আজিমপুর টু উত্তরা
ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
আনোয়ার হাকিম।
(১৬)
জেমির আর কোন খবর পাওয়া যায়না। ইলমাও ফোন ধরেনা। নিরর্থক জেনেও ওদের বাসার সামনে দিয়ে ঘোরাঘুরি করি। নিজের কাছেই ব্যাপারটা অশোভন ঠেকে। বাসার সিকিউরিটি গার্ডের সাথে দেখা হয়। কথাও হয়। কিন্তু আসল কথা জানা যায়না। শুধু এটুকু জেনেছি জেমি অসুস্থ। হাসবেন্ড বিদেশ থেকে এসেছে। বিদেশে নিয়ে যাবে। তথ্য হিসেবে সিকিউরিটি গার্ডের কাছ থেকে এর চেয়ে অতিরিক্ত কি আশা করা যায়? এরিমধ্যে একদিন ইলমার সাথে তাদের বাসার গলিতে দেখা। দেখেই বললো, “আপনি এদিকে যে”? “এক আত্মীয়ের বাসায় এসেছিলাম” ঝটপট বানিয়ে বললাম। ইলমা সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে বললো, “আপুর সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন”? বললাম “না, তা কেন হবে”? “লাভ নেই” বলেই হাঁটা দিলো। আমি নিশ্চিত এ নিয়ে বাসায় আলোচনা হবে, অশান্তি বাড়বে। জেমি বিব্রত হবে। এমনকি আমার উপর বিরক্তও হতে পারে। বুঝতে পারলাম এদিকে আর ঘোরাঘুরি করা যাবেনা।
ছোট মামা অফিসে ডেকে পাঠিয়েছেন। আম্মাও তাগিদ দিচ্ছে যেতে। কি কাজ জানিনা। গেলাম তার সেগুন বাগিচা অফিসে। খুশি হলেন। মামীকে নিয়ে খাগড়াছড়ি যাবেন বললেন। চা খেতে খেতে অফিসের টুকটাক কাজও সারলেন। সাবরীনাকে বেশ কয়েকবার ডাকলেন। সাবরিনা তার জুনিয়র সহকর্মী। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, “আমার ভাগ্নে। বুয়েটিয়ান। ইউ এন ডিপিতে কাজ করে। খাগড়াছড়ি পোস্টেড”। কেমন করে যেন তাকালো। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি পানিশমেন্ট পোস্টিং হিসেবে পরিচিত। সবাই জানে। হয়ত সে কারণেই। বসের কল পেয়ে সাবরিনাকে বসিয়ে রেখে মামা চলে গেলেন। আলাপের ক্ষেত্র খুঁজে পাচ্ছিনা। কিছুক্ষণ এভাবে চুপচাপ থাকলাম।
সাবরিনাই জড়তা কাটালো, “চা বা কফি”? বললাম, “নো, থ্যাংকস। মামার সাথে খেয়েছি”।
— চা, কফি কি মেপে মেপে খান? সাবরিনার প্রশ্ন।
— না, না। আমি চা খোর। খাগড়াছড়ি গিয়ে হয়েছি কফি খোর।
— তাহলে না করছেন কেন? এই বলে সে দু’কাপ কফির অর্ডার দিলো।
সাবরিনা বেশ সুন্দরী। সরকারি অফিসে সাধারণত এরকম নায়িকা টাইপ সুন্দরী দেখা যায় না। থাকলেও হুট করে বিয়ে হয়ে যায়। অথবা বিয়ে করেই চাকরিতে ঢোকে। আমার সমস্যা হলো সুন্দরী মেয়েদের সাথে কথা জমাতে পারিনা। মনে হয় কখন দেমাগের হেড লাইট জ্বালিয়ে দেবে। আমার আত্মসম্মানে লাগবে। তাছাড়া সুন্দরীদের সম্মন্ধে আমার কিছু নেগেটিভ সেন্স কাজ করে। এরা দেমাগী হয়। উচ্চাভিলাষী হয়। সবাইকে ইগনোর করে। প্রশংসা পাবার জন্য মুখিয়ে থাকে। সবাইকে মনে করে তাদের এডমায়ারার। মামা ফিরে এলেন। সাবরিনা বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমার হাতে একটা ব্রোসিয়ার আর একটা ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললেন হক্কানী সাহেবের সাথে দেখা করতে। সেলিমের জন্য নতুন বিজনেস প্রপোজাল আছে।
পৃথিবী জুড়ে এক অদ্ভুত অসুখ এসেছে। সামান্য হাঁচি-কাশি দেওয়াও এখন ভয়ের, লজ্জার। সাধ্যমত চেপে রাখতে হয়। আগে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে সর্দি, কাশি, জ্বর, গলা ব্যাথা, নাক বন্ধ, নাকে গন্ধ না পাওয়া, জিহ্বায় স্বাদহীনতা ছিলো স্বাভাবিক। সবাই ধরে নিত সাত দিন ভুগতে হবে। বেশি বেশি লংকা, পেঁয়াজ, আদা, গরম চা, গরগরা, জাম্বুরা ইত্যাদিতেই পরিত্রাণ মিলত। তীব্রতা বেশি হলে বা সহ্য ক্ষমতা কম হলে যারা ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হত তাদের দেওয়া হত এন্টিবায়োটিক। এক সপ্তাহের ডোজ। আর এখন? কাশি যথাসাধ্য কন্ট্রোল করে রাখতে হয়, জ্বর গোপন রাখতে হয়, গা ব্যাথা, গলা ব্যাথা, নাকে ঘ্রাণ না থাকা ও স্বাদ বুঝতে না পারা রীতিমত চেপে যেতে হয়। চেপে চুপে আর কতক্ষণ থাকা যায়? এর কোনটির লক্ষ্মণ ধরা পরা মাত্র আপনি কট। অফিস থেকে ফরমান নাজিল হবে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’। অথবা সিক লিভ নিতে বলা হবে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কেউ কেউ নেয় আবার কেউ এটাকেই ফাঁকিবাজির হাতিয়ার বানায়। ঢাকা থেকে ফিরেই আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে আমার জোড়া টনসিল আক্রান্ত হয়েছে, সে কারণে গা ম্যাজ ম্যাজ করছে। সনাতনী পদ্ধতিতে যেই মাত্র গরম পানিতে গার্গেল করেছি অমনি রুমমেটরা ঘোষণা দিয়ে বসলো নির্ঘাত করোনা হয়েছে। তাদের সবার এক কথা “আইসোলেশন ইজ মাস্ট। বাট নট হিয়ার। এনি আদার প্লেস এলস হোয়ার”। সেকারণে, বলা চলে তাদেরকে আশংকামুক্ত রাখতে আর অফিসের আদেশ পালনে বাধ্য হয়ে আবার ঢাকায় ব্যাক করি। টেস্ট করানো হলো। রিপোর্ট নেগেটিভ। ডাক্তার দেখানো হলো। মুখে স্টেনলেস স্টিলের চামচাকৃতির দন্ড দিয়ে জিহ্বাকে চেপে ধরে আরেক হাতে টর্চের আলোর ফোকাস ফেলে ডাক্তার চোখ বড় বড় করে বললেন, “টু বিগ, লাইক গলফ বল”। ওষুধ দিলেন। বললেন, ওষুধে কাজ না হলে টনসিল অপসারণ ফরয হয়ে পড়বে।
যাহোক, ওষুধেই সব কিছু নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। আমি কোয়ারেন্টাইন পক্ষ পালন করার পর খাগড়াছড়ি ফিরেছি। জেমির কোন খবর নেই। জেমি এখন একটুকরো স্মৃতি কথা ভিন্ন অন্য কিছু না। শৈলী নতুন ক্লাসমেট পেয়ে ‘ফার্স্ট ইয়ার ডোন্ট কেয়ার’ ম্যুডে আছে। এ কয়দিন আমিও ফোন দেই নি। সেও না। পৃথিবীর সব কিছু একই নিয়মে চলতে থাকবে আশা করা বোকামী। বুঝতে পারছি শৈলীর এখন বসন্তকাল চলছে। চারিদিকে সৌরভ, রঙের মেলা। পিছু ফিরে তাকাবার ফুরসত নেই। এগিয়ে যাওয়াই যৌবনের ধর্ম। মাঝে মাঝে দারুণভাবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। জেমিতে মজলাম কোন যুক্তিতে? ভেতর থেকে উত্তর এলো, প্রেম, ভালবাসা লজিক মেনে হয়না। চকিতেই হয়ে যায়। শৈলীর সাথে ফোনালাপ আর এস এম এস এর খুঁনসুটির দায়ভার কার? সে টিন এজ বালিকা। ডানায় সদ্য শক্তি পেয়েছে, দেহে স্রোতস্বিনী যৌবনের ছলাৎ ছলাৎ আলোড়ন। তার পক্ষে এলোমেলো উচ্ছ্বাস সাজে। কিন্তু তাতে আমি কেন এত উদ্বেলিত বোধ করছি? ফাংশনাল সম্পর্কের বাইরে একজন টিউটরের দায়বদ্ধতা কি? জানিনা। খাগড়াছড়ি আসার পর থেকে তার সাথে এত বেশি ইন্টারেকশন কি নিছক সৌজন্যতা নাকি জেমিহীন পৃথিবীতে একজন চঞ্চলমতি বালিকার উজ্জ্বল উপস্থিতিজনিত আগ্রাসন? অনেক দিন হয়ে গেল শৈলীর ফোন আর আসেনা। সারাদিন এলোমেলো লাগে। রাতে প্রতীক্ষায় থাকি এই বুঝি শৈলী ফোন দিয়ে খোঁচা মেরে বললো, “আংকেল, এখনো ভাব ধরে আছেন? ভাব ধরেই থাকেন”। আগে জেমিহীন সব কিছু পানসে লাগত আর এখন তিতা তিতা লাগে। বাসায় ফোন দিতেও ভাল লাগেনা। আম্মা ফোন দিলে খবরাখবর নেই। মোটকথা কোন কিছুতেই আর উৎসাহ পাইনা। একজন জেমী বা একজন বালিকার কত শক্তি যে সব কিছু রূপহীন, রসহীন, গন্ধহীন, বর্ণহীন, ছন্দহীন, গতিহীন করে দেয় সহজেই।
রুমমেটদের সাথে হাসি ঠাট্টা আর সমসাময়িক বিষয়াদি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। এক সাথে উঠাবসা হয়। কিন্তু একান্ত ব্যাক্তিগত অধ্যায় শেয়ার করার মত উদ্রেক হয়না। ইমাম সাহেবের কাছে বসলে দুনিয়াদারি তুচ্ছ মনে হয়। মনে হয় এ দুনিয়া খেল তামাসা ছাড়া আর কিছু না। একেকবার মনে হয় তার কাছে খুলে বলি সব কিছু। বললে হয়ত হাল্কা বোধ হবে। কিছু ভাল পরামর্শও পাওয়া যেতে পারে। আজ খুব শীত পড়েছে। সন্ধ্যায় ভাল বৃষ্টিও হয়েছে। এশার নামায শেষে লোকজন যে যার মত দ্রুতই বেরিয়ে গেলো। ইমাম সাহেবকে সালাম দিয়ে গিয়ে বসলাম সামনে। আরো দু’জন ছিলো বসা। তাদের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা। একজন বলেই ফেললেন তিনি পারিবারিক ভাবে খুব পেরেশানীতে আছেন। তার দুই ছেলে, এক মেয়ে। সবাই বড়। তাদেরকে শাসন করা যাচ্ছেনা। স্ত্রী তাদের হয়ে এমন ভাবে কোমর কেচে নামে বাসায় টিকাই দায়। ইমাম সাহেব হাসলেন। বললেন, “ স্ত্রীকে বেশি চাপাচাপি করবেন না। জানেন তো বাঁকা হাড় দিয়ে তৈরি। বেশি করবেন সোজা তো হবেই না বরং ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর ছেলে মেয়েদেরকে সময় দেন। তাদের চাহিদা বুঝার চেষ্টা করুন। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ”। ভদ্রলোক চলে গেলেন। অপরজনের রাতে ঘুম হয়না। ডাক্তার হাই ডোজ মেডিসিন দিয়েছে। কাজ হচ্ছে না। ইমাম সাহেব শান্ত কন্ঠে বললেন, “বাবাজী, দুনিয়াবি ঝামেলা কমিয়ে দিন। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ুন। ডিম লাইট জ্বালাবেন না। ডান কাত হয়ে শোবেন। বিসমিল্লাহ পড়ে সুরা ফাতিহা আর তিন কুল পড়তে থাকবেন। তাতেও ঘুম না এলে তাসবীহ, তাহলীল যা জানেন তা পড়তে থাকবেন। ইন শা আল্লাহ ঘুম এসে পড়বে”। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর পরই আমি বলে ফেললাম, “হুজুর,আমার একটা সমস্যা”। ইমাম সাহেব উঠতে গিয়েও বসলেন। বললাম, “আমার এক বন্ধু, কঠিন বিপদে পড়েছে”। আমার সমস্যা বন্ধুর নামে চালিয়ে দিলাম। ইমাম সাহেব হাসলেন। চুপ করে থেকে কয়েকবার নাউযুবিল্লাহ পড়লেন। পরে বললেন, “বাবাজী, এটা হাল আমলের মারাত্মক রোগ। পরকীয়া। হারাম, হারাম, হারাম। অন্যের স্ত্রীর সাথে যাই করা হবে তাই নাজায়েয। কবীরা গোনাহ। যত দ্রুত সম্ভব এ থেকে সরে আসতে বলেন। কোন ফায়দা তো নেই-ই বরং আখেরে ভীষণ মসিবত। দুনিয়াবিতেও অনেক সমস্যার সৃষ্টি হবে”। আমি বললাম, “এখন উপায়”? তিনি বললেন, “সামর্থ থাকলে দেখে শুনে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিতে বলেন। আর সামর্থ না থাকলে তাড়াতাড়ি এই হারাম কাজ থেকে বেরিয়ে আসতে বলেন”। আমি চলে আসবো এমন সময় ডাক দিয়ে বললেন, “শয়তানের সবচেয়ে আনন্দ হয় তখন, যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ফাটল ধরাতে পারে। তালাকের মত অপছন্দনীয় কাজে প্ররোচিত করতে পারে। আর এ কাজে আপনার বন্ধুকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে”। আমার হাত ধরে বললেন, “বাবাজী বুঝতে পেরেছি আপনি নিজেই এই কঠিন বিপদে পড়েছেন”। লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে এলো। এরপর আর কথা চলেনা। বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
ভাবছি, জেমি আসলে কে? তার সাথে আমার এই সম্পর্ক কি ভালবাসা, ইনফেচুয়েশন নাকি মায়া? নাকি আত্মাহুতির জ্বলন্ত অংগার? নিজেই নিজেকে বিশ্লেষণ করতে থাকলাম। এটা ঠিক যে জেমিকে দেখামাত্রই তার দীপিকা পাডুকোন লুক আমার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে। ছাত্রীকে পড়ানোর সুবাদে আর জেমির ঔৎসুক্যে আমাদের আড়াল আবডাল গাঢ়ত্ব পেয়েছে। জেমির সাহসী ভূমিকা আমাকে খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসতে উজ্জীবিত করেছে। সেটা জেমির তরফ থেকে হতাশাকে লাঘব করার জন্য উত্তম টাইম পাস হতে পারে, হতে পারে “এমনি করেই যদি জীবনটা কেটে যায়, যাক না” জাতীয় সুখের বিকল্প অপশন। তার জন্য সিরিয়াস সিদ্ধান্ত নেওয়া যেমন কঠিন। তেমনি আমার জন্যও অনেক “যদি কিন্তু তবে” জাতীয় হার্ডেলস অতিক্রম করার কঠিন পরীক্ষা। আমাদের এই সম্পর্কের পরিণতি অংকের হিসেবে অনেক জটিল। মেয়েরা খুব আবেগী হয়। তাদের মননে-মগজে নানাবিধ রস খেলা করে। হাওয়া বদলের সাথে সাথে এর রুপও বদল হয়। অতি সংবেদনশীল হলেও এরা খুব বাস্তববাদী হয়ে থাকে। আবেগ তাদের খুব সহজেই ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে, কখনো শ্লীল-অশ্লীলের পর্দা ছিন্ন করে ফেলতে পারে। কিন্তু দিন শেষে মাটির পৃথিবীতে ফিরে আসে খুব সহজেই। ভাবছি এলোমেলো এমন কিছু। হঠাৎ শৈলীর ফোন। বেজেই চলছে। ধরিনা। শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে জীবনকে আর জটিল করতে চাইনা।
চলবে…