রোকেয়া হল মেইন বিল্ডিং ৪৬ এ আমার রুমমেট তখন লায়লা আপা। মানে বর্তমানে পোল্যান্ডের অ্যাম্বাসেডর সুলতানা লায়লা হোসেইন। লায়লা আপার সাথে আমার সম্পর্ক বোন আর বান্ধবীর থেকে একটু বেশী। দুজন দুজনের কাছে পেটের কথা না বললে যেন ভাত হজম হয় না। সারারাত জেগে দুজনে আড্ডা দেই আর গান শুনি ।

লায়লা আপাকে বললাম, টিংকু ভাইয়ের সাথে কাল চা খেতে যাবো সকালে। সঙ্গে সঙ্গে লায়লা আপা বললেন, ”অসম্ভব কিছুতেই আমি যেতে দিবো না তোমাকে।বুঝতে পারছ না মুন্নি তুমি বিপদে পরবে।”

লায়লা আপার কথা শিরোধার্য । সকালে চা খেতে গেলাম না। এমন কি টিংকু ভাইয়ের সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করারও চেষ্টা করলাম না।

বেশ কিছুদিন পর আমার ল্যাবে হঠাৎ হন্তদন্ত টিংকুভাই এসে হাজির। বললেন ক্ষমা চাইতে এসেছি, সেদিন সকালে আসতে পারিনি বলে। লায়লা আপার পরামর্শ মত এবার আমি মেপে মেপে কথা বললাম, মেপে মেপে হাসলাম।

ল্যাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করছি আর টিংকু ভাই আমার পাশে উঁচু টুলটাতে বসে কথা বলছেন । মশিউজ্জামান স্যারকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বললেন আপনার ছাত্রীর কাছে একটু প্রয়োজনে এসেছি। স্যার আর টিংকু ভাই দুজন দুজনের পূর্ব পরিচিত। স্যার স্বভাব সুলভ হালকা হাসি টেনে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন আমার ছাত্রীর গন্তব্য বহুদূর। মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছে সবে মাত্র, আসল পড়াশুনায় ঢুকবে এখন, বিদেশ থেকে বড় বড় ডিগ্রী আনবে।বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে নতুবা বৈজ্ঞানিক হবে।

স্যার চলে যাওয়ার পর টিংকু ভাই বললেন, ” যতই লেখা পড়ার কথা বল আমি জানি দুদিন পর তোমার বিয়ে হয়ে যাবে।আমার সাথে তোমার হয়তো কোনদিনই দেখা হবে না আর, কিন্তু যখন চায়ের পেয়ালা হাতে নিবে তখনই আমাকে মনে পরবে। তখন আফসোসের চেয়ে আগামীকাল সকালে চল একসাথে চা খাই।”

আজ লায়লা আপা নেই, রুমে আমি একা। ফজর নামাজ শেষে কতক্ষণ পায়চারী করলাম।হেঁটে হেঁটে একবার ভাবি যাবো আরেকবার ভাবি যাবো না। অবশেষে কাপড় পরে টিএসসির সামনে এসে দাঁড়ালাম। নীল রঙের গাড়ির ভেতরে টিংকু ভাই বসে আছেন । বললাম বাইরে আসেন হেঁটে হেঁটে চা খেতে যাবো, ওখান থেকে কার্জন হল।আপনি রিকশা নিয়ে ফিরে আসবেন।

টিংকু ভাই নামতে না নামতেই বৃষ্টি শুরু হল।তিনি বললেন বৃষ্টি শেষ হওয়া পর্যন্ত গাড়িতে বসে অপেক্ষা করি। ভাবার সুযোগ নেই কারণ আমি ভিজে যাচ্ছি।তিনি বললেন চল ক্যাম্পাসের চারিপাশ ঘুরে আসি । এতো বৃষ্টি বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না । কিন্তু কোথায় ক্যাম্পাস, গাড়ি চলছে এয়ারপোর্ট রোড ধরে ফাঁকা রাস্তায়।

ভীষণ ভয় পেয়ে বললাম ফিরে চলুন, আমাকে ক্যাম্পাসে নামানোর আগে গাড়ি থামাবেন না প্লিজ । এতো বৃষ্টিতে গাড়ি এক্সিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা কারণ সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে, আমি সীটের সাথে সেঁটে বসে আছি। রাস্তার পাশে গাড়ি চলা হঠাৎ থামিয়ে বললেন গান শুনবে, গান শুনলে তোমার ভালো লাগবে। আমি কোনমতে সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালাম। তিনি ছাড়লেন সুমনের গান — প্রথমত আমি তোমাকে চাই, দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই, তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই —- । এই গানের অর্থ আমি বুঝি কিন্তু কোন কথা বলছি না, তাঁর দিকে তাকাচ্ছিও না।নীচের দিকে তাকিয়ে কোনোমতে বললাম, ”আপনি জানেন তো কদিন পর আমার বিয়ে, সব ঠিকঠাক।”

কোন কিছু না বলে তিনি গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। কারো মুখে কোন কথা নেই। তিনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন না আর। সোজা রাস্তার দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। গাড়িতে বেজে চলেছে সুমনের ক্যাসেট। হঠাৎ জেনি কাবাব ঘরের সামনে গাড়ি পার্ক করে বললেন নামো তোমাকে চা খাওয়াই। ততোক্ষণে বৃষ্টি ধরে এসেছে। চা খেতে খেতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার লক্ষে কথা বলা শুরু করলাম ।

টিংকু ভাই তাঁর জীবনের প্রচণ্ড হতাশা আর কষ্টের কথা বললেন, একাকীত্বের কথা বললেন। বললেন প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে মনে হয় না ভাঙ্গলেই বুঝি ভালো ছিল, পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা প্রতি মুহূর্তে প্রচণ্ড কষ্টসাধ্য মনে হয় ।রুবেল, রাজ্জাক, টিটন, কল্লোল সহ আরও অনেকে পালাক্রমে ভালবেসে তাঁর সঙ্গে থাকে কেবলই তাঁকে আগলে রাখার জন্য।

কোন কিছু চিন্তা না করেই বলে ফেললাম, ”এসব কিছুর জন্য আপনিই তো দায়ী।”

রেগে গেলে নাকি কষ্ট পেলে চোখ লাল হয় ! এখন তাঁর চোখ দুটো জবা ফুলের মত টকটকে লাল, মনে হচ্ছে বুঝিবা রক্ত ঝরবে। কোন উত্তর না দিয়ে বললেন চল ফিরি।

গাড়ি এবার ফিরতে শুরু করলো, দুজনেই নিশ্চুপ। পুরো রাস্তায় কোন কথা হল না, কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছিও না। কার্জন হলে নামার আগে ক্যাসেটটি হাতে দিয়ে বললেন, আমাকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে গাড়ি ঘুরিয়ে সাঁ করে চলে গেলেন।

ভীষণ খারাপ লাগছে সরাসরি আঘাত দিয়ে এভাবে বলাটা কি ঠিক হল ?

চলবে…

About

Khugesta Nur E Naharin

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}