আজিমপুর টু উত্তরা
ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
আনোয়ার হাকিম।
(১০)
শেষ পর্যন্ত জামান ভাইয়ের ঢাকায় বদলীর আদেশ হয়েছে। হেড অফিসে। এতে আমার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। কারণ দুটি। এক, বদলী হয়ে ঢাকাতেই যাচ্ছেন তিনি। তাই দেখা সাক্ষাতের সুযোগ থেকেই যাচ্ছে। দুই, চান্স পেলেই তিনি আমাকে টান দেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। একদিকে সাময়িক বিচ্ছেদ। অন্যদিকে মিলনের সম্ভাবনা।
জামান ভাই নিয়ে আমার কৌতুহলের এখনো সমাপ্তি হয়নি। শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছি যে তার এই বিরহ যাতনার মূলে আছে ওয়ান সাইডেড লাভ। আর এটুকুও আঁচ করতে পেরেছি যে সেই ভদ্রমহিলা এখনো অকৃতদার। বিত্ত বৈভবে উচ্চ আর চিত্ত বিলাসে মত্ত সেই ভদ্র মহিলার পারিবারিক অবস্থা নাকি হাই ফাই। জামান ভাইদের ফ্যামিলির সাথে নাকি যায় না। যতই বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসছে ততই একাকীত্বের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ক্রাশ প্রোগ্রামের মত করে এরিমধ্যে ঘুরে এসেছি সাজেকসহ বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। এই প্রথম চাক্ষুষ করলাম, বলাচলে, উপলব্ধি করলাম, নিঃসর্গের কোন অস্থিরতা নেই, কোন উচ্চবাচ্য নেই। সর্বত্র সবুজের সমারোহ, পাখ-পাখালীর পদচারণা, কল-কুঞ্জন। ঝর্ণা আর ছড়ার কুলকুল রব ও নিরবধি বয়ে চলা। আর রয়েছে উপত্যকার বন্ধুরতার সাথে মানুষের প্রাকৃতিক মিতালী। জামান ভাইকে আমরা সহকর্মীরা রাতের কোচে তুলে দিলাম। বিদায়ী হাত তুলতে গিয়ে চোখের জল টুপ করে ঝরে পড়লো। ভাগ্যিস রাত। কেউ দেখেনি কারো অশ্রুপাত। বুকের ভেতর অশান্ত মহাসাগর। সেই রাতে আর ঘুম এলো না। জামান ভাইকে যতই ভুলে থাকার চেষ্টা করছি ততই তা বলগ দিয়ে উপচে পড়ার মত উথলে উঠছে। এভাবেই ফজরের আযান হলো। আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম। ঘুম হতে নামায উত্তম।
মনটাতে বিদ্যুৎ শক দিয়ে গেল। নিজেকে বড় বেশি অপরাধী মনে হলো। মহান আল্লাহতায়ালা দিনকে করেছেন রাতের অধীন। আর রাতকে রেখেছেন প্রশান্তির জন্য। ঘুম হলো তাঁর তরফ থেকে প্রদত্ত প্রকৃষ্ট নিয়ামত। আবার ঘুম হতে উত্তম হলো এই ফজরের সালাত। এরই আহ্বান এড়িয়ে যেতে সাহস হলো না । কবে কোনদিন ফজরের সালাত সময়মত পড়েছি মনে করতে পারছিনা। জামাতে তো নয়ই। ওযু করে গেইটে তালা মেরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে মসজিদের দিকে পা বাড়ালাম। আজ এই প্রথম মনে হলো আমি যথার্থই অসহায়। আত্মসমর্পণ ভিন্ন শান্তির বিকল্প পথ আমার জানা নেই। নামায শেষে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে বসলাম। বললাম, “রাতে ঘুম হচ্ছেনা। ডাক্তারের পরামর্শ মতে ওষুধ খাচ্ছি। কিন্তু কাজ হচ্ছেনা”। ইমাম সাহেব শুনলেন। শান্ত কন্ঠে বললেন, “পেরেশানি থাকবেই। সবর আর সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন। দেখবেন শান্তি পাবেন”। বাসায় ফিরছি। ততক্ষণে চারিদিক আলোকিত হয়ে গেছে। প্রকৃতিও নিদ্রা শেষে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছে। মনে প্রশান্তির হিমবাহ বইছে।
শৈলীর ফোন। অপ্রত্যাশিত। ধরলাম। আজ তার এইচ এস সি রেজাল্ট বেরিয়েছে। সে যথাকাম্য গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। দারুণ খুশি। বললো, “ স্যার, আপনি তো ফোন করে উইশও করলেন না একবার”।
— আসলে আজই যে রেজাল্ট বেরিয়েছে কাজের চাপে তা খেয়াল করিনি। স্যরি
— স্যরি বললেই তো হবে না
— তাহলে
— ঢাকায় এলে আমাদের বাসায় আসতে হবে
— আমি তো ঢাকায় কম যাই
— এখন বেশি বেশি আসবেন
— কেন?
— বারে! আমি বুয়েটে ভর্তি হতে চাই যে
— সে জন্য ভাল করে ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং করো। সেখানে ভর্তি হও
— তাতো হবোই। তবু আপনাকে চাই।
— সে পরে দেখা যাবে
— সে হবে না। আপনি পরে আর আসবেন না
— কেন?
— আপনার বিয়ের দাওয়াতও তো দিলেন না
— আমি বিয়ে করেছি তোমাকে কে বললো?
— করেন নি? আল্লাহ বাচাইছে
— মানে কি?
— মানে কিচ্ছু না। এত মানে মানে করেন কেন?
— তুমিই তো কি সব আবোলতাবোল বলছো
— মোটেই আবোলতাবোল না। তাছাড়া আমার ট্রিট তো পাওনা হয়ে গেছে।
— কিসের ট্রিট?
— বাহরে! মনে নাই? ভাল রেজাল্ট করলে ট্রিট দেবেন বলেছিলেন।
— হুম্ম।
— ঘাবড়ে গেলেন?
— না, তা কেন?
— আচ্ছা রাখি। ভাল থাকবেন। এখন থেকে প্রতিদিন ফোন দেবো। ধরবেন কিন্তু।
শৈলীর আচরণ আরো ডেসপারেট হয়েছে বলে মনে হলো। আমার এই ছাত্রীটি দেখতে যেমন অসম্ভব সুন্দর তেমনি দারুণ চটপটে। সারাক্ষণ বকরবকর করবে। বিশেষত আমি পড়াতে গেলে তার কথার চোটে আর প্রশ্নের ঠেলায় আমার নাভিশ্বাস উঠে যেত। শৈলী দুষ্টুমী মাখা হাসিতে মজা লুটতো। পরক্ষণেই বলত, “স্যার, মনে কষ্ট পেয়েছেন”?
— কেন? আমার প্রশ্ন।
— এই যে আপনাকে এত বিরক্ত করি। পড়া বাদ দিয়ে আপনার সাথে অন্য প্রসঙ্গে আলাপ করতেই থাকি। অথচ
জানি আপনি এসব পছন্দ করেন না।
— তাহলে করো কেন?
— ভাল লাগে। আপনি রাগ করেন। সেটা দেখতে খুব ভাল লাগে।
— আর কি ভাল লাগে?
— আপনার দেওয়া হোম ওয়ার্ক করেও মিথ্যা বলি
— কেন?
— আপনার রিয়েকশন দেখতে।
— কি দেখতে পাও?
— আপনার রিয়েকশনে মাশাল্লাহ একটা ভাব আছে।
— তাই নাকি?
— হুম্ম। আপনাকে তাই আমার খুব খুব ভাল লাগে। লাভ ইউ।
আমার অন্তরাত্মা শিউরে উঠে। ছোটবেলায় গল্প-কাহিনী, সিনেমা-নাটকে টিউশন মাস্টারের প্রেম কাহিনী এবং পরিণতিতে ঘর জামাইয়ের চিত্র ভেসে উঠলো। ধমকের সুরে বললাম, “ওসব আজেবাজে চিন্তা বাদ দাও। নইলে কাল থেকে আমি আর আসবো না”। অমনি তার চোখ ছলছল করে উঠলো। অভিমান প্রকাশের জড়তা চোখে মুখে স্পষ্ট। আমার কেমন যেন মায়া হলো। এ বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে সাময়িক এই ইনফেচুয়েশন ভাব থাকা স্বাভাবিক। আজ শৈলীর এই খুশির খবরে টিউটর হিসেবে নিজেকে খুব গর্বিত ও খুশি খুশি লাগছে। তার বাবা মায়ের ইচ্ছে মেয়ে ডাক্তার হবে। আর শৈলীর ইচ্ছে সে ইঞ্জিনিয়ার হবে। তাও আবার বুয়েটের। কেন? আমি বুয়েটিয়ান বলে? বালিকাদের কোন আচরণই সিরিয়াসলি নিতে নেই। যদিও তাদের আচরণে একটা অবিনাশী প্লব্যতা থাকে।
একদিনের কথা মনে পড়ে গেলো। বাসায় কেউ নেই। কাজের বুয়া ছাড়া। আমি বুঝতে পারিনি। শৈলী সেদিন অন্যরকম উচ্ছল। পড়াতে খেয়াল নেই। যত মনোযোগ আমাতে। বললাম, “তুমি যে এমন করো আমার টিউশনি টা তো চলে যাবে”।
— যাবে না
— কেন?
— বাবা আপনাকে পছন্দ করেন
— কেন?
— আমার রেজাল্ট ভাল হচ্ছে। আমি বাবাকে আপনার ব্যাপারে সার্টিফাই করেছি
— আর তোমার আম্মা?
— আম্মার কথা ছেড়ে দেন। খালি পাহারা দেয়
— কেন?
— এই আপনার সাথে যদি ইয়ে হয়ে যায়
— সেজন্যই তো বলছি, পড়ায় মন দাও
— দূর, খালি পড়া আর পড়া। ভাল্লাগেনা।
বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় শৈলীকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলেছিলাম যদি রেজাল্ট ভাল হয় তাহলে ট্রিট দেবো। এ কথা শুনে পারলে সে লাফ দেয়। তার মা হন্তদন্ত হয়ে আসে। আমি লজ্জায় হতভম্ব হয়ে পড়ি। শৈলীই সে যাত্রা সামলে নেয়। সেদিনের সেই নেহায়েত উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলা কথার কথা আজ আর ফিরিয়ে নিতে পারলাম না।
সেলিমের খোঁজ এখনো মেলেনি। মলির মানসিক অবস্থা খুব খারাপ। বাসায় কোন প্রাণ নেই। যা আছে তা গোরস্থানের শুন শান নিরবতা। এখানে থেকে আমার করার কিছু নেই। মামারা খোঁজ খবর করছেন। যে নিজে থেকে নিরুদ্দেশ থাকে তাকে খুঁজে বের করা খুব সহজ না।
পড়ন্ত বিকেল। অফিসে বসে আছি । ভাবছি অনেক কিছু। এলোমেলো। জীবন বৈচিত্র্যময় জানি। তাই বলে এত বৈচিত্র্যের প্রয়োজন আছে কি? দুঃখ না থাকলে সুখ কি জিনিস তার গুরুত্ব বুঝা যেত না, সেটা ঠিক। তাই বলে অতলান্ত দুঃখের খুব বেশি প্রয়োজন আছে কি? হঠাৎই ভুত দেখার মত চমকে উঠি। টেবিলের সামনে ব্যাগ হাতে উসকোখুসকো চেহারা নিয়ে মাথা নিচু করে সেলিম দাঁড়িয়ে আছে। ভুত দেখছি না তো? সেলিমই ধপাস করে চেয়ারে বসে বিলাপের সুরে নিম্নস্বরে বললো, “ভাইজান, পৃথিবীতে আমার আর যাওয়ার জায়গা নাই। মাটির নীচে ছাড়া”। আমি নিখোঁজ ব্যাক্তির সন্ধান প্রাপ্তির আনন্দে, অবিমৃষ্যকারী এক ব্যাক্তির প্রতি দারুণ ক্রোধে ও ছোট হয়ে আসা পৃথিবীর একজন সেলিমের স্বীকারোক্তিসহ নিঃশর্ত আত্মসমর্পনের মায়া মায়া মুখের দিকে চেয়ে নির্বাক থাকলাম কিছুক্ষণ। পৃথিবীর বৈচিত্র্য নিয়ে ভাবছিলাম অনেক কিছু। এর চূড়ান্ত প্রমাণ আমার সামনে এ মুহুর্তে হাজির। বললাম, “খাওয়া-দাওয়া হয়েছে কিছু”? মাথা নীচু করে নিরুত্তর থাকলো। বুঝলাম হয়নি। বাসায় নিয়ে এলাম। বাবুর্চিকে পাঠালাম খাবার আনতে। বোনকে চমকে দেওয়ার উত্তাপে ফোন দিলাম। আম্মা ধরে বললো, “সকাল থেকে ওর শরীর খারাপ। প্রেসার খুবই লো। শরীর দুর্বল। খাওয়া-দাওয়া নাই। আবোলতাবোল বকছে। ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়েছে। ঘুমুচ্ছে”। আম্মাকে সেলিমের কথা বললাম। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সেলিমের উপর নতুন করে মায়ার বদলে ক্রোধ বাড়তে লাগলো। বৈচিত্র্যের রঙ বোধহয় ক্ষণে ক্ষণে এভাবেই বদলায়।
চলবে…