গত দুই সপ্তাহ আগে গ্রুপের একটা পোস্টে কাক শব্দ প্রয়োগ করে একটা ছোট্ট কবিতা কমেন্ট হিসেবে করি। আমি চেষ্টা করি, কোনো বন্ধুর কবিতায় কবিতা দিয়ে কমেন্ট করতে। সেই কমেন্টের উত্তর পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি প্রতিউত্তর করতে সেদিন ভুলে গেছিলাম। আজ এই দুই সপ্তাহ পরে এক বন্ধু সেই কমেন্টে রিয়েকশন দেখানোয় আমার কাছে নোটিফিকেশন আসে। হায়রে কাক!

আমি তখন সদ্য চাকরিতে ঢুকেছি। ১৯৯২ সাল। বাংলাদেশ সচিবালয়ের প্রথম নয়তলা ভবনের সাত তলায় ৬২৭ নম্বর রুমে বসি। বাসা থেকেই খাবার নিয়ে যেতাম।

প্রথম দিকে ৮টা সেদ্ধ আটার রুটি একসাথে সুন্দর করে কাগজে পেচিয়ে গোল করে নিয়ে যেতাম। এতে করে আমার টিফিন ক্যারিয়ারের ঝমেলা থেকে বেঁচে যাই। দুপুরে এক কাপ দুধ চা দিয়ে এই আটটা রুটি সাবার করতাম।

আমার বসার পেছনেই জানালা ছিলো। একদিন হঠাত পেছনে নজর যায়। দেখি যে একটা কাক বসে আছে জানালার কাঁচের গ্রিলের ওপর। আমার তাকানোতে কাকটা উড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর দেখি আবার এসেছে। এবার আর আমি তাকালাম না। ভাবলাম, দেখি তো কাকের সাথে বন্ধুত্ব করা যায় কিনা।

এর পরের দিন আমি একটুকরো রুটি জানালার ওপর রেখে দিলাম। আর আমি যথারীতি চা দিয়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে রুটি খেত লাগলাম। কিন্তু না, কাক সেই রুটির কাছেও এলোনা। তবে জালালার গ্রিলে ঠিকই বসে রইলো। ভাবলাম, কেনো আসবে? আমাকে ওর বিশ্বাস কেনো করতে হবে? আমি আমার টেবিল থেকে সরে গেলাম। দূর থেকে লক্ষ্য করতে লাগলাম। অনেকক্ষণ পর কাকটা সেই রুটির টুকরো ঠোটে নিয়েই উড়াল।

আমি এ কাজটা এভাবেই কয়েকদিন করে যেতে লাগলাম। আমি পেছনে ফিরে তাকাই না। যখন আমি টেবিল থেকে সরে যাই তখনই কাকটা রুটি নিয়ে দেয় উড়াল। এভাবেই চলতে থাকলো। আমি মনে মনে ভাবি, কবে কাকটার ভয়ে কাটবে।

কয়েকমাস এভাবে চলার পর দেখি এখন দুটো কাক। আগে যেটা আসতো সেটার থেকে ছোট। বুঝাই গেলো কাকের বাচ্চা, তবে বড়। এবার আমি রুটি টুকরো বাড়িয়ে দিতে লাগলাম। কয়েকদিন যাবার পর দেখি চোট কাকটা আমার পেছনে এসে সেখানে বসেই রুটি খাচ্ছে। আমার আর টেবিল থেকে সরে যেতে হচ্ছে না। কাকের বাচ্চাটা বুঝে গেছে, আমি ওদের ক্ষতি করবো না। ওরাও একসময় বুঝে। আমি আরও একধাপ এগোলাম। এখন আমি নিজ হাতে রুটি ছিড়ে ছিড়ে কাকের বাচ্চার দিকে হাত বাড়ালাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার হাত থেকেই রুটি ছিড়ে ছিড়ে খেতে লাগলো। আর ওদিকে বড় কাকটা জানালার গ্রিলে থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। আমি বড় কাকটার দিকেও হাত বাড়ালাম। আমাকে নিরাশ করলো না। রুটির টুকরো আমার হাত থেকেই নিলো।

এভাবেই আমি সেদিন মা কাক আর বাচ্চা কাকের বিশ্বাস অর্জন করেছিলাম। ওরাও ভালোবাসা কিংবা শত্রুতা বোঝে। এরপর আমি জানালা দিয়ে কা কা করে অল্প শব্দ করলে যেখানেই থাকুক সাথে সাথে এই দুটো উড়ে চলে আসতো। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম। পরম বিশ্বাসে চুপ করে থাকতো, উড়ে চলে যেতো না।

এভাবেই চলতে থাকে। একদিন আমার অন্য ডিপার্টমেন্ট বদলি হয়। সেখানে চলে যাই। তবে প্রতি দুপুরে খাবারের সময় আমি আগের রুমে চলে আসি পুরোনো কলিগদের সাথে খাবার খেতে এবং কাকের সাথে বন্ধুত্ব নেভাতে। এভাবে চলতে চলতে অনেকদিন পর দেখি মা কাক আর আসেনা। আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। তবে বাচ্চা কাক ঠিকই আসে। ১২ বছর পর আমি সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দেই। এই দীর্ঘ সময় কাকটা প্রতিদিন আসতো। অফিস বন্ধের দিনগুলোতে নিশ্চয়ই মন খারাপ করে থাকতো!

আমার ইস্তফা দেবার আবেদন গ্রহন করা হয়না। বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। আমাকে তার জন্যে প্রায়ই অফিসে খোঁজ নিতে যেতে হয়। আমার যে তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি চাই। একসময় ছাড়া পাই। আমি চলে আসি।

অনেক অনেক দিন পর আমি পুরোনো কলিগদের সাথে দেখা করতে সচিবালয়ে যাই। কথা প্রসংগে জানতে চাই, কাকের বাচ্চাটা কি এখনও আসে? আপনারা কি খাবার দেন? তারা জানায়, মাসখানেক এসেছিলো। তবে আমরা কোনো খাবার দিলে তা নেয়নি। তারপর জানালো, একসময় আর কখনোই তারা কাকটাকে দেখতে পায়নি।

©আলম – ৮ আগস্ট, ২০২২ইং সন্ধ্যা ৬টা ৫০মি.

About

Alam M

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}