নারী দেহের সবচেয়ে সুন্দর, স্পর্শকাতর, প্রয়োজনীয় অঙ্গের নাম স্তন। কারণ জঠরে (জরায়ু) সন্তান ধারণ আর তাঁর খাদ্য হিসেবে মায়ের বুকের দুধ মানব প্রজাতিকে এই পৃথিবীর বুকে সুরক্ষিত রেখেছে।

বয়ঃসন্ধিতে একজন কন্যা সন্তানের যখন শরীর বৃত্তীয় পরিবর্তনগুলো শুরু হয় মা এবং পারিপার্শ্বিকতা তাঁকে বুঝাতে থাকে এটা ভীষণ লজ্জার এবং গোপনীয় একটি ব্যাপার। পরবর্তীতে যতই বয়স বারে সেই ট্যাবু থেকে বেরোতে পারে না আর।

যতই শিক্ষিত আর আধুনিক হই বয়স বাড়ুক আমি সেই কন্যা সন্তানদের একজন, শত চেষ্টাতেও যে বেরোতে পারে না কৈশোরের ট্যাবু থেকে, আয়নায় দাঁড়িয়ে সাবান, তেল কিংবা ময়েসচারাইজার মেখে তাঁর নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করতে লজ্জা পায়, পুরুষ ডাক্তারের কাছে যেতে দ্বিধা বোধ করে।

স্তন আর জরায়ু মুখের ক্যান্সার ভীষণ কমন একটি ব্যাধি নিয়মিত চেক করলেই যা থেকে প্ররিত্রান পাওয়া সম্ভব। শুরুতে ধরা পরলে চিকিৎসায় নিরাময়যোগ্য।

আজ চৌঠা অক্টোবর আমার জন্মদিন। এবারের জন্মদিনে নতুন এক মাত্রা যোগ হয়েছে জীবনে, যার নাম ক্যান্সার। মাস খানেক আগে ১লা সেপ্টেম্বর রুটিন চেকআপে প্রথম জানতে পারি আমার শরীরে এসে বাসা বেঁধেছে সে । প্রথমেই যে কথাটি মনে এলো আমিই কেন ? সৃষ্টিকর্তা কেন বারেবারে আমাকেই বেছে নেন, এতো এতো কঠিন সব পরীক্ষায় ফেলেন?

অনেক করে কাঁদলাম। আব্বা-আম্মার কথা মনে হল, ভাগ্যিস তাঁরা বেঁচে নেই। শৈশবে পিতৃ হারানো আমার দুই সন্তানের কথা মনে পরল। চারিপাশে অমানুষের ভিরে মানুষ চেনা দায়, ওরা একা চলতে পারবে তো!

আমার কাছের মানুষেরা বুদ্ধি দিলেন কাউকে বলতে যেও না শত্রুরা খুশী হবে, সুযোগ সন্ধানীরা তোমার অসুস্থায় নিজের স্বার্থ হাসিলে তৎপর হবে।

তাছাড়া মানুষরা তোমাকে করুণার চোখে দেখা শুরু করবে যা সহ্য করতে পারা সম্ভব নাও হতে পারে।

যারা জানেন সবাই বলছেন আমি কেন অ্যামেরিকা, কানাডা, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক কিংবা নিদেন পক্ষে মুম্বাইয়ের টাটা বিরালা কিংবা কোকিলা ব্যানে যেয়ে চিকিৎসা নিচ্ছি না?

২০১০ সালে আমার স্বামী ডাঃ জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর যখন ক্যান্সার ধরা পরল সিঙ্গাপুরের গ্লেনিগালস, মাউন্ট এলিজাবেথ, অ্যামেরিকার হিউস্টনের এমডি এমডারসন সহ পৃথিবী খ্যাত সমস্ত হাসপাতালে ছুটে বেরিয়েছি ১৫ মাস। বাঁচাতে পারিনি। আসল ডাক্তার হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা তিনি যা চাইবেন তাই হবে।

না, অনিবার্য মৃত্যুকে মোটেও ভয় পাই না আমি। তবুও মাঝে মধ্যে মন খারাপ হয়, প্রশ্ন জাগে “আমিই কেন?”

কেমো নিলে মাথার চুল পরে যাবে, চেহারা খারাপ হবে, চামড়া খসখসে হবে কিন্তু তাতেই কি এসে যায় ? সৌন্দর্য নিয়ে কোন কালেও মাথা ব্যথা ছিল না, তবে আজ কেন অযথাই মন খারাপ হবে! এই যে রোগহীন এতোগুলো বছর পার করে দিলাম , সময়কে উপভোগ করলাম তাই বা কম কিসে।

যে তিনটি ক্যান্সার সহজে সেরে যায় তাঁদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার একটি । বাকী দুটো নারীর ইউটেরাস আর পুরুষের প্রোস্টেড ক্যান্সার। তবে সবার আগে ভাগ্য, অর্থাৎ তিনি কি চান।

খোঁজ নিয়ে জানলাম বিদেশ আর বাংলাদেশের মধ্যে চিকিৎসার ব্যবধান মোটেও বেশী নয় ক্ষেত্র বিশেষ বাংলাদেশ ভালো। উপরন্তু ক্যান্সার চিকিৎসার সাথে সাথে রোগীর মানসিক দিকটিও ভালো থাকা জরুরী । আমার জন্য যা বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও সম্ভব নয়।

কেমো ও রেডিও সহ পুরো এক বছরের দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসায় বাংলাদেশী চিকিৎসকরা যে যত্ন নিবেন বিদেশী ডাক্তারদের কাছে আমি সেই সেবা আশা করতে পারি না কিছুতেই। এটা হতে পারে আমার অন্ধ বিশ্বাস কিংবা দেশপ্রেম।

ক্যান্সার ধরা পরার পর জীবনের শুরু থেকে আতি-পাতি করে খুঁজছি কোথাও কোন ভুল হয়েছে কি, কিংবা কোন অন্যায়?

আমার বাসায় যতগুলো মেয়ে এযাবৎ কাজ করেছে প্রায় সবাইকে ফোন দিলাম, খোঁজ নিলাম । এমনিতেও সবসময় ওদের সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করি। না কারো কোন অভিযোগ নেই।

তবে কি আম্মা ! আম্মার শেষ সময়টায় সময় দিতে পারিনি, পাশে বসে গল্প করতে পারিনি মানসিক অসুস্থ ছিলাম বলে কিন্তু আম্মা তো সবসময় আমার সঙ্গেই আছেন।

জ্ঞানত কোন অন্যায় করিনি। একমাত্র অন্যায় আমার নিজের সাথেই । ঠকে যাচ্ছি জেনে বুঝেও অন্যের জীবনকে সহজ করতে চেয়েছি, সর্বাবস্থায় মানুষকে সাহায্য করতে চেয়েছি।

২রা সেপ্টেম্বর কোর বাইওপ্সি করার পর ৬ তারিখ রিপোর্ট ”সাস্পেকটেড কার্সিনোমা” আসায় পরের দিন ৭ ই সেপ্টেম্বর ”আহমেদ ক্যান্সার হাসপাতালে” ডাঃ আহমেদ সাইদ মাও ভাই আমার অপারেশন করেন।

১০ ই সেপ্টেম্বর বাসায় ফেরার পর ১১ তারিখ আমার মেডিটেশন শিক্ষক হারুন ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যেয়ে বললাম, ” হারুন ভাই আল্লাহ্‌ কেন আমাকেই বেছে নেন ?” মৃদু হেসে হারুন ভাই উত্তর করলেন, ” আপনি নিজেই নিজেকে কষ্ট সহিষ্ণু করে তৈরী করেছেন, মনের অগোচরে নিজেকে কষ্টের হাতে সপে দিয়েছেন।” অনুযোগের সুরে প্রায় চিৎকার করে বললাম, “আল্লাহ্‌ যে আমায় নরম হৃদয় দিছে, মায়া দিছে, মানবিক করে বানাইছে এতে আমার কি দোষ?”

প্রচণ্ড দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম সবাইকে জানাবো নাকি জানাবো না ? বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নইম নিজাম ভাই ফোন দিয়ে বললেন, ”ভাবী লিখুন, আপনার রোগ, চিকিৎসা, কষ্ট আর না বলা কথা যা ক্যান্সার আক্রান্ত অনেক নারীর চিকিৎসা আর পথ চলাকে সহজতর করবে, তাঁদের সাহস ও সান্ত্বনা যোগাবে।

সত্যিই তো জীবনের পুরোটা সময় চেষ্টা করেছি অন্যকে সহায়তা করার, এতো বড় সুযোগ কেমনে হারাই। বাংলাদেশে গ্রামে গঞ্জে কতো নারী ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত। তাঁরা জানে না কি করবে, কোথায় যেয়ে চিকিৎসা নিবে ? এমন কি এটাও জানে না তাঁরা ক্যান্সার আক্রান্ত।

ক্যান্সারের সাথে আমার নতুন এই পথ চলায় আপনাদের সাথে রাখছি, যদি রোগকে পরাজিত করতে পারি ধরে নিবো আপনাদের দোয়া আর শুভকামনার ফল আর যদি হেরে যাই তবুও দুঃখ নেই কারণ স্রস্টার ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সমর্পিত মানুষ আমি। দরখাস্ত থাকবে দোয়ার।

About

Khugesta Nur E Naharin

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}