“স্যার, তৃষ্ণা আদা জল খেয়ে ম্যামের খোঁজ পাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।”
রুদ্রের এই কথায় পুরো বাড়িতে এক থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। আরহান চিন্তায় পড়ে গেলো। এর চেয়েও বেশি পড়েছে ভয়ে। তার শুকতারাকে হারানোর ভয়ে। আরহান যথেষ্ট ভয়ানক, হিংস্র। কিন্তু এর চেয়েও বেশি হিংস্রতা রয়েছে তৃষ্ণার মধ্যে। আরহান চাইলে, অনেক আগেই তৃষ্ণাকে শেষ করে দিতে পারতো। কিন্তু উদ্দেশ্য তার হারানোর। মেরে ফেলা নয়।
আর এদিকে আমি ভাবছি, আমাকে কেনো খুঁজছে? আর তৃষ্ণা নামটা শোনা শোনা লাগছে। কিন্তু কোথায় শুনেছি?
আরহান নিজের ভাবনার মাঝে একবার পেছনে ঘুরলেন। আমাকে এভাবে থম মেরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভীত হয়ে পড়লেন।
আমি উনাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। ঠিক আরহানের সামনে দাড়িয়ে প্রশ্ন তুললাম,“কে তৃষ্ণা? কেনো খুঁজছে আমাকে?”
আরহান দুটো শ্বাস ফেললেন। হয়তো সবটা বলার জন্য নিজেকে একটু প্রস্তুত করে নিলেন। আমার চোখে চোখ রেখে বলা শুরু করলেন,“সেদিন তোমার ভার্সিটিতে একটা ছেলে এসেছিলো না? সিঙ্গার! এই সেই তৃষ্ণা।”
তৎক্ষণাৎ আমার চোখে ভেসে এলো নীলাভ চক্ষুদ্বয়ের অধিকারী সুদর্শন সেই পুরুষটি। নেশাক্ত নয়নে কিভাবে যেনো আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে ইনি আমার খোঁজ কেনো করছেন?
আমার প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দেখে আরহান পুনরায় বলা শুরু করলেন,“তৃষ্ণা নারী আসক্ত। যাকে একবার চোখে ধরে, তাকেই ওর চাই। আর যে নারী একবার ওর চোখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে, সে নিজ থেকে ধরা দেয়। আমার সবচেয়ে বড় শত্রু তৃষ্ণা। আর আমার দুর্বলতা তুমি। তৃষ্ণা আমাকে হারানোর জন্য যেকোনো পর্যায়ে নামতে পারে। আমার দুর্বলতায় আঘাত হানতে পারে। তাই যতোটা সম্ভব তোমাকে আমি গোপন রাখতাম। কিন্তু সেদিন ভার্সিটিতে সেই নজর তোমার উপর পড়ে গেলো। তাই তো নিয়ে এলাম তোমাকে। আর এজন্য আমি একটুও অনুতপ্ত নই।”
আরহান খুব কৌশলে উনার শত্রুতার আসল ব্যাপারটা লুকিয়ে গেলেন। উনার কাজগুলো সে আমাকে জানাতে চায় না। হয়তো ভাবছেন, উনার শুকতারা এসব জেনে গেলে উনাকে আর মেনে নেবে না।
আমি স্তব্ধ দাড়িয়ে কথা শুনছি। এর মাঝে রুদ্র তার স্যারকে বলে বিদায় নিলো। আরহান আমাকে বললেন,“এবাড়িতে আর থাকা যাবে না। আমি সারাদিন থাকি না। আর বাড়িতে সার্ভেন্ট ছাড়া কেউ নেই ও। তৃষ্ণা যেকোনো সীমায় পৌঁছে যেতে পারে। কাল বিকেলেই বাড়ি যাবো আমরা। তোমার শ্বশুর বাড়ি।”
আরহান আমার হাতে, তার হাতের ব্যাগটি দিয়ে বললেন,“ভেবেছিলাম এখানে থাকবো বেশ কয়েকদিন। তাই এগুলো আনিয়েছিলাম। কোথাও মেয়েলি কিছু পছন্দ হলেই তোমার জন্য নিয়ে নিতাম। ভাবতাম,এই জিনিসটার আসল সৌন্দর্য তখনই আসবে, যখন আমার শুকতারার গায়ে জড়াবে।”
চলে গেলেন আরহান। আমি উনার ভালোবাসায় মুগ্ধ। এতটা ভালোবাসা আমার জন্য ছিলো? পরক্ষণেই আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম। বেশ গম্ভীর হয়ে ভেবে চলেছি,“দুনিয়াতে কি মেয়ে মানুষের অভাব পড়েছিলো?”
হাতের ব্যাগের দিকে একপলক তাকালাম। গিয়ে সোফায় বসে এটা খুললাম। ভেতরে আরো কয়েকটা বক্স আছে। এগুলোও খুললাম। একটাতে কিছু জোড়া নূপুর। একটাতে কাঁচের চুড়ি অনেক কালারের। একটাতে বেশ কয়েক রকমের ঝুমকা। মানে সাজ-সজ্জার প্রায় সবই আছে এখানে। ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে অজান্তেই হাসি চলে এলো।
_________________________
“কে আপনি? আর এখানে কাকে চাই?”
বাবা, তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বললেন। তৃষ্ণা বাঁকা হাসলো। ড্রয়িং রুমের সিঙ্গেল সোফায়, পায়ের উপর পা তুলে আয়েসি ভঙ্গিতে বাবার মুখোমুখি বসে আছে। ঠিক সামনে বাবার পাশে ছোট মা ও মীরা আপুও বসে আছে।
তৃষ্ণা রসাত্মক গলায় বললো,“আরে শ্বশুর আব্বা! জামাই প্রথম বার বাড়িতে এসেছে, আর আপনি অ্যাপায়ন না করে প্রশ্ন তুলে যাচ্ছেন! নট ফেয়ার শ্বশুর আব্বা।”
বাড়ির সকলের চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছে। তৃষ্ণার কথার আগা গোড়া, মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সবার। ছোটমা আর বাবা এবার মীরা আপুর দিকে তাকালো। আপু দুজনের এভাবে তাকানো দেখেই ফটাফট বলে দিলো,“আমি চিনি না। সত্যি বলছি। চিনি না।”
তৃষ্ণা হেসে দিয়ে বললো,“আরে বড়টা না। ছোট মেয়ের জামাই আমি।”
সঙ্গে সঙ্গে বাবা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। ছোটমার পুরনো কিছু মনে পড়তেই শুকনো ঢোক গিললেন। একই অবস্থা মীরা আপুরও।
সবার এমন অবস্থা দেখে তৃষ্ণা আন্দাজ করতে পারলো না ব্যাপারটা কি। ভ্রু কুচকে নিলো।
বিরক্তিকর ভঙ্গিতে বললো,“হবু। হইনি এখনও।”
বাবা ফুস করে আটকিয়ে রাখা শ্বাস ছাড়লেন। বড়জোর বাঁচলেন। তবুও মনের মাঝে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিলো। জিজ্ঞেস করে ফেললো,“সম্পর্কে ছিলো ও আপনার সাথে?”
তৃষ্ণা মৃদু আওয়াজে বললো,“না, ওকে আমার ভালো লেগেছে। এজন্য বিয়ে করতে চাই। আর আমি যা চাই, তা না পেলে ছিনিয়ে নেই। এখন ভালোয় ভালোয় বলে দিন ও কোথায়। নয়তো আপনাদের সাথে কি করবো ভাবতেই পারছেন!”
শেষোক্ত কথাটি বলার সময় হাতের গানটি দিয়ে নিজের অন্য হাতে স্লাইড করলো তৃষ্ণা। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে সবার। ছোটমা মনে মনে বলছে,“কি সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা! নাগর যুটিয়েছেও এমন। একজন ছাদ থেকে ফেলে দেয়, কিডন্যাপ করে আটকিয়ে রেখে বিয়ে করে নেয়। তো অন্যজন সোজা মারার হুমকি দেয়।”
বাবা খানিকটা কেশে সোজা গলায় বলে দিলেন,“ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছে।”
তৃষ্ণা দাড়িয়ে পড়লো। অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে আওড়ালো, “হোয়াট!”
___________________
রুশী তৈরি হয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে নিলো। সময়টা সন্ধ্যে। মাথাটা বা দিকে ঘুরিয়ে জানালার বাইরের পশ্চিমাকাশের দিকে একপলক তাকিয়ে বললো,“তোর নামে আমার আঙিনায় সহস্র সন্ধ্যে নামুক। যেখানে থাকবি তুই, থাকবো আমি। থাকবে আমাদের খুনসুঁটি। থাকবে তোর যত্ন। থাকবে আমার খামখেয়ালিপনা। থাকবে কিছু ভালোলাগা। আর থাকবে ভালোবা… নাহ্! আর কিছু না। আমার শুধু তুই থাকলেই চলবে।”
মুচকি হাসি দিয়ে পুনরায় নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নিলো। কল্পনায় আঁকলো অয়নকে নিয়ে কিছু প্রতিচ্ছবি। প্রায়শই করে এটা। এই যে, এখন ভাবছে, রুশী এখানে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছে। পাশে দাঁড়িয়ে অয়ন, মুগ্ধ নজরে রুশীকে দেখে যাচ্ছে। অয়নের সে কি চাহনি! চোখের মধ্যে কি আছে ওর? ভাবতেই লজ্জায় রুশীর ফরসা গাল দুটো লাল হয়ে এলো।
তখনই রুমে ঢুকলো রুশীর মা। রুশীকে উদ্দেশ্য করে বললো,“তৈরি হয়ে নিয়েছিস?”
রুশী মৃদু হেসে “হুঁ” বললো।
রুশীর মা একবার রুশীকে ভালো করে দেখে নিলো। মনে মনে বললো,“আমার মেয়েটা এতো সুন্দর! মায়ের নজর লেগে যাবে না তো আবার!”
নিজের চোখের নিচ থেকে একটা আঙ্গুলে কাজল ভরিয়ে নিয়ে রুশীর কানের পিছে লাগিয়ে দিলো। রুশী তার মায়ের এমন কাজে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। রুশীর মা পুনরায় মুগ্ধ নজরে নিজের মেয়েকে দেখলো।
খানিকক্ষণ বাদে বলে উঠলো,“নিচে আয় এখন।”
রুশী “আচ্ছা” বলে নিচে এলো ওর মায়ের সাথেই। এসেই সোফায় বসে থাকা দুজন বয়স্ক পুরুষ আর মহিলার সাথে একটা মেয়ে ও একটা ছেলে দেখলো। আন্দাজ করে নিলো, এই বয়স্ক মানুষ দুটি রুশীর বাবার বন্ধু ও বন্ধুর বউ আর এরা তাদের ছেলে মেয়ে। মেয়েটি রুশীর ছোট হবে।
রুশী ভদ্রতার খাতিরে হালকা হেসে সালাম দিলো। মহিলাটি সালামের জবাব দিয়ে উঠে এসে রুশীর পাশে দাঁড়ালো। মৃদু হেসে রুশীর থুতনিতে হাত রেখে বললো, “মাশাআল্লাহ! মেয়েতো ভারী মিষ্টি। আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে।”
_____________________
রাত অনেকটা বেজে গিয়েছে। খেয়ে দেয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি ছোট থেকেই কাজের মধ্যে থেকেই এসেছি। কিন্তু এখানে এসে আর কিছুই করতে পারছি না। না আছে ভার্সিটি, আছে পড়ালেখা আর না আছে বাড়ির কাজ। ভীষন বোরিং লাগছে। হয়তো কাল ওবাড়িতে যাবার পর আর এমন লাগবে না।
আরহান রুমে আছে। অফিসে না গিয়ে বাড়িতে বসেই কাজগুলো করছে। এদিকে এখন আমার ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। রুমের উদ্দেশ্য হাঁটা শুরু করলাম।
পুরো বাড়ি পিনপতন নীরবতা পালন করছে। তার মধ্যে আমার হাঁটার শব্দে আমি নিজেই ভয় পেয়ে যাচ্ছি। শব্দটা বেশ জোরালো ঠেকছে।
রুমের সামনে গিয়ে দেখলাম, দরজা হালকা খোলা। ধাক্কা দিতেই একটু শব্দ করে পুরোপুরি খুলে গেলো। আর সামনে মেঝের দিকে তাকাতেই আমার চোখ দুটো বড়সড় হয়ে গেলো। ভয়ে থরথর করে শরীর কাঁপছে। মুহূর্তেই ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছি। অস্ফুট স্বরে “মা! মা!” বুলি আওড়াচ্ছি।
আমার চোখের সামনে একটা লাশ উবু হয়ে পড়ে আছে। আর চারিপাশে রক্তের বন্যা। মিনিট দুয়েক যেতেই, শরীরের সম্পূর্ণ শক্তি খরচ করে চিৎকার করে উঠলাম। সেখানেই সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেলাম আমি।
চলবে…