আজিমপুর টু উত্তরা।
লজিং মাস্টার
(শেষ পর্ব)
আনোয়ার হাকিম।

দেখতে দেখতে বিসিএস প্রিলি রেজাল্ট বের হলো। পাস করে আমি যতটা উল্লসিত তার চেয়ে বেশি উল্লসিত বাবা-মা। তাদের উল্লসিত হওয়ার কারণ যৌক্তিক। কিন্তু কেয়া আর ছায়ার উচ্ছ্বাস দৃষ্টি কটু। আমি হাসি। ভাবছি বাবাকে বলে অন্যত্র শিফট হবো। একটা কিছু যুক্তি দেখিয়ে দিলেই হবে। দুরন্ত বিপ্লব আর ছায়ার রেজাল্ট তাদের ক্যালিবারের তুলনায় যথেষ্ট ভালো হলো। আমার কদর আরো বাড়লো। ওদিকে কেয়া মুখ অমবস্যা করে রাখে। আগের সেই উচ্ছ্বলতা আর নেই। কথা বললে দশ কথায় এক উত্তর মিলে। আগে খোঁচা দিত। এখন আর দেয় না। মেয়েরা যখন ভালোবাসার রেসে হেরে যায় বা পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে করে তখন মুষড়ে পড়ে বা নিজেকে গুটিয়ে নেয়। আমি কি বালিকাদের মাইন্ড রিডার হয়ে যাচ্ছি? অথচ এই কয় বছর আগেও মেয়েদের নিয়ে এত গবেষণা বা অতি আগ্রহের জায়গাটা এত প্রকট ছিলো না। কেয়ার জন্য ভালো ভালো সম্পর্ক আসে। কিন্তু সে কোনটাতেই রাজী হয় না। তার বাবা-মা হতাশ। আন্টি একদিন ডেকে নিয়ে এগুলোই বললেন। আমার আইকিউ যদি কিছুটা থেকে থাকে তাহলে সঠিক আঁচ করতে পেরেছি আন্টি কেয়ার রোগের কারণ ধরতে পেরেছেন। মেয়েরাই মেয়েদের ভালো পরীক্ষক। তিনি ধরেই নিয়েছেন কেয়া আমার প্রতি ইনক্লাইন্ড। আসলে তিনি আমার মনোভাব জানতে চাচ্ছেন। আমার অন্তরাত্মা ভেতর থেকে গুন গুনিয়ে বলে উঠলো, ‘পালা। এখনো সময় আছে। বাঁচতে চাইলে পালা”। আমি পালাবার পথ খুঁজছি। ছায়ার আম্মাকে আমার পরিকল্পনার কথা জানালাম। বললাম আমাকে রিটেন এক্সামের জন্য গ্রুপ ডিসকাশনের মাধ্যমে পড়তে হবে। তাই চার বন্ধু মিলে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। সেখানেই উঠবো আগামী মাস থেকে। আন্টিও পাল্টা প্রস্তাব দিয়ে বসলেন, “তিন তলার ফ্ল্যাট আগামী মাস থেকে খালি হচ্ছে তোমরা এখানে এসে উঠো”। আমার প্ল্যান ভেস্তে যেতে বসলো। হাল ছেড়ে এখানেই চিলে কোঠায় পেয়িং গেস্ট বা লজিং মাস্টারের তকমা নিয়ে থাকলাম। আর কেয়া-ছায়ার খেলা দেখতে থাকলাম। আপদ সরাতে দু’জনকেই বললাম, “আমার অন্যত্র কমিটমেন্ট আছে। বিসিএস হয়ে গেলেই উই উইল টাই আপ টুগেদার”। মনে করেছিলাম আমার এই চায়নাম্যান গুগলিতে পরপর দুই বলে দুই উইকেটের পতন হবে। হাফ ছেড়ে বাঁচবো। কিন্তু হলো আরো বিপদ। উভয়েই মরিয়া হয়ে মাটি কামড়ে ক্রিজে পড়ে থাকার প্রানান্তকর প্রয়াস চালাতে থাকলো। কেয়ার স্ট্রেংথ সে আমার ক্লাসমেট, আর সরকারি কর্মকর্তা বাবার একমাত্র মেয়ে। আর ছায়ার স্ট্রেংথ হলো আমার উইকনেস। আমি লজিং মাস্টার, বাবার বন্ধুর ছেলে। তার ছোট ভাইয়ের প্রাইভেট টিউটর। এতদিন জানতাম ছেলেরা মেয়েদেরকে ইভ টিজিং করে। আর এখন দেখছি ছায়া, কেয়া উভয়েই আমাকে বিভিন্ন ভাবে সময় সুযোগ পেলেই টিজ করে। কেয়ারটা মেনে নেওয়া যায়, সে আমার ক্লাসমেট। কিন্তু ছায়া? সে তো অনেক জুনিয়র। দুরন্ত বিপ্লব এখন ফার্স্ট ইয়ার ডোন্ট কেয়ার ম্যুডে। তার সময় কম। আর ছায়া মেডিক্যাল ভর্তির জন্য যুদ্ধ করছে। তাকে এখন প্রায় সময়ই ছেদে দেখি। একদিন দেখা মাত্র বললাম, “সারাক্ষণ ছাদে ঘুরঘুর করো কেন”?
— “কেন আপনার ডিস্টার্ব হচ্ছে? হবেই তো”। ছায়ার খোঁচা। কথার মোড় ঘুরিয়ে দিতে মেয়েদের মত এত নিপুণ শিল্পী আর হয়না। বললাম, “তোমার না সামনে মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষা”? কথা বলে শেষ করতে পারিনি ততক্ষণে ছায়ার পাল্টা হামলা, “আপনারও তো বিসিএস পরীক্ষা। সারাক্ষণ ছাদের দিকে তীর্থের কাকের মত তাকিয়ে বসে থাকেন। কখন উনি আসবেন সেই অপেক্ষায়”। বুঝলাম আমার মান-সম্মানে টান পড়েছে। আর এও বুঝলাম বালিকাদের নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করা ঠিক না। এতে লাভ নেই, অহেতুক বিড়ম্বনা বাড়ে । বললাম, “আর কিছু বলবা”?
— বলতে তো চাই
— বলে ফেলো
— লাইন ক্লিয়ার পাচ্ছি না তো
— ব্যস্ত সংসারে লাইন ক্লিয়ার পাওয়া খুব কঠিন। দেখো না মোবাইলে বাজে “দা নাম্বার ইউ ডায়ালড ইজ বিজি নাও প্লিজ ট্রাই আফটার সাম টাইম”।
— কারো মন ডিএক্টিভ থাকলে ঢুকবো কি করে?

এই কথার পর আর কথা চলে না। বালিকাদের সাথে তর্ক করা মানে নিজের আহাম্মকি প্রকাশ করা। কেন জানি বললাম, “তুমি তো আমার অনেক জুনিয়র। কথাতে তো মা শা আল্লাহ পাকা”। এ কথায় বোমা বিস্ফোরণের মত হলো। এক ঝটকানি দিয়ে মুখের কাছে মুখ এনে ঝামটা মেরে বললো, “থাকেন আপনি ঐ বুড়িরে নিয়ে”। আমি হতভম্ব। ছায়া বিকট আওয়াজ করে ছাদের দরোজার উপর রাগ দেখিয়ে শব্দ করে চলে গেলো। সেই শব্দের উৎস সন্ধানে কেয়া তদন্তে এলো। তদন্ত একটা বাহানা মাত্র। বললো, “কে এসেছিলো? আর দরোজায় এত শব্দই বা হলো কেন”? আমার মাথা ঝিম ঝিম করছে। এখানে থাকলে আমি নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবো। কথা কমাতে, ঝামেলা এড়াতে বললাম, “কই কেউ না তো। হয়ত বাতাসে শব্দ হয়েছে”। বালিকারা গোয়েন্দাগিরিতে দক্ষ। গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঠিকই বের করে ফেলেছে ছায়া এসেছিলো। মেয়েলী পারফিউমের গন্ধ নাকি পাওয়া যাচ্ছে। আমি বিস্ময়ে হতবাক। হে ধরণী দ্বিখন্ডিত হও, আমি প্রবেশ করি। আমার লেখাপড়া রসাতলে যাওয়ার পথে। যাওয়ার পথে কি? অলরেডি চলে গেছে। নিজেকে এ মুহুর্তে খুব অসহায় লাগছে। কেয়া এসে বললো, “ল্যান্ড লর্ডের মেয়ে এত ঘন ঘন কেন আসে তোমার কাছে? কি চায় সে”? কেয়ার কথা আমি ক্লাসমেট বিবেচনায় রসিকতা হিসেবে নেই। আজ তার কথা মর্মে গিয়ে লাগলো। রক্ত গরম করে দিলো। বিশেষত তার শব্দ চয়ন অত্যন্ত নিম্নমানের আর আপত্তিকর ঠেকলো। ‘ল্যান্ড লর্ড’ শব্দ উল্লেখ করে প্রকারান্তরে সে আমাকে চূড়ান্ত হেয় করেছে। বললাম, “তুমি কেন আসো? কি চাও আমার কাছে”?
— আমি তোমার ক্লাসমেট
— তো
— আমাদের কথাবার্তা থাকতেই পারে
— তো
–ওই অল্প বয়সী মেয়ের চেয়ে আমি কম কিসে?
— তো
— কত ভালো ভালো প্রপোজাল এসেছিল। না করে দিয়াছি
— কেন?
— তোমার মাথা খাবো বলে। এই বলে একই রুপ আওয়াজ তুলে ছাদের দরোজায় প্রচন্ড ধাক্কা মেরে কেয়া চলে গেলো।

অবশেষে আমার বোধোদয় চূড়ান্ত হলো। এনাফ ইজ এনাফ। হেথা নয় হোথা নয় অন্য কোন খানে আমার গন্তব্য গাড়তে হবে। অতএব ব্যাক টু স্কয়ার। সেই আগের আইডিয়াতেই ফিরে যেতে হলো। চার বন্ধু মিলে তড়িঘড়ি করে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম। বাবাকে বললাম গ্রুপ ডিসকাশনের মাধ্যমে বাকি ক’মাস না পড়লে হবে না। বাক্স পেটরা নিয়ে যাবার সময় নাটক হলো। কেউ কিছু বুঝলো না। আমি বুঝলাম। খবরটা জানার পর থেকে আন্টির সে কি দশা!

এদিকে বাবার শারিরীক অবস্থার আরো অবনতি হতে থাকলো। বড় বোনের বিয়ের সম্মন্ধ আসতে থাকলো। বয়স বেশি হয়ে গেলে মেয়েদের সম্পর্ক আগের মত আর আসেনা। আসলেও কেন বিয়ে হয়নি সে প্রশ্ন দারুণ প্রশ্নবোধক হয়ে ঘুরপাক খায়। কনে পক্ষ হিসেবে অস্বস্তি বোধ করি। বড় আপা তো বটেই। শেষমেশ বড় আপার বিয়ে হয়ে গেলো। হাসবেন্ড ভার্সিটির কেমিস্ট্রির এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর।

সেই ছায়া মেডিক্যালে চান্স পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছে। আমার উপর তার ভীষণ অভিমান আর ক্ষোভ। তার মনে হয়েছে আমি তাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেইনি। জুনিয়র বলে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। ভাবটা এমন যে, এবার তার দেখাবার পালা। আন্টি বাসায় ডেকে পাঠালেন। সবাই খুব খুশি। স্বল্প দিন হলেও ছায়া আমার ছাত্রী ছিলো। তাই আমারও খুশী লাগছে। দেখা হতেই বললাম, “কংগ্রেচুলেশন”। ফোঁড়ন কেটে বললো, “থাক লাগবেনা”। বললাম, “খবরটা শোনার পর থেকে আমার ভীষণ ভালো লাগছে”।
— কেন?
— বাহরে। এত ভাল করেছো। মেডিক্যালে চান্স পায় কয়জন?
— কৃতিত্ব নিতে চাচ্ছেন?
— কখনো কি এমন বলেছি?
— নিতেই পারেন। আফটার অল টিচার ছিলেন তো
— খোঁটা দিচ্ছো?
— মোটেই না। আমি বরং আপনার কাছে খুব কৃতজ্ঞ
— কেন?
— আপনার অবজ্ঞা আমাকে জেদি করেছে। আমি নিজেকে সেভাবেই প্রিপেয়ার্ড করেছি। লিভ ইট। আপনার সেই
কেয়া না ফেয়ার খবর কি?
— যোগাযোগ নেই
— আহারে। সো স্যাড। পাখী অন্য ডালে বসেছে বোধহয়।
— প্লিজ স্টপ ইট।
— খুব লাগলো বুঝি?

ছায়াদের বাসা থেকে ফিরে ভাবছিলাম এলোমেলো অনেক কিছু। মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রেক্ষাপটই আলাদা। এখানে শিক্ষার আলো থাকে, নীতিবোধ পরিষ্কার থাকে, মান-অপমানবোধ টন্টনে থাকে। সীমাবদ্ধতা যেমন থাকে তেমনি স্ব-আরোপিত বিধি-নিষেধও থাকে। আর্থিক টানাপোড়েন থাকে কিন্তু সন্তুষ্টিও থাকে। এডজাস্টমেন্ট এদের জীবনে সহজাত। আর দশজনের মত তাদেরও সাধ-আহ্লাদ থাকে। আবেগ অনুভূতিও টইটম্বুর থাকে। এদের জীবনেও প্রেম আসে। কখনও গোপনে, কখনও সিনেমেটিক ধাক্কা মেরে।

এর মধ্যে অনেকগুলো ঘটনা পর্যায়ক্রমিক ঘটে গেছে। আমার বিসিএস এর নিয়োগপত্র এসেছে। স্বপ্ন পূরণের আনন্দে বাবার চোখে অশ্রু দেখেছি। মা জড়িয়ে ধরে ছোটবেলার মত মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়েছে। গ্রাম জুড়ে আনন্দোৎসব। বাড়ী ভর্তি লোকজনের সমাগম। ছায়া রংপুর মেডিক্যালে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে। খুশিতে ঘন ঘন ফোন দেয়। লম্বা সময় ধরে কথা বলে। ইদানীং তার কথাবার্তায় ওজন বেড়েছে। সেই সাথে প্রভাব বিস্তারের মনোভাবও। আর কেয়া হুট করেই যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। শুনেছি কানাডা প্রবাসীকে বিয়ে করে কানাডায় চলে গেছে। ভালোই করেছে। এরিমধ্যে বোনের ছেলে হয়েছে। আব্বার স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতিও হয়েছে।
কাকতালীয়ভাবে আমার পোস্টিং হয়েছে রংপুর ডিসি অফিসে। বাবা-মা বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। মা খেতে দিয়ে পাশে বসে বললো,“ছায়াকে কেমন লাগে”? আমি কিছু না বুঝেই উত্তর দিলাম,“কোন ছায়া”? পরক্ষণেই বুঝতে পেরে বললাম,“কেন, কি হয়েছে”? মা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,“তোর বাবা জিজ্ঞেস করছিলো। তাই”। বুঝলাম বাবার পছন্দ। পরে আরো শুনলাম উভয় পরিবার এরিমধ্যে গোল টেবিল বৈঠকে বসে প্রাথমিক আলাপ সেরেও রেখেছে। ছায়াও জানে। সে রাজী। হঠাৎই মনে পড়ে গেলো কয়েকদিন আগের কথা। ফোনালাপের এক পর্যায়ে ছায়া আচমকা বলে বসলো,“অবশেষে সব পাখী ঘরে ফিরে”। আমি কিছু না ভেবেই জাস্ট মজা নেওয়ার জন্য বলেছিলাম,“পাখী এখন মগডালে”। ছায়াও কম যায় না। বললো,“ডানা কেটে দিলে ঠিকানা এই হাসপাতালে”।

তার এই কথার শানে নুযুল এখন বুঝতে পারছি।

About

Anwar Hakim

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}