গাড়ি আবার চলছে। লোকালয় ফেলে অনেকটা দূরে এসে গিয়েছে। তবে অসুস্থ হৃদযন্ত্র আমার এখনও কিছুক্ষণ আগের ঘটনা ভেবে কেঁপে কেঁপে উঠছে। এখনও লজ্জিত মুখশ্রীর রক্তিম আভা যায়নি। তখন যেভাবে সিটের সাথে এঁটে বসেছিলাম। এখনও ঠিক তেমনটি বসে রয়েছি।

এই তিনমাস আরহানের কাছে থাকা সত্বেও আরহান দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেই মনের সান্নিধ্য পেতে চেয়েছিলেন। বার বার চোখের সামনে ভেসে আসছে কিছুক্ষণ আগের আরহানের করা সেই কাজটি।

“গান শুনে আমাকেই ফিল করছিলে? এখন কাছে এলাম। নাও ফিল মি!”

কথাটি শেষ করেই দু-চোখের পাতায় পরপর দুটো চুমু খেয়েছেন। হৃদপিন্ড আমার কয়েকটা স্পন্দন মিস করে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গিয়েছিলো। আরহান বাঁকা হেসে সরে গেলেন। এরপর “এটুকুতেই এই অবস্থা! আর তো…” বলেই পুনরায় গাড়ি চালানোতে মনোযোগী হয়েছেন। তখন থেকে এরকম পাথরের ন্যায় বসে আছি। ইশ! কি লজ্জা!

কিছুক্ষণ বাদেই গাড়িটা একটা গ্রাম্য এলাকায় প্রবেশ করলো। গ্রামের সরু পথ। দুই পাশে সারি সারি গাছ। আরহান এসি অফ করে জানালা খুলে দিলেন। লজ্জা, সংকোচ সব সাইডে ফেলে, এই পরিবেশ উপভোগে মন দিলাম। শহরে থাকা ও বড় হবার মাঝে গ্রামে আসার কোনো সুযোগ পাইনি। জানালার বাইরে মাথা নিলাম। প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম একটা। মিষ্টি একটা সুবাস মিশে আছে এই প্রকৃতিতে। এখানে যানবাহনের কর্কশ আওয়াজ নেই। আছে পাখির মিষ্টি মধুর গান। কি সুন্দর লাগছে!

বিকেলের শেষ ভাগে এই প্রকৃতি যেনো বধূ বেশে আছে। হালকা লালচে আভা দেখা যাচ্ছে ঐ পশ্চিমাকাশে। মুগ্ধ নয়নে এই গ্রাম্য পরিবেশ উপভোগ করে যাচ্ছি আমি। আর আরহান উপভোগ করছে আমার এই খুশিতে পুলকিত হওয়া নয়ন জোড়া। আমার খুশিতে যেনো উনার পুরো পৃথিবী জ্বলজ্বল করে উঠে। ঠিক তেমন ভেবেই উনিও মুচকি হাসলেন। কিছুটা দূরে এসে গাড়ি থামালেন।

হুট করে থেমে যেতে দেখে আমি মাথা ঘুরিয়ে আরহানের দিকে তাকালাম। ততক্ষণে আরহান গাড়ি থেকে নেমে পড়েছেন। এপাশে এসে ডোর খুলে আমাকেও নামতে বললেন। অতঃপর নেমে গেলাম আমি।

আমার ডান হাতটি নিজের বা হাতের মুঠোয় বন্দী করে হাঁটা ধরলেন এই জনমানবহীন শান্ত রাস্তায়। আমিও হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে একটা নদীর কিনারায় চলে এলাম। একপাশে শুভ্র কাশফুল ফুটে আছে।

আরহান আমার হাত ছেড়ে গিয়ে নদীর কিনারায়, পানিতে পা ভিজিয়ে বসে পড়লেন। আমি উনার পিছে দাঁড়িয়ে আছি। আরহান মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন।

“বসে দেখো এখানে। ভালো লাগবে ভীষণ।”

আরহানের কথায় এগিয়ে গেলাম। শাড়ি নিয়ে পানিতে বসতে সমস্যা হচ্ছে। ভিজে যাবে তো। আরহানকে নিজের সমস্যার কথাটা স্বীকার করলাম।

আরহান হালকা হেসে বললেন,“তো ভিজুক না!”

আমিও আর কিছু না বলে বসে পড়লাম। আরহান কিছুক্ষণ বাদে বললেন,“এই জায়গাটা আমার ভীষণ পছন্দের একটা জায়গা। প্রায়শই এখানে আসি। ভাবলাম, তোমাকেও নিজের সব ভালোলাগার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।”

পাঁচমিনিট, দশমিনিট করে সময় চলছে। নীরবতার মাঝে এ যেনো একটা প্রশান্তিময় সুখ! আস্তে করে মাথা এলিয়ে দিলাম আরহানের কাঁধে। এই তো! আমার শান্তির স্থান। আর কি লাগে? আরহান হালকা হাসলেন। আমি চোখ বন্ধ করে এই মুহূর্তটা উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

কিছুক্ষণ বাদে চোখ দুটো খুললাম। মনে হলো সময় খুব একটা হয়নি। কিন্তু এ দেখি গভীর রজনী। আঁখি পল্লব মেলে এই জোৎস্না স্নাত রাতটি অবলোকন করে নিলাম। নদীর এই সচ্ছ পানিতে পূর্ণিমার এই চাঁদটা দেখলাম। মনে মনে বলে উঠলাম,

“আপনি আর আমি,

গভীর এক রাত, আছে পূর্ণিমার চাঁদ..

নির্জন এই পরিবেশে, আমার মাথার নিচে আপনার কাঁধ..

সাথে জোনাকির ডাক, আমার হাতের ভাঁজে আপনার হাত..!”

হুট করেই আরহান আমাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলাতেই আরহান আমার হাত ধরে আস্তে আস্তে দৌঁড়াতে লাগলেন। নদীর কিনারায় দৌঁড়িয়ে যাচ্ছে একজন যুবক ও একজন যুবতী। একদম মনে গেঁথে যাবার মতো দৃশ্য।

বেশ কিছু দুর আসতেই, আরহান পাশ থেকে এক গুচ্ছ কাশফুল হাতে তুলে নিলেন। একটু দুরত্ব বজায় রেখেই হাঁটু ভেঙ্গে বালিতে বসে পড়লেন। মাথা নিচু করে চুপ মেরে রয়েছেন। নিশ্চুপ আমিও আরহানের কথা বলার অপেক্ষায় আছি।

কিছুক্ষণ বাদে আরহান মাথা তুলে তাকালেন। পূর্ণিমার চাঁদের জোৎস্নায় আরহানের মুখশ্রী কি মায়াবী দেখাচ্ছে! চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে আরহানের। গভীর চক্ষুদ্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছি। এই আরহানকে ভীষণ পছন্দ আমার। ভীষণ!

কাশফুলগুলো আমার সামনে তুলে ধরে বললেন,

“পূর্ণিমা রজনীতে, খোলা অন্তরীক্ষের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে, এই প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমার সমস্ত সুখ তোমার নামে বরাদ্দ করে দিলাম। তোমার কষ্টসব অতি সন্তর্পনে নিজের করে নিলাম। ‘ভালোবাসি’ শব্দটা অনেক ছোট। আর বলবো না এটা, যতদিন না তুমি বুঝবে এই ভালোবাসার গভীরতা। ক্ষণে ক্ষণে ভালোবাসার চাদরে মুড়ে রাখবো তোমায়, ভালোবাসার সহস্র রং চেনাবো। মুখে বলা ছাড়া ভালোবাসার উপলব্ধি করাবো। এই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এভাবেই ভালোবেসে যাবো। পরপারেও শুধু তোমাকেই ভালোবাসা দেবো। গ্রহণ করবে কি আমাকে?”

_______________________

নিশুতি নিশিতে মাতাল তৃষ্ণা একটার পর একটা বোতল খালি করে যাচ্ছে। কষ্ট বাড়ছে বৈ কমছেই না। খুব করে চাচ্ছে নিজেকে নেশার সাগরে ডুবিয়ে রাখতে। কিন্তু বেঈমান এই নেশাদ্রব্য ওর কোনো প্রকার নেশা তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে না। আগের তৃষ্ণা এই কষ্ট লাঘব করতে, কোনো না কোনো নারীতে মত্ত থাকতো। কিন্তু এই তৃষ্ণা যে তার নয়নতারাকে ‘শেষ নারী তুমিই হবে’ বলে কথা দিয়ে ফেলেছে।

নির্জন বাড়িতে একা তৃষ্ণা, কষ্টের পাহাড় বুকে নিয়ে চিৎকার করেই যাচ্ছে। কিন্তু শোনার কেউ নেই।

“এতদিন পর কাউকে দেখে এতো মায়া কাজ করলো। কাউকে মনের মণিকোঠায় জায়গা দেবার সাধ জাগলো। কারো জন্য আমার আসক্তি বদলালো। হাজারো নারীতে আসক্ত আমিটা, সেই এক নারীতে আসক্ত পুরুষ হলো। আজ সেই মানুষটাকে খুঁজতে আমার এতোটা বেগ পোহাতে হচ্ছে! বুকটা পুড়ছে কেনো আমার?”

চিৎকার করে কথাগুলো বলে দম নিলো তৃষ্ণা। কষ্টের পাল্লা ভারী হয়ে গিয়েছে তার।

খোলা আকাশের পানে তাকালো। শূন্যে চোখ রেখেই আবারও বলা শুরু করলো,“ছোট থেকেই কষ্ট পাচ্ছি। একাকীত্বের কষ্ট। ড্যাড বিজনেসের কাজে সবসময় বাহিরে থাকতো। তবুও সাধ্যমত সময় দেবার চেষ্টা করতো। ভালোবাসতো খুব আমাকে আমার ড্যাড। আর মম! জানিনা কি পাপ করেছিলাম, মমের ভালোবাসা পাইনি কোনোদিন। অনিশ্চিত কারণ বশত মমের কাছে শুধুই অবহেলা পেয়েছি। কখনো আমার মম অন্য সবার মমের মতো মুখে তুলে খাইয়ে দেয়নি। কখনো আমার সাথে স্কুলে যায়নি। ছোটবেলায় স্কুলে দেখতাম, সবার মম এসে বসে থাকতো, যাবার সময় নিয়ে যেতো। তখন আফসোস করতাম শুধু, কেনো আমার ভাগ্যে সেই সুখ নেই। ধীরে ধীরে এই একাকীত্ব কে সঙ্গী বানিয়ে বড় হতে লাগলাম। দশ বছর বয়সে মামনিকে পেয়েছি আমি। আমাকে জন্ম দেননি। তবে আকাশসম ভালোবাসা দিয়েছেন। পৃথিবীতে যদি কাউকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবেসে থাকি, তবে সেটা আমার মামনি। মমতো বুঝলো না আমাকে। আমি যে ভালোবাসার কাঙাল ছিলাম। এরপর আমার সতেরো বছর বয়সে… ”

তৃষ্ণা থেমে গেলো। গলা শুকিয়ে এসেছে তৃষ্ণার। পাশ থেকে ওয়াইনের বোতল তুলে নিয়ে গটগট করে পুরোটা শেষ করে ফেললো। কেঁদে ফেললো তৃষ্ণা।

“কেনো করলে এরকম মম? এরকম না করলে আজ আমারও একটা পরিবার থাকতো। আমাকে এতিম হয়ে থাকতে হতো না মম। কেনো করলে এরকম তুমি?”

তৃষ্ণা আবারও চুপ মেরে গেলো। এসব মনে করতে চায় না। কষ্ট ছাড়া আর কিছু তো পাবে না। পুনরায় পুরো ধ্যান তার নয়নতারাতে দিয়ে বললো,“আরহানের গোপন সবজায়গায় খুঁজেছি আপনাকে নয়নতারা। আপনি কোথায় আছেন? কোথায় আপনি? আমার কাছে আসুন না। অনেক ভালোবাসবো আপনাকে। অনেক বেশি ভালোবাসবো।”

তীব্র কষ্ট, যন্ত্রণা ও আফসোসের সুরে গা ভাসিয়ে ফ্লোরে উবু হয়ে পড়ে রইলো নেশাক্ত তৃষ্ণা। তার কষ্ট দেখবে কেবল এই খোলা অন্তরীক্ষ, যার সমপরিমাণ তার কষ্ট।

____________________________

গভীর নিশিথিনি। চাঁদের জোৎস্না গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে গায়ে এসে মাখছে। এখনও আমার মনটা বড্ড অশান্ত। আরহানের কিয়ৎক্ষণ আগের সেই ভয়াবহ রকমের কর্মে আমি এখনও হতভম্ব। একটা মানুষ এভাবেও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করতে পারে?

তখন সেখানে আরহানের দিকে তাকিয়েছিলাম অনেকটা সময়। সময় কিভাবে অতিবাহিত হচ্ছিলো, তার বিন্দুমাত্র ধারণা আমার ছিলো না। একসময় আরহান উঠে দাঁড়ালেন। হাতের কাশফুলের গুচ্ছটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। স্তব্ধতা কাটিয়ে ঠোঁটে প্রশস্ত এক হাসির রেখা টেনে, ফুলগুলো নিলাম।

আরহানও হাসলেন। প্রাপ্তির হাসি! হুট করেই কি যেনো হয়ে গেলো আরহানের। হাস্যোজ্জ্বল মুখটা গম্ভীর করে নিলেন।

“আমাকে কতোটা বিশ্বাস করো?”

আরহানের এমন প্রশ্নে আমার কপাল কুঁচকে এলো। এই প্রশ্নটা এমন সময়ে হঠাৎ কেনো জিজ্ঞেস করলেন? আর মুখ খানা এমন গম্ভীর করেই বা কেনো জিজ্ঞেস করলেন?

আরহান পুনরায় প্রশ্ন করলেন,“কতোটা করো?”

এবার আর সময় নিলাম না। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিউত্তর করলাম,“যতোটা ভালোবাসলে চোখ বন্ধ করে পুরোটা জীবন সেই একজনের ইচ্ছেমতো চলা যায়। হয়তো ততোটাই। আমি চিনে গিয়েছি আপনাকে। আপনি কখনো আমার খারাপ চাইবেন না। আপনার প্রতিটি কার্যে কোনো না কোনো ভাবে আমার ভালোটাই লুকিয়ে থাকে।”

আরহানের গম্ভীর মুখশ্রীতে তখন পুনরায় হাসির রেখার দেখা মিললো। ফুলসহ আমার হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,“এই বিশ্বাসটা রেখো। শীঘ্রই তুমি, তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যের মুখোমুখি হবে। তখন বিশ্বাস করো আমার কথাগুলো।”

সেসময় অন্য কোনোকিছু না ভেবে বলে দিয়েছিলাম,“করবো। করতেই হবে। আপনার ভালোবাসার চেয়ে আমার বিশ্বাসের পাল্লা বেশি ভারী।”

“কি ব্যাপার! চাঁদ পাশে বসে আছে, তবুও তার শুকতারা অন্য কিছুর ধ্যানে মগ্ন। ব্যাপারটা কিন্তু ভীষণ মন্দ।”

আরহানের কথায় মাত্র হয়ে যাওয়া অতীতের খেয়াল ছেড়ে বর্তমানে মন দিলাম। স্থির দৃষ্টিতে তাকালাম উনার দিকে। পুনরায় এক মোহময় ভাবনায় ডুবে গেলাম। মস্তিষ্কে আরহানের কার্যকলাপগুলো প্রথম থেকে এই পর্যন্ত সব বুলিয়ে নিলাম। সম্পূর্ণ আরহানকে আমার চক্ষুদ্বয় দ্বারা অবলোকন করে নিলাম। ইশ! ভয়ংকর রকমের সুদর্শন এই পুরুষটি আমার! একদম কল্পনাতীত ব্যাপার স্যাপার।

এরই মাঝে হুট করেই আরহানের গাড়ির স্পিড বেড়ে গেলো অনেক বেশি। শুধু বাড়েনি, আরহানের গাড়ি আঁকাবাঁকা চলছে। একবার এপাশ তো আরেকবার ওপাশ। এতো দ্রুত বেগে চালানোর জন্য আমি অস্থির ভঙ্গিতে আরহানকে বললাম, “অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যাবে তো। আরহান! প্লিজ! ধীরে চালান। ভয় হচ্ছে তো ভীষণ আমার।”

আরহান বলে উঠলেন,“পেছনে কেউ শুট করছে।”

আমি সাইড মিরোরে দেখলাম, একটা গাড়ি ফলো করছে আমাদের। কিছুক্ষণ বাদে আমাদের গাড়ির স্পিড আরো বেড়ে গেলো। এরপর হুট করেই গাড়ি থেমে গেলো। থামতে না থামতেই একটা বিকট আওয়াজ কানে এলো, আমিও সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম।

চলবে…

About

নবনিতা শেখ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}