আজিমপুর টু উত্তরা
ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
আনোয়ার হাকিম।

(৮)
খাগড়াছড়ি এসেই দুটি খবর পেলাম। একটা সেলিমের আবির্ভাবের। আরেকটা হলো আগামী সপ্তাহে দাপ্তরিক কাজে ঢাকায় যাওয়ার। মিটিং প্লাস তিন দিনের ওরিয়েন্টেশন। দুটোই দারুন খুশির খবর।
সেলিমকে পাওয়া গেছে বললে ভুল বলা হবে। সে-ই এসে উদয় হয়েছে। বোনের সাথে থেকে থেকে তুমুল ঝগড়া হচ্ছে। খালা মাঝখানে পরে ভ্যাবাচ্যাকা খাচ্ছে। আম্মা বোনকে গলা খাকাড়ি দিচ্ছে। কিন্তু জামাইকে তো আর সেভাবে কিছু বলতে পারছে না। চুল-দাড়ি নিয়ে কিম্ভুতকিমাকার অবস্থায় বাসায় এসে উঠেছে সে। আম্মার হয়েছে জ্বালা। বুয়াকে আসতে বারণ করে দিয়েছে। বাসার এই একশন বেইজড, সাসপেন্সে ভরপুর বিরতিহীন সার্কাস প্রত্যক্ষ না করাই ভাল, তাই। খালার উপর পড়েছে বাড়তি চাপ। সেলিম এসে সেই যে লম্বা শোয়া দিয়েছে বোনের অগ্নুৎপাতেও আর উঠার নাম নেই। বালিশে মাথা গুঁজে চুপ মেরে পড়ে আছে। মুখে রা নেই। হাতে টাকা নেই। টাকার যোগান দেবে বোন। বোনের সোর্স আম্মা। আম্মার ভরসা ফ্ল্যাট ভাড়া। অর্থনীতির এই চক্রাকার বলয়ে চলছে আমাদের জামাই-পালন অর্থনীতি। তবু সবার মন খুশি নিঁখোজ লোককে খুঁজে পাওয়া গেছে। আম্মাকে বললাম,“কি বলে ও”?
— কি আর বলবে? চুপ মেরে আছে। মুখে কথা নাই
— কোথায় ছিলো এতদিন?
— সিরাজগঞ্জে, ওর এক বন্ধুর ওখানে।
— হতচ্ছাড়া
— আমার হয়েছে যত জ্বালা। মলিকেও কিচ্ছু বলা যায় না।
— কেন?
— বললে কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে কান্না শুরু করে দেয়। সেলিমকে কিচ্ছু বলা যাবেনা। যা বলার ওই নাকি বলবে।

আম্মা এগুলো বলে আর কাঁদে। বলে বলে হাল্কা হয় বুঝি। সেলিম টাইপের ছেলেদের সম্মোহনী গুণ মারাত্মক। এই যে এত অঘটন ঘটিয়ে কপর্দক শূন্য হয়ে শ্বশুর বাড়ীতে এসে লম্বা শোয়া দিয়েছে তাতে তার না আছে কোন শরম, না আছে কোন চিন্তা। নন-স্টপ বকা দিতে দিতে মলির রাগও পড়ে গেছে। মলি মানে আমার বোন। বাসা আপাতত শান্ত। তবে যে কোন সময় তেতে উঠতে পারে। ফোন দেই, ধরেনা। ধরবে কেমনে? মলি তার ফোন সীজ করে সুইচ অফ করে রেখেছে। বললেও তাকে ফোন দেয় না। আমার ভয় তার আবির্ভাবের খবর যদি পাওনাদাররা জানতে পারে তাহলে তো বাসায় এসে আবার ক্যাচাল শুরু করে দেবে। অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাসায় খোঁজ নেই। শুনি ‘ওয়ার এন্ড পিস’ খেলা চলছে। আম্মার কাছেই শুনি, চুল-দাড়ি বড় হয়ে জংলী রুপ নিয়েছে। কিন্তু কাটার নাম নেই। বোন খোঁচা দেয় ঠিকই। কিন্তু বেশি চাপাচাপিও করেনা। কারণ, সেলুনে গেলে যদি পাওনাদাররা গলায় গামছা দেয়? গুম, খুন করে ফেলে? অবশেষে বোনের মাধ্যমে ফোনে সেলিমকে পাওয়া গেল আজ। বললাম, “কাজটা তুমি মোটেই ভাল করো নি”।
— জ্বী। তার সরল স্বীকারোক্তি।
— এভাবে বাসার সবাইকে টেনশনে রাখা উচিত হয়নি। বিশেষত আম্মাকে।
— জ্বী
— তা এখন কি করবা?
— জানিনা
— একটা কিছু তো করতে হবে
— কি করবো?
— মুদির দোকান হলেও দাও
— পয়সা নাই
— এত এত টাকা কি করছো?
— লস খাইছি
— এখন পাওনাদারদের টাকা দিবা কেমনে?
— জানিনা
— জানিনা বললে তো হবেনা। ওরা তো আবার আসবে। তোমাদের বাড়ীতে বলো হেল্প করতে
— দিবেনা
— কেন?
— ওখান থেকেও নিয়েছি
— সেটা দিয়ে কি করেছো?
— সাভারে মার্কেটে দোকান নিয়েছিলাম। পজিশন পাইনা
— কেন?
— যার কাছ থেকে দোকান নিয়েছিলাম আসলে সে ওটার মালিক না।
— মানে?
— বন্ধু ভুল বুঝিয়ে টাকাটা মেরে দিয়েছে।

তার সাথে আলাপ করতে আমার মন আর রুচির কোনটাই হচ্ছেনা। অধিক শোকে পাথর হয়ে ফোন ছেড়ে দিলাম। মনে মনে ভাবছি, ফোনটা না করলেই ভাল হত।

জামান ভাইয়ের শরীর ভাল না। অফিস করেন ঠিকই কিন্তু দুর্বল দুর্বল ভাব। বললাম, “চলেন সাজেক ঘুরে আসি। ভালো লাগবে। সবার কাছেই শুনি। আমি যাইনি কোনদিন”। হাসলেন। বললেন, “ছোট ভাই, মনটা আজ কয়দিন যাবত ভালো না। কেন জানি খুব অস্বস্তি লাগছে”। “কেন” জানতে চাইলেও কিছু বললেন না। জেমির কথা মনে হলো। জেমির সাথে দেখা হওয়ার পথ রুদ্ধ। কথা বলাও। তার উপর রাগ হলো। দুঃখও হলো। রাগ না দুঃখ ঠিক কোনটা হলো বুঝে উঠতে পারছিনা। থেকে থেকে অভিমানও হচ্ছে। ইলমাকে ফোন দিতে মন চাচ্ছে। বাটনে আঙ্গুল নিয়েও ফিরিয়ে নিলাম।

একদিনের কথা মনে পড়ে গেলো। ধানমন্ডির দৃক গ্যালারিতে নবীন চিত্র শিল্পীদের চিত্রকলা প্রদর্শনী চলছিলো। জেমিই খবর এনেছে। সেখানে সিলেকটিভ লোক জন যায়। কেউ যায় কলা দেখতে। কেউ কলকাকলি করতে। দোতলায় ঘুরে ঘুরে শিল্পীদের চিত্র কর্ম দেখছি। দেখছি বললে ভুল হবে। জেমি দেখছে। আমি তার নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করছি। ভিজিটরের সংখ্যা কম। যারা এসেছে তাদের মধ্যে চার ধরনের লোক রয়েছে। এক, চিত্র বোদ্ধা। দুই, অংশগ্রহনকারী শিল্পীদের পরিচিতজন। তিন, এসির বাতাস খাওয়া ও সময়ক্ষেপনকারী। আর চার, অল্প বয়ষ্ক জুটি। তারা হাত বগলদাবা করে, কখনো কাঁধে হাত রেখে, আবার কখনো আঙ্গুলের ভাঁজে ভাঁজে আঙ্গুল লেপ্টে চিত্রকলা দেখার নামে নিরবে পাশা খেলছে। এদেরকে দেখে আমার কেন জানি অসহ্য লাগছে। বললাম, “দূর ছাই। এগুলো ছাতামাতা কি এত দেখছো”? “কেন, কি হয়েছে? ভালো লাগছে না”? জেমির প্রশ্ন। বললাম, “এ জন্য ডেকে নিয়ে এসেছো এখানে”? জেমি কেমন করে যেন তাকালো। মুচকি হেসে বললো, “অন্য কোন মতলব আছে নাকি”?

আমি থতমত খেয়ে বললাম, “মানে”? জেমি এক জুটির দিকে চোখ ফেললো। ধরা খাওয়ার লজ্জায় বললাম, “কি যে বলো? আমার সেই ভাগ্য আছে নাকি”? বলা শেষ। অমনি হাতটা নিয়ে তার হাতের সাথে লেপ্টে নিলো। আমি কারেন্টের শক খাওয়ার মত হাত ছাড়িয়ে নিলাম। জেমি হাসলো। বললো, “ভিতুর ডিম। তার আবার খায়েস কত”? কখনো কখনো লজ্জা রাখার জায়গাও পাওয়া যায় না। বললাম, “এখানে চা-কফির ব্যবস্থা নেই। নীচে পিছনের গলিতে আছে। চলো”। সেই স্মৃতি আজো মনে পড়লে হাসি পায়।

ইদানীং সন্ধ্যার সময়টায় খুব অস্থির লাগে। দিন রাত্রির পালা বদলের এই স্বল্প সময়টায় বিষন্নতা ভর করে। মনে হয় কি যেন বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে আর ফিরে আসবেনা কোন দিন। মহাকালের আবর্তে কালের এই যাত্রা অন্তহীন, নিত্যই উধাও। অস্বস্তি কাটাতে তাই মাগরিবের নামাযকেই উৎকৃষ্ট বিকল্প বলে মনে হয়। নামায শেষে মুসুল্লীদের সমাগম কিছুটা কমলে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে বসি। কিছু বয়ান হয়। অনেকেই মাসলা মাসালা জিজ্ঞেস করে। অনেক মাসালা আমার নিজেরও জানা। অনেক অজানা। এভাবেই ইমাম সাহেবের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ব্যাক্তিগত বিষয়াদি ছাড়াও নানাবিধ আলোচনা হয়। তাঁর বাড়ী হবিগঞ্জ। উচ্চারণে সিলেটি প্রভাব নাই বললেই চলে। একদিন একান্তে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “হুজুর, কাউকে ভালোবাসা কি অন্যায়”? ইমাম সাহেব হাসলেন। বললেন, “বাবাজী কি পেরেশানীতে আছেন”? আমি ধরা খাওয়ার মত লজ্জা পেলাম। বললেন, “যাকে ভালোবাসেন তারে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলেন”। আমি মাথা নাড়লাম। কিন্তু মানুষ চাইলেই কি নামতার মত সব ক্ষেত্রেই দুই দুগুনে চার হয়?

অস্থিরতা এমন এক বায়বীয় জিনিস যা বুকের গভীরে থেকে বিনাশী আগ্নেয়গিরির মত থেকে থেকে চাড়া দেয়। কিছু অস্থিরতা আছে অন্য কারো সাথে শেয়ার করা যায়। তাতে বুকের ভেতরে থাকা বিষবাষ্প নিঃসরণের সুযোগ পায়। পরামর্শ পাওয়া যায়। কিন্তু এমন কিছু অস্থিরতা আছে যা কারো সাথে শেয়ার করা যায় না। এর দহন জ্বালা মারাত্মক।

আম্মার ফোন। বিপর্যয় যখন আসে তখন হাতে হাত ধরে আসে। সেলিমকে বাসা থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। সেই পাওনাদাররা থানায় মামলা করেছে। বড় মামা, ছোট মামা সব থানায়। বোন থেকে থেকে মুর্ছা যাচ্ছে। আম্মার প্রেসার উপরে উঠে বসে আছে সেই থেকে। এপার্টমেন্টের সবার কাছে মানসম্মান যা যাবার গেছে। থানা থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কোন উপায় নেই। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কাল কোর্টে তোলা হবে। সেখানেই জামিনের ফয়সালা যা হবার হবে। বাসা থেকে খাবার আর কিছু কাপড় নিয়ে গেছে মলি আর মামারা। আমার কোন প্রেসারের সমস্যা ছিলো না। এখন মনে হচ্ছে মাথা ঘুরছে, ঘাড়ও ব্যাথা করছে। চোখে ঝাপসা দেখছি। গলা শুকিয়ে কাঠ। জামান ভাইয়ের কাছে গিয়ে বসলাম। খুলে বললাম সব। হাসলেন। বললেন, “ছোট ভাই, এতেই ঘাবড়ে গেলে? যা হবার হয়ে গেছে। লিভ ইট। এখন বোল্ডলি সিচুয়েশন ফেস করতে হবে। ইউ হেভ টু ফাইল এ বেইল পিটিশন, এন্ড কনভিন্স দা লারনেড কোর্ট সো দেট বেইল বি গ্রান্টেড”। সমস্ত কাহিনী শুনে তিনি আরো বললেন, “ফাইল কেইসেস এগেইন্সট দৌজ হু চিট হিম টু রিকভার মানি”। আরো বললেন, “দুনিয়া কো লাত্থি মারো, দুনিয়া তুমারি হ্যায়। শুনো নি”? তার কাছে বসে আলাপ করে অনেকটাই হাল্কা বোধ করলাম। গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। ছোট মামা সরকারি চাকরি করেন। তাকে বললাম জামান ভাইয়ের পরামর্শ মত কাজ করতে। রাতে ডিনারের পর জামান ভাই বেলকনিতে ডেকে নিয়ে বললেন, “এখনই এত হার্ড লাইনে যাওয়া দরকার নেই। যাদের কাছে সে টাকা পায় তাদের সাথে কনটাক্ট করো, মামলার ভয় দেখাও। উকিল নোটিশ পাঠাও। এনগেজ পলিকাল পাওয়ার, ইউজ মাসল, ইফ সিচুয়েশন ডিমান্ডস সো”। কাঁধে হাত রেখে বললেন, “ধরে নাও তোমরা এখন ওয়ার ফিল্ডে আছো। অল ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার। পড় নি”? তার কথা শুনে মাথা ঘুড়ানী কমে গেল। স্পষ্ট দেখতে পারছি শামুকের মত গুটিয়ে থেকে লাভ নেই। অফেন্সিভ হতে হবে। নাচতে নেমে ঘোমটা টেনে লাভ নেই।

চলবে…

About

Anwar Hakim

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}