তেজহীন রোদ। চারিপাশে শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে। তবুও ঘামছি আমি। শুধু ঘামছি বললে চলবে না। ঘেমে নেয় একাকার হয়ে যাচ্ছি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। এমনও হয়? যাকে পুরোটা জীবন মৃত বলে আখ্যায়িত করে এসেছি, সে আমার সামনে আজ জীবন্ত দাঁড়িয়ে আছে। হুট করেই নিজেকে ভীষণ ভারী অনুভূত হলো। শরীরের ভার আমার পা জোড়া সইতে পারছে না। পা ভেঙ্গে আসছে। নিজের ভর রাখতে, আমি হাত এগিয়ে আরহানের বাহু খামচে ধরলাম। দৃষ্টি এখনও আমার সামনেই। আমার সামনের মানুষটা যেমন আমাকে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছে। ঠিক তেমনই আমি অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়েছি।
নিজেকে বিশ্বাস করতে না পেরে আমি আরহানের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি নিক্ষেপ করলাম। আরহান উপরনিচ মাথা দুলিয়ে আমাকে বোঝালেন, এটাই সত্যি।
তৎক্ষণাৎ আমার মস্তিষ্কে সেদিনের ঘটনা চলে এলো, যেদিন আমি এই শহরের রাস্তায় মাকে দেখেছিলাম। তখন নিজের চোখের দেখাকে ভুল মনে করে, ভুলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজ! পুনরায় আমি আবার আমার সামনে তাকালাম।
অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললাম, “মা!”
মুহূর্তেই আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি দুই হাতে মুখ ঢেকে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। কাঁদছি আমিও। তবে নিঃশব্দে।
“মা! আপু এসেছে?”—প্রশ্নটি করেই দীপ্তি এগিয়ে এলো এদিকে।
আমিও ততক্ষণে সামনে আরো একজনের উপস্থিতি টের পেলাম। সেদিকে তাকিয়ে আমি আরো বিস্মিত হলাম, যেমনটা দীপ্তি হয়েছে। চমকিত দীপ্তি চোখ দুটো বড় বড় করে ফেলেছে।
দীপ্তি আমার দিকে ইশারা করে মাকে প্রশ্ন করলো,“আপু?”
মা অশ্রুসিক্ত নয়নে দীপ্তির পানে তাকিয়ে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,“হুঁ।”
দীপ্তি আর অপেক্ষা করলোনা। তৎক্ষণাৎ দ্রুত বেগে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। দীপ্তিও কেঁদে দিয়েছে। যেমনটা আমি আর মা কাঁদছি। দীপ্তি কেঁদে কেঁদেই বলছে,“জানো বীনুপু? তোমার মতো একটা বোন চাইতাম আমি। আর তুমিই আমার বোন। আমার সত্যিকারের বোন!”
একের পর এক চমকের দরুন আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছি। বোন! আমার বোন!
দীপ্তি আমাকে ছাড়তেই আমি আর দেরি না করে মায়ের কাছে গেলাম। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম মা কে। এইতো আমার মা।
কাঁদতে কাঁদতেই মাকে বললাম, “ক’কোথায় ছিলে মা? জানো ত’তোমাকে ছাড়া আমি ভালো ছিলাম না। তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন ছিলো মা!”
মা ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,“আমাকে মাফ করে দে মা। আমি তোর কাছে অপরাধী।”
ঘটনা আমার কাছে একদম ঘোলা। অনেকটা স্বপ্নের মতোই লাগছে। তবুও আমি এই স্বপ্ন থেকে বেরোতে চাচ্ছি না।
আমাকে নিয়ে মা ভেতরে গেলো। আমি এখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছি। অপূর্ণতায় ঘেরা জীবনে, হুট করেই অনেক কিছু পেয়ে গেলে যেমনটা লাগে। তেমনটাই লাগছে।
বাড়িতে ঢুকে ড্রইং রুমের সোফায় আমাকে নিয়ে মা বসলো। আমি মাকে ছাড়িনি। জড়িয়ে ধরেই আছি। যেনো ছেড়ে দিলেই মা হারিয়ে যাবে।
আমার এই অবস্থা দেখে মা ঠোঁট চেপে কেঁদে যাচ্ছে। আরহান আমার এই কান্না আর সহ্য করতে না পেরে বললেন,“কেউ চলে যায়নি, হারিয়ে ফেলোনি কিছু, যার জন্য এভাবে কাঁদছো। পেয়েছো তুমি। খুশি হও না রে!”
আমি কান্না থামানোর চেষ্টা করছি। তবুও পারছি না। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, “কোথায় ছিলে মা? আমাকে কেনো একা রেখে গিয়েছিলে!”
হুট করেই মায়ের কান্না থেমে গেলো। মা ভয় পাচ্ছে। আমার এই প্রশ্নেরই তো ভয় পেয়েছে এই কয়দিন। মায়ের কাছে আমার কোনো প্রশ্নের উত্তর নেই। মাথা নিচু করে চুপ হয়ে আছে।
মাকে চুপ থাকতে দেখে আমি আরহানের দিকে তাকালাম। আরহান একবার মাকে দেখে পুনরায় আমার পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে পুরো ঘটনা বলা শুরু করলেন। আমি হতভম্ব হয়ে শুনে যাচ্ছি।
আরহানের কথা বলা শেষ হতেই দীপ্তি বলা শুরু করলো,“আমি বুঝতেই পারিনি, ভার্সিটির বড় আপু, যাকে নিজের আপুর মতোই ভাবতাম, সে আমারই আপু।”
সবাই সবার কথা ব্যক্ত করছে। আমি এখনও চুপ হয়ে আছি। কান্না থেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ আগে। মাকেও ছেড়েছি বেশ খানিকক্ষণ আগেই। আমার নিস্তব্ধতা দেখে সবার মনে ভয় ছেঁয়ে গেলো। তারাও চুপ হয়ে গেলেন। স্থির দৃষ্টিতে আমার সামনের এই তিনজন আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার চাহনি ফ্লোরে। মাথা নিচু করে বসে আছি।
অনেকক্ষণ বাদে হালকা কন্ঠে বলে উঠলাম,“আমাকে চাইলেই তো খুঁজে পেতে! তোমার সাথে যা হয়েছে, এতে আমার কী দোষ ছিলো মা?”
মা উত্তেজিত হয়ে উঠলো। আমার এমন প্রশ্নের জন্য একদম অপ্রস্তুত ছিলো সে। নিজেকে এক্সপ্লেইন করার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা করলো না। তবে অনুতপ্ত সে। ভীষণ অনুতপ্ত।
অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো,“আমি বুঝিনি বীনু। আমাকে মাফ করে দে মা।”
আমি মায়ের দিকে তাকালাম। কাঁদছি না আমি। তবে চোখ ছলছল করছে। আমি মাকে দোষ দিতে পারবো না। তার কোনো দোষ নেই এতে। হয়তো মায়ের জায়গায় থাকলে আমিও এসব ভেবে নিতাম। হয়তো আমিও এমনটাই করতাম।
ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললাম,“আমি আর কোনো প্রশ্ন করবো না তোমাকে। তোমাকে পেয়েছি আমি, এই অনেক আমার জন্য। এখন অতীতের হিসেব কষতে গেলে আমার বর্তমান নষ্ট হবে।”
_______________
বিকালের দিকে চারজন মিলে রওনা হলাম বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে। অপরাধীর অপরাধ একদিন না একদিন প্রকাশ্যে আসে। আর সে তার ন্যায্য শাস্তি পাবেই।
আজ দুপুরে মা নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে। সবকিছু সুখময় লাগছে। আমার মতো, আমার মা আর আমার বোনও ভীষণ খুশি আমাকে পেয়ে। তবে জানিনা এই খুশির মেয়াদকাল কতক্ষন।
গাড়ি দ্রুত গতিতে চলছে। আরহান ড্রাইভ করছেন। আর আমি উনার পাশের সিটে বসে আছি। ঘাড় ঘুরিয়ে আরহানের দিকে তাকালাম। উনি উনার সব কথা রেখে যাচ্ছেন। বিনা প্রত্যাশায়।
আরহান দৃষ্টি সামনে রেখেই আমাকে বললেন,“আমার ফোন থেকে রুদ্রের নম্বরে কল দাও।”
উনার ফোন আমার কাছেই ছিলো। কল লাগাতেই আরহান বললেন,“স্পিকারে দাও।”
আমি দিলাম। ওপাশ থেকে রুদ্র কল রিসিভ করতেই আরহান বললেন,“কতদূর আছো?”
“স্যার! এই তো রাস্তায় আছি। আধা ঘন্টা লাগবে।”
“ওকে।”
কল রেখে দিলাম। পেছনে দীপ্তি আর মা বসে আছে। দীপ্তি বিভিন্ন কথা বলেই যাচ্ছে। ছোট থেকে ওর সব ঘটনা, আমার সাথে ওর দেখা হাওয়া, ওর যেনো খুশিতে নাচতে ইচ্ছা করছে।
মিনিট বিশেক বাদে বাড়িতে চলে এলাম। মা আমাদের পেছনে আছেন। কলিং বেল বাজানোর দুই মিনিট পর ছোট মা দরজা খুললো। দরজার এপাশে আমাকে দেখেই বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেললো। আমার দিকে তার দৃষ্টি স্থির ছিলো সেকেন্ড পাঁচেক। অতঃপর আমার ডানে, আরহানকে দেখে তৎক্ষণাৎ ভয়ে ঘামা শুরু করলো। এমন নাজেহাল অবস্থার মানে আমার অজানা। যদি মাকে দেখে এমনটা হতো, তবে মেনে নেওয়া যেতো। কিন্তু মাকে তো দেখেনি।
কিছুক্ষণ বাদে মা সামনে এলো। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে যখন ছোটমার দিকে তাকালাম তখন দেখি, ছোটমার চোখ ছানাবড়া। ভয়ে জমে গেছে। কথা বন্ধ হয়ে গেছে। ছোটমা দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। তার অবাক মুখশ্রীতে ভয়ের ছাপ দৃশ্যমান। মুখে অস্পষ্ট বুলিতে “ভুত!” কথাটি লেগেই আছে।
ছোটমায়ের সাথে সাথে আমরাও ঢুকলাম ভেতরে। ছোটমা উচ্চ কণ্ঠে বারবার ডাকছে, “ব’বাসেদ! বাসেদ! ক’কোথায় তুমি?”
একবার পেছনে আমাদের এগিয়ে আসতে দেখে আবারও ডাকা শুরু করলো, “মীরা! বাঁচা আমাকে। মীরা!”
বাবা বাইরে বেরিয়ে এলেন। আজ অফিসে যাননি। ছুটির দিন তো! বাইরে এমন হট্টগোল শুনে বললেন, “কী ব্যাপার! কী হয়েছে এখানে?”
বাবা দেখেনি আমাকে কিংবা মাকে। দৃষ্টি সামনে এগিয়ে দিতেই যখন মায়ের সাথে বাবার চোখাচোখি হয়ে যায়, আঠারো বছর পর! বাবা চোখের চশমা খুলে আবারো পরে নিয়ে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললেন, “শ’শেফালী!”
ছোটমা দ্রুত পায়ে বাবার দিকে অগ্রসর হলো। ভীত কণ্ঠে বললো,“কিছু বলছো না কেনো? ভয় করছে আমার।”
ছোটমায়ের এমন ব্যবহার আমার কাছে পাগলামো ঠেকছে না। দীর্ঘকাল কাউকে মৃত বলে জেনে আসার পর, যদি সে আপনার সামনে জীবন্ত দাঁড়িয়ে থাকে, ব্যাপারটা যে কারো কাছে অবিশ্বাস্য লাগবেই।
বাবা এখনও চুপ। তবে তার চশমার ভেতর দিকে অশ্রুসজল নয়ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এদিকে মা ও আবেগ প্রবন হয়ে গেছে। হাজার হোক! কোনো এক সময় দুজন মানুষ একে অপরকে পাগলের মতো ভালবেসেছিলো তো!
তখন সেখানে আগমন ঘটলো রুদ্রের। সাথে আছে পুলিশ। দুজন মহিলা কনস্টেবল এগিয়ে গিয়ে ছোটমায়ের কাছে যায়। একজন ছোট মায়ের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন। ছোট মা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। এক প্রকার চিৎকার করছে। উপস্থিত যেসব মানুষ অতীত সম্পর্কে অজ্ঞাত, তাদের সবার মনেই বিভিন্ন প্রশ্নেরা উঁকি দিচ্ছে।
তখন মীরা আপুও এলো। বাইরে আমাদের সবাইকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে গেলো আপু।
মীরা আপুকে দেখে ছোটমা আতঙ্কিত কন্ঠে বলল, “কী হচ্ছে দেখ! বাঁচা না!”
মীরা আপু এগিয়ে এলো। ছোটমাকে ছাড়াতে চাইলো। কিন্তু পারছে না।
ছোট মা, “এসব কী হচ্ছে?’’ জানতে চাইলে আরহান বাঁকা হাসেন। রুদ্র ফটাফট উত্তর দেয়,“স্বর্গের টিকিট কেটে দেওয়া হয়েছে। আরামসে যান।”
চলবে…