়ে যায়। জোড়া কড়ই গাছের মাথায় বিশাল পূ্র্নিমার চাঁদ। বড় বড় ফোটায় শিশির ঝরে পড়ছে টুপটাপ শব্দে।কবিরা পুকুরের পানি ছুঁয়ে একটা ভিষণ শীতল বাতাস যেন ছুঁয়ে গেলো। আমি চাদরটা আর একটু ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিলাম। কি অপূর্ব মম জোস্ননা গলে গলে পড়ছে। হালকা একটা বাতাস বইছে। শান্ত কবিরা পুকুরের জলে ছোট ছোট ঢেউ ভাঙছে। ঢেউ গুলিতে চাঁদের আলো পড়ে চিক চিক করছে। ওপারে কবরে কত প্রিয় মানুষ শুয়ে আছে এই বাড়ির। কি এক মোলায়েম জোস্নার আলোর সাথে শীতল বাতাস বইছে প্রিয় মানুষ গুলোর কবরে। হঠাৎ করেই নাম নাজানা কয়েকটি পাখি আকাশে ডানা মেলে দিলো রাতের সমস্ত নিস্তব্ধতা ভেঙে। তখনি মনে হলো সারাটা জগতপুর গভীর ঘুমে। কোথাও কেউ জেগে নেই। শুধু আমি একা ঘুমহীন চোখে আর জেগে আছে রাতের প্রকৃতি।

চোখের সামনে ভেসে উঠলো আমার প্রিয় একটা ছবি। আমরা সবাই যখন জগতপুর বেড়াতে আসতাম ঈদের সময়। তখনো এই বাড়িতে ডুপলেক্স ইট সিমেটের বাড়ি উঠেনি। বাবার বানান রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ তোলা টিনের চালের পুরোন বাড়িটা। আমরা সবাই উঠানে মায়ের হাতে বোনা পাটি বিছিয়ে কত যে গল্প করতাম আর কারণে অকারণে হাসতাম। গরমের সময় তখন পল্লি বিদুৎ প্রায় আড়ি দিয়ে থাকতো। উঠুনে ঠিক একটা বাতাস বইতো। আমরা যতক্ষন গল্প করতাম মা ঠিক সিঁড়িতে বসে থাকতো কিংবা আমাদের সাথে বসতো। সারাটা দিনের কাজের শেষে চোখে জুড়ে ঘুম নামতো মায়ের চোখে। কোন ভাবেই মাকে ঘরে পাঠানো যেত না। আমি, ভাবি ( লুবনা), ননদিনী (খোদেজা) হয়তো গোপন কোন হাসির কথা বলতাম খুব নিচু গলায় কোন ভাবেই যেন মা না শোনে। আমরা যখন খুব হাসতাম আড় চোখে তকিয়ে দেখতাম মাও হাসছে। তাই দেখে আমরা আরো হাসতাম। কেমন এক মায়ায় মায়ায় জড়িয়ে থাকা পুরনো দিনগুলি।

উঠান জুড়ে খেলা করতো এই বাড়ির ছোট ছোট বাচ্চা গুলো – নিশি, পৌষি, রাসা, রাহা, অনক সাথে যোগ হতো আশেপাশের বাচ্চারা। এই যেন চাঁদের হাটে। আজও বার বার ছুটে যাই জগতপুরে । এখনো রাসা,পৌষী আমেরিকার , রাহা জাপানে। নিশি সংসার নিয়ে ব্যস্ত।অনক মহা ব্যস্ত আর্কিটেক্ট। এখন আর উঠুনে বাচ্চাদের হাসিতে ভরে উঠে না।মাঝে মাঝে বড় মন খারাপ করে সেই সব দিন গুলোর জন্য।

যখনি জগতপুরে যাই রাত গভীর হলে অমাবশ্যা পূর্নিমার চাঁদ কিংবা পঞ্চমীর চাঁদ যেমনই থাকুক না রাতের প্রকৃতি ঠিক কবিরা পুকুর পাড়ের সিঁড়িতে গিয়ে বসি। একটানা ঝিঁঝি পোকা ডাক প্রকৃতির নিরব আলাপন কাল পেতে শুনি। আর ভাবি ওপারে প্রিয় মানুষ গুলোর মাঝেই আমার কবর হোক আজ আর কোন অভিমান জমা নেই।

About

Nasrin Sultana

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}