২০১২ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি আমার স্বামী ডাঃ জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর মৃত্যুর পর আমি ক্রমান্বয়ে বিষাদে ডুবে যেতে রইলাম। বাইরে থেকে বুঝার উপায় নেই ভেতরে কি লঙ্কাকাণ্ডই না ঘটে যাচ্ছে। সারাক্ষণ খাই আর ঘুমাই । একটা সময় বিশ্বাস করতে শুরু করলাম রোজ রাতে সংগোপনে টিংকু আমার সাথে দেখা করতে আসে। প্রায় ২ বছর একই ভাবে কেটে গেল। কিন্তু কাউকে বলি না, বুঝি লোকে জানলে আমাকে পাগল ঠাওরাবে। এটা মূলত মেসিভ ডিপ্রেশন, ফলশ্রুতিতে ওবেসিটি বা স্থূলতা। অথচ সবাই জানলো আমি সহজে সব কিছু মেনে নিতে পারি।
আমার স্বামীর মৃত্যুর সাথে সাথে আরও একটি বিষয় ঘটল তা হচ্ছে আমার স্বাভাবিক ২৮ দিনের পিরিয়ডের সাইকেল একেবারে বন্ধ হয়ে গেলো। ভাবলাম আর্লি মেনোপজ। মানসিক শকে হঠাৎ এমনটি ঘটতে পারে এটাও জানতাম ।ঠিক এক বছর পর আবার যখন পিরিয়ড শুরু হল ডাঃ লায়লা আঞ্জুমান্দ বানুর স্মরনাপন্ন হলাম । পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তিনি জানালেন পুরো জরায়ু ফাইব্রয়েডে ঠাসা । বার্থ কন্ট্রোল পিল এবং সঙ্গে আরও কিছু হরমোনাল ওষুধ দিলেন পিরিয়ডের সাইকেল ঠিক রাখার জন্য।
আমার সরাসরি ব্লাড লাইন অর্থাৎ নানা-নানী, দাদা-দাদী কিংবা আমার বাবা-মায়ের দীর্ঘ জীবনকাল। তাঁদের জিনে ক্যান্সারের ইতিহাস নেই। কিন্তু তবুও প্রতি বছর পেপ স্মেয়ার (ক্যান্সার টেস্ট যা নারীর যোনি পথ তথা জরায়ু মুখের সুস্থতার জন্য জরুরী) টেস্ট করি। জরায়ুর বাইরে এবং ভেতরে আলট্রাসাউন্ড টেস্ট করি,বাইওপ্সি করি। এক ডাক্তার থেকে আরেক ডাক্তারের পিছু ঘুরতে থাকি । গত ডিসেম্বরে ডাঃ ফারহানা তারান্নুম জানান আপনার ফাইব্রয়েড গুলো ছোট হয়ে আসছে একসময় হয়তোবা মিলিয়ে যাবে।
প্রতিটি দাম্পত্যে নিজস্ব একটি রসায়ন থাকে । কিন্তু প্রায় সব দাম্পত্যে প্রথম ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যেই সমস্ত চাওয়া-পাওয়া, ভুল-শুদ্ধ, পাওয়া-না পাওয়া ছকে ফেলে মিলিয়ে নেওয়া যায়। পরবর্তী সময় শান্তি রক্ষার্থে কেবলই প্রয়োজন বুঝাপরার, মেনে নতুবা মানিয়ে নেওয়ার।
প্রচণ্ড প্রানবন্ত, সদালাপী, আড্ডাবাজ, বহিমিয়ান টিংকুকে আঁচলে বাঁধার সাধ্য আমার নেই । তাই বলে আহাজারি করবো, বিলাপ করে, একাকীত্বে ভুগে কাল ক্ষেপণ করবো এতোটা বোকাও তো নই। ঘর সাজানো, বাজার করা, রান্না-বান্না, দুই সন্তানকে লালন পালনের পাশাপাশি নতুন নেশা এবং পেশা নিজ যোগ্যতায় অর্থ উপার্জন। স্বামী-সন্তান-সংসারের সমান্তরালে নতুন সংযোজন ক্যারিয়ার তথা নিজস্ব পরিচিতি।নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার এই রেসে আমার জয় সুনিশ্চিত, এই সত্যটি আমি যেমন জানি টিংকুও জানে। কারণ আমি কেবল আত্মবিশ্বাসী এবং পরিশ্রমীই নই, জেদী আর সাহসীও।
সিংহ পুরুষ সবসময় সবকিছুর কেন্দ্রে থাকতে পছন্দ করে।তাই আমার স্বামী সবসময় আমার জীবনের কেন্দ্র বিন্দুতে থাকতে কৌশল বের করল নতুন করে আরও একটি সন্তান জন্ম দানের ।সে জানে আমার পৃথিবী মানে আমার সন্তানেরা, দুই সন্তানকে ঘিরেই আমার জীবন।
কিন্তু সংসার নিয়ে সমস্ত হিসেব-নিকেশ আর চাওয়া-পাওয়ার পরিসমাপ্তির পর নতুন সন্তান মানে নতুন বিড়ম্বনা, বাড়তি দায়িত্ব, আমার বছর পাঁচেক পিছিয়ে যাওয়া । তাছাড়া দ্বিতীয়বার গর্ভাবস্থায় এক্লামসিয়া স্টার্ট হওয়ায় ডাক্তার আমাকে নিষেধ করেছেন ফারদার বাচ্চা নিতে। আমার মেয়েটিকে পরিপূর্ণ সময়ের আগেই অস্রপাচারে ৭ মাসে বের করতে হয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত ব্লাড প্রেশারে সিজারিয়ান অপারেশনের সেলাই উপচে রক্ত পরা বন্ধ হচ্ছিল না বলে ৩৬ ঘণ্টা আইসিইউ তে থাকতে হয়েছে আর সদ্যজাত কন্যার পরিপূর্ণ বিকাশ না হওয়ায় ইনকিউবিটরে । সাংসারিক অভিজ্ঞতায় জানি সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব ভাগাভাগিতে পিতার অংশ গ্রহণ শূন্য। অতএব ও পথে পা’ বাড়ানোর সুযোগ নেই আর।
অনেক নারী যেমন ইনফারটাইল অর্থাৎ সন্তান ধারণে অক্ষম থাকে অল্প সংখ্যক হলেও কিছু নারী অধিকতর সক্ষম হয়। রেয়ার ক্ষেত্রে কিছু নারীর শরীরে বার্থ কন্ট্রোল পিল কাজ করে না এমন কি কোন সেফ প্রিওডও থাকে না। আমি শেষের শ্রেণীভুক্ত, রেয়ার গ্রুপের একজন। একবার অরক্ষিত যৌন মিলন মানেই নিশ্চিত গর্ভ ধারণ।
সবসময় ”আই পিল” সঙ্গে রাখি, এডে আকৃষ্ট হয়ে সমানে আই পিল খাই লুকিয়ে । এটা স্বামীর সাথে আমার টম এন্ড জেরির মত করে মূলত কতৃত্বের লড়াই।
অপেক্ষার প্রহর কত দীর্ঘ হয় একমাত্র ভুক্তভোগীই জানেন ।কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোন মানে নেই । আমি ভীষণ মনযোগী ছাত্রী বিধায় ৮/৯ বছরের সাংসার জীবনের পাঠ থেকে শিখেছি নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ অন্য কারো হাতে ছাড়তে নেই।
তবে কি এই ”আই পিল”ই আমার ফাইব্রয়েডের জন্য দায়ী। চটকদার বিজ্ঞাপনে কখনো কোন সতর্ক বানী লেখা থাকে না। লেখা থাকে না পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার করুণ ইতিহাস । লেখা থাকে না কদিন পর পর নেওয়া যায়, কোন ঝুঁকি আছে কি নেই??
আজকের তরুণী নারী ১০ বছর পর যেয়ে হয়ত একদিন হঠাৎ কোন এক অমাবস্যার রাতে জানতে পারবে তাঁর শরীরের ক্যান্সার মূলত প্রেমিক বা স্বামীর ক্ষণিকের সুখের খেসারত। কিংবা কে জানে হয়ত খুঁজেই পাবে না সঠিক কারণ কি হতে পারে। কপারটি কিংবা বার্থ কন্ট্রোল পিলও যে শরীরের জন্য কতোটা ক্ষতিকর তাঁর সচেতনতা কজনের আছে।
উন্নত দেশগুলোতে প্রতিটি হাইস্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভলেন্টিয়াররা ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে বিনা মূল্যে কনডম বিতরণ করে। শারীরিক সুস্থতায় নানা রোগ, প্রজনন স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সবাইকে সচেতন করে।আমাদের দেশে কনডম শব্দটিই ভীষণ লজ্জার। নারী তো দূরের কথা পুরুষরা কিনতে যেয়েও অস্বস্তিতে ভুগে।
২০১৭ এর শেষ দিকে হঠাৎ স্তনে চাকা অনুভব করলে ডাঃ ফারহানা আক্তার সুমির কাছে গেলাম। দীর্ঘ ৬ মাস মেমোগ্রাফি সহ নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানালেন এটা বিনাইন । তবে খেয়াল রাখতে হবে আকারে বাড়তে শুরু করা মাত্রই অপারেশন করতে হবে। দ্বিতীয় মতামতের জন্য ডাঃ নিশাত আপার কাছে গেলাম। নিশাত আপা বললেন এটা একেবারেই স্বাভাবিক। মধ্য বয়সী ৬৬% মহিলার স্তনেই এমন চাকা দেখা যায়। আমি বার বার দুই ডাক্তারকেই জিজ্ঞেস করলাম আপা কেটে ফেলতে হবে, এটা কি ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে?
দুইজন ডাক্তারই আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন নিতান্ত কপাল মন্দ না হলে ক্যান্সারে পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
আমার মেজো ভাই ডাক্তার, তিনি বললেন, ”তুমি একবার মাও ভাইকে দেখাও।” স্তন পরীক্ষার জন্য পুরুষ ডাক্তারের কাছে যেতে কেমন অস্বস্তি হল আমার। অথচ পুরুষ ডাক্তার না দেখানোর সেদিনের হীনমন্যতা আজ আমায় পীড়া দিচ্ছে। ডাক্তার তো ডাক্তারই পুরুষ অথবা নারীতে কি আসে যায়। বরং মাও ভাইকে দেখালে তিনি হয়তো তখনই কেটে ফেলতে বলতেন।
আমি ক্রমাগত আমার স্তনে থাকা ছোট্ট জমাট বাধা জায়গাটাতে হাত বুলাই, ধরে বুঝার চেষ্টা করি বেড়েছে কি না। একদিন অফিসের লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমি লক্ষ করি সবাই আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আর ততোধিক অবাক চোখে আমি তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকি, কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করি। তাঁদের অবাক হওয়ার মুল কারণ সবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমি স্থান কাল ভুলে আনমনে আমার স্তনে হাত দিয়ে গোটার অস্তিত্ব বুঝার চেষ্টা করছি। এই আচরণ আমার ব্যক্তিত্বের সাথে একেবারেই বেমানান বলে ওরা মিলাতে পারছে না কিছুতেই । ভীষণ লজ্জা পেলাম, নিজেকে আচ্ছা করে শাসন করলাম আর যাতে এমনটি না ঘটে।
২০১৮ তে আমার পা ভেঙ্গে তিন মাস বিছানায় থাকার সুবাদে নতুন করে শুরু হল ডিপ্রেশন। সেই সাথে যোগ হল মায়ের মৃত্যু। ২০২০/২১ করোনায় সবকিছু ভুলে গেছি। একটু বুঝি অস্বস্তি হচ্ছে, হঠাৎ মনে হল আমার শরীর চেক করা হয়নি মাঝের অনেক গুলো বছর।
আবার ভাবি যেহেতু ইউটেরাসের ফাইব্রয়েড মিলিয়ে গেছে স্তনের গুলোও নিশ্চয়ই মিলিয়ে যাবে একদিন।
ডাক্তার দেখাতে এবং আলট্রা সাউন্ড করতে আগে থেকে নাম লেখাতে হয়। ১ লা সেপ্টেম্বর আমি আলট্রা সাউন্ডের সিরিয়াল পেলাম কিন্তু ডাঃ সুমির সিরিয়াল দিতে দেরী হয়ে গেল।
ডাক্তার মহিলার চেহারার দিকে তাকিয়ে আলট্রা সাউন্ডের রিপোর্ট পড়ার সাহস হচ্ছিল না কিছুতেই। কোনমতে জোড় করে চেম্বারে ঢুকে সুমি আপাকে রিপোর্ট দেখানোর পর সুমি আপা বললেন রেজাল্ট একটু খারাপ। আপনাকে অপারেশন করতে হবে এই পরীক্ষাগুলো এখনই করিয়ে ফেলেন।
সমস্ত পরীক্ষা করানোর পর আমি মেজো ভাইকে ফোন দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরলাম। মেজো ভাই বললেন কাল আমি তোমাকে মাও ভাই মানে অঙ্কলজিস্ট (ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ) এবং অঙ্কলজি সার্জন ডাঃ আহমেদ সাইদ মাও এর কাছে নিয়ে যাবো।
চলবে…