February 7, 2022

আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৭)

by Anwar Hakim in STORY0 Comments

আজিমপুর টু উত্তরা
ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
আনোয়ার হাকিম।

(৭)
বাসায় এই কয়দিনে অনেক কাজ জমেছে। কোনটা থেকে কোনটা যে করি? এই কয়দিন আম্মাকে প্রানবন্ত মনে হচ্ছে। বিকেলের দিকে উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে থাকলাম অলিতে গলিতে। সামান্য কয়েকদিনেই কেন জানি মনে হলো ধানমণ্ডি পাল্টে গেছে অনেক। আগের সে প্রাণ নেই। মানুষজন, গাড়ী-ঘোড়া সবই আছে আগের মত। কিন্তু কি যেন নেই? হঠাৎই মনে হলো জেমির দেখা নেই। তারচেয়ে বড় কথা তার সাথে দেখা করার পথও খোলা নেই। অতি পরিচিত লেকটাকে এখন পচা দুর্গন্ধযুক্ত নর্দমা মনে হচ্ছে। স্ন্যাক্স আর ফুচকাতে এখন আর কোন আগ্রহ নেই। কোল্ড বা হট কোন কফিই আর টনিক বলে মনে হয়না। কেবলই মনে হয় জেমি ছাড়া রাজধানীর এত এত আয়োজন সব অর্থহীন। অভ্যাসবশত মনের ঘোরেই জেমিদের বাসার সামনে চলে এসেছি। সামনের বারান্দায় শুকোতে দেওয়া কাপড় ঝুলছে। বুঝাই যাচ্ছে কিউটির। সিকিউরিটি গার্ড আব্বাসকে বললাম, “মামা, খবরাখবর ভাল”? মাথা নেড়ে বললো, “ভালা। তয় বড় আপার খুব অসুখ। মাথায় কি না কি সমস্যা? যান, উপরে যান”। অন্তরাত্মা ধক্ করে উঠলো। মন একশ’ মিটার স্প্রিন্ট বেগে উপরে যেতে চাইলো। কিন্তু যেতে চাইলেই তো আর যাওয়া যায় না। আমার জন্য সেখানে এক শ’ চুয়াল্লিশ ধারা জারি আছে।
ইচ্ছে করেই রাত করে বাসায় ফিরলাম। সরাফত চাচাকে এভয়েড করার জন্য। ডাইনিং এ বসে খেতে খেতে আম্মার সাথে টুকটাক আলাপ হলো। সরাফত চাচা ওয়াশ রুমে যাবার ছলে বেরিয়ে এসে বসলেন। আম্মা উঠে গেলো। আমার খাওয়ার রুচিও উবে গেল। বত্রিশ দাঁত বের করে প্লাস্টিকের হাসি দিয়ে বললেন, “বাবাজী, ভাবীজান তোমারে কিছু বলছে”?
— না তো। কেন?
— না, এমনি বললাম।
— চাচা, একটা হেল্প করবেন? আমার প্রশ্ন।
— বলো বাবা, বলো
— আমাদের কিছু টাকার দরকার। লোন দেবেন?

সরাফত চাচার গলায় মনে হলো কাশিটা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বললেন, “আমারই তো টাকা দরকার। পশ্চিম পাড়ার জমির লাগ দাগে পাঁচ কানি জমি বিক্রী করবো বজলু বেপারি। পোলারে মিডিল ইস্টে পাঠাবো। জরুরি দরকার। নিয়ত করছি, আমিই রাখমু। তাই ভাবীজানের কাছে আসছি”। আমি এই সময়ের অপেক্ষাতেই ছিলাম। বললাম,“চাচা, আমি প্ল্যান করেছি চাকরিটা ছেড়ে দেবো। পাহাড়ে চাকরি ভাল লাগেনা। তাছাড়া ওখানে বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে ঘুম, খুন লেগেই থাকে। আমার ভয় করে। আর বেতনও তেমন বেশি না। বাইরে থেকে সবাই বেশি বেশি মনে করে”।

কথাটা তার মনপুত হয়নি বুঝা গেলো। তবে তিনি দমবার পাত্র নন। কঠিন জিনিস। মুখে কুচক্রী হাসি নিয়ে বললেন, “কি কও? তোমাদের চৌদ্দ গুষ্ঠির মধ্যে কেউ ব্যবসা করে নাই। ব্যবসার তুমি কি বুঝবা”? আমি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে অতি আপন জন ভাব করে বললাম, “লোন নিয়ে পার্টনার শীপে জমি কিনবো। সেই জমিতে ডেভেলপারের মাধ্যমে ফিফটি ফিফটি রেশিওতে ফ্ল্যাট বানাবো। চড়া দামে হট কেকের মত বিক্রী করবো একেকটি ফ্ল্যাট। আর ঠ্যাং এর উপর ঠ্যাং তুলে খাবো”। লক্ষ্য করলাম সরাফত চাচা আমাকে গভীর ভাবে নিরীক্ষণ করছেন। লোভাতুর চোখে তিনি আমার প্ল্যানের মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন। আবার নিজের মনের ভেতর ঘুড়পাক করতে থাকা সন্দেহ নিয়ে ভেসে উঠছেন। রাত অনেক হয়েছে। ঘুমোতে যাবো বলে উঠতে যাবো। তখন তিনি অন্য প্রসঙ্গ পারলেন,“বিয়ে থা করবা না? বয়স তো যায় যায়”? বললাম, “ চাচা, বিয়ের কথা মাথাতেই নাই। আগে কোটিপতি, পরে ওসব”। তিনি কি যেন ভাবলেন? মাথা নাড়তে নাড়তে ওয়াশ রুমের দিকে অগ্রসর হলেন।

এত ব্যস্ততার মাঝেও জেমিকে ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ছে। ওদের সিকিউরিটি গার্ড জানালো জেমির মাথায় সমস্যা। সেটা কি ধরণের? মারাত্মক কিছু? জানিনা। জানার উপায় নেই। ইলমাকে ফোন করা যায়। কিন্তু এতে পরিস্থিতি আরো জটিল হয় কিনা কে জানে? মানুষের মন নিজেকে প্রবোধ দিলেও তা প্রতিনিয়ত এক শ চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করে। নতুন নতুন উছিলা খুঁজে। অনেক সাহস করে ইলমাকে ফোন দিলাম কয়েকবার। প্রতিবারই কেটে দিচ্ছে। বুঝলাম পরিস্থিতি অনুকূল নয়। খাগড়াছড়ি যাবার পর আরেকবার এমন হয়েছিল । জেমির ফোন বন্ধ ছিলো। লজ্জার মাথা খেয়ে ইলমাকে ফোন দিয়েছিলাম। কয়েকবার কেটে দেওয়ার পর ইলমা না ধরে তার মা ধরলেন। আর নন স্টপ যা তা বলে গেলেন। শেষে বললেন তার মেয়ের কিছু হলে আমি এর জন্য দায়ী হবো। আরো জানালেন, জেমির হাসবেন্ড দু’মাস পর দেশে ফিরবে। এসে জেমিকেও নিয়ে যাবে। আমি কিছু বলার আগেই ফোন লাইন ডিসকানেক্ট হয়ে গিয়েছিলো। সে হিসেবে জেমির হাসবেন্ডের দেশে আসার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। এর পর? জানিনা। মাথা আর কাজ করছে না।

বাসায় সবার মধ্যে যুগপৎ একধরনের লুকাছাপা আর অজানা আতংক কাজ করছে। সেলিমের খবর নেই। আম্মার মানসিক অবস্থা ভাল না। বোনের অবস্থা ততোধিক খারাপ। এর মধ্যে ঝামেলা আরো বাড়িয়ে তুলেছেন সরাফত চাচা। মামু বাড়ীর আবদারের মত তার টাকা চাই। জমি কিনবেন। আমরা না পারছি তাঁকে বিদায় করতে, না তিনি নিজে থেকে বিদায় হচ্ছেন। অথচ আমরা চাচ্ছি বোনের হাসবেন্ডের লা পাত্তা হওয়া ও এতদসংক্রান্ত ঝামেলার বিষয়টি যেন তাঁর কানে না যায়। গেলেই বিপদ। ঘটনার সাথে মনের মাধুরি মিশিয়ে স্বরচিত ও স্ব প্রযোজিত রগড কাহিনী দেশের বাড়ীতে রাষ্ট্র করে ছাড়বেন। এরি মধ্যে তাঁর ফোকাস বোনের কম ম্যুভমেন্টের উপর পড়েছে। রান্না ঘরে কি যেন আনতে গিয়ে তাঁর সামনে যেই পড়েছে অমনি তিনি মিসাইল ছুঁড়ে দিলেন, “আম্মা জানের কি মন খারাপ? নাকি শরীর খারাপ”? বোন কাচুমাচু হয়ে বললো, “না চাচা, ভাল আছি। একটু ঠান্ডা লেগেছে এই যা”। তিনি ছাড়বার পাত্র না। বললেন, “জামাই বাবাজী আসেনাই”? এই পর্যায়ে আমাকেই আগ বাড়িয়ে বলতে হলো, “চাচা, ও তো ব্যস্ত। তাছাড়া ক’দিন আগেই এসে থেকে গেছে কয়েকদিন”। আলাপের ফ্লাইট অন্য দিকে ঘুড়াতে বললাম, “আপনার কাজ শেষ”?
— শেষ আর হইলো কই?
— কেন?
— হাইকোর্টের উকিল খুব ধুরন্ধর। খালি ঘুড়ায়। তয় আমিও কম না।
— চাচা, এভাবে ঢাকায় এসে উকিলের পিছে টাকা খরচ করে লাভ কি? তারচেয়ে আপনি বাড়ী চলে যান।
মোবাইলে খবরাখবর রাখবেন।
— কথা খারাপ কও নাই। ভাবছি ভাবীসাহেবা একটা ব্যবস্থা করলেই চলে যামু।
— কি ব্যবস্থা?
— ওই যে ক্ষেত কিনার টাকা আর কি
— চাচা, আমি আপনাকে সেদিন বললাম না আমারই অনেক টাকার দরকার। আম্মা টাকা দেবে কোত্থেকে? তাছাড়া
দেখছেন না আম্মার শরীর ভাল না। কাজের বুয়া নেই। খালাকে আনা হয়েছে সাময়িক। আম্মার কষ্ট লাঘব করার
জন্য। তারও তো সংসার আছে। তাছাড়া আমিও তো খাগড়াছড়ি চলে যাবো পরশু।

সরাফত চাচা মাথা নাড়লেন। বললেন, “হ, ভাবী সাহেবার শরীরটা ভাল মনে হইতেছে না। ভাবতাছি সময় সুযোগ করে পরে আবার আসুম”। আমি আর কথা না বাড়িয়ে সুপ্ত উল্লাস চেপে রেখে বললাম, “চাচা, রাত অনেক হয়েছে। ঘুমান। ফজর মিস হয়ে যাবে”।

আজ রাতের কোচে খাগড়াছড়ি ফেরার কথা। সরাফত চাচা বিদায় হয়েছেন। এতে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি। কিন্তু আম্মার শরীরটা আবারো খারাপ করেছে। বোনের বিলাপ আর অনুযোগের শেষ নেই। তার ধারণা আমরা তার হাসবেন্ডকে খুঁজে পেতে কার্যত কিছুই করছি না। বরং তাকেই এখন আপদ ভাবছি। বললাম, “তোর শ্বশুর বাড়ীর ওদেরকেও বল। ওরাও খুঁজুক”। এই কথা বলে আমি পড়লাম তোপের মুখে। বোন পারলে এখনই বাড়ী থেকে যেদিকে দু’চোখ যায় সে দিকে চলে যায়। খালা তাকে বুঝাচ্ছে। নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছে। আম্মা অসন্তুষ্ট হয়ে বললো, “ জানিস ওর মন ভালো নেই। শুধু শুধু কথা বাড়াচ্ছিস কেন”? আমি চুপ হয়ে গেলাম। ঘড়ি দেখলাম। আরো ঘন্টা দেড়েক বাকী। এখান থেকে রাসেল স্কয়ার বাস কাউন্টারে যেতে খুব বেশি হলে পনের-বিশ মিনিট লাগবে। বোনের কাছে গিয়ে বললাম, “শুধু শুধু উল্টা বুঝিস কেন? বড় মামাসহ আমরা তো চেষ্টার ত্রুটি করছিনা। ধৈর্য্য ধর। আল্লাহকে ডাক। ইন শা আল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে”। বিদায়ের মুহুর্তকে আমি কোন দিনই ফেইস করতে পারিনা। আমার কাছে বিদায় মানে অতি দ্রুত চোখের আড়াল হয়ে যাওয়া। আম্মার মুখের দিকে তাকাবার মত মনোবল পাইনা। ব্যাগটা হাতে নিয়ে খালাকে বললাম, “আম্মাকে দেখো”।

চলবে…

About

Anwar Hakim

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}