২ রা সেপ্টেম্বর ডাঃ আহমেদ সাইদ মাও ভাই আমার মেমোগ্রাফি রিপোর্ট, আলট্রাসনোর রিপোর্ট দেখে বললেন সবকিছু তো আগের মতোই আছে সাইজে খুব একটা চেঞ্জ নেই। ৫ বছর ধরে ক্যান্সার এক জায়গায় বসে থাকে কেমনে?

আমি উত্তর দিলাম আলট্রা সাউন্ড করার সময় ডাক্তার বলেছেন কোষে পরিবর্তন এসেছে। ডাঃ সাইদ ভাই বললেন কোর বাইওপ্সি করতে হবে।আমি বললাম তবে আজই হোক।

বাসায় আমি একা থাকি আজ আমার মেজো ভাই সারাদিন আমার সঙ্গে থাকলেন।দুপুরে দুজনে একসাথে খেলাম, গল্প করলাম। ভাই মূলত আমার টেনশন কমানোর চেষ্টা করছেন।চেষ্টা করছেন মানসিক আশ্রয়টুকু দেওয়ার।বয়সের তফাৎ অতিক্রম করে আমরা ভাই বোনরা মূলত একে অপরের বন্ধু।আমাদের পরিবার আমাদের শিখিয়েছে সব কিছুর ঊর্ধ্বে পারস্পরিক সহানুভূতি, সহমর্মিতা একের বিপদে অপরে পাশে থেকে সাহায্য করাই হচ্ছে সম্পর্ক।

কোর বাইওপ্সি হচ্ছে চারিপাশ অবশ করে নিয়ে লাম্প বা টিউমার থেকে নির্জাস বের করে পরীক্ষা করা।সাধারণত এই কোর বাইওপ্সিতেই নির্ণীত হয় ক্যান্সারের ধরণ এবং আচরণ। ৬ তারিখে রিপোর্টে এবারও এলো সাস্পেকটেড কার্সিনোমা। অধৈর্য আমি বললাম কালকেই অপারেশন করেন হয় পজেটিভ আসবে নতুবা নিগেটিভ এই দোদুল্যমানতা নিতে পারছি না আর।

অপারেশন টেবিলে অজ্ঞান করে কেটে ফেলা শরীরের অংশ ফ্রোজেন সেকশনে আনোয়ার খান ডাইয়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো হলে পরীক্ষা করে তাঁরা জানালেন ”নন ইনভেসিভ” মানে হচ্ছে ক্যান্সার সেল থাকলেও তা অতো বেশী ক্ষতিকারক নয় কিন্তু ৭ দিন পরের রিপোর্ট এলো অল্প সংখ্যক হলেও একটিভ সেল বিদ্যমান।

আমি টিংকুর বন্ধু রেডিও অঙ্কলজিস্ট মুস্তাক ভাইকে সমস্ত রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়ে জানতে চাইলাম, “বাঁচবো তো?”

সাত দিন পর বোর্ড হল । বোর্ডে উপস্থিত ছিলেন এ এম এম শরিফুল আলম,(প্রফেসর এবং হেড অফ অঙ্কলজি AMC& GH) , Prof. Hafijur Rahman Ansari ( Prof. of Rediotherapy Asgor Ali hospital) , Prof. Ahmed Sayeed ( Prof. & Ex-Head Of Surgery HFRCMC & H), Prof. Golam Mohiuddin Faruk (prof. & Ex-Head of Radiotherapy DMCH), Prof. Qazi Mushtaq Hussain (Prof. of Radiotherapy & Ex-director NICHR)। সবাই মিলে ডিসিশন দিলেন ৮ সাইকেল কেমো নেওয়ার পর রেডিওথেরাপি।সবশেষে হরমোন হরমোন ট্রিটমেন্ট। কিন্তু সবার আগে ”পেট স্ক্যান” করে দেখা জরুরী শরীরের আর কোথাও ছড়িয়েছে কি না।

১৯ তারিখ রাত ১২ টায় আমার সন্তানেরা কানাডা থেকে চলে এলো। ওদের বাবা ১১ বছর আগে ব্রেইন ক্যান্সারে মারা গেছেন। মায়ের ক্যান্সার শুনে কি করে দূরে থাকে!

বাংলাদেশে তিন জায়গায় ”পেট স্ক্যান” মেশিন আছে। সরকারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল (পিজি), মেডিনোভা আর ইউনাইটেড হাসপাতাল। কিন্তু সিরিয়াল পাওয়া কঠিন। অনেক কষ্ট করে ২৮ তারিখে মেডিনোভায় সিরিয়াল পেলাম, অগ্রিম টাকা দিয়ে সিরিয়াল নিশ্চিত করতে হল।

ভীষণ মন খারাপ কত গুলো সূতির শাড়ির ভাজই খোলা হয়নি, এখনই সব শেষ ! এতো ছোট স্বপ্ন আর পাওয়া তবুও এভাবে নষ্ট হতে হয় ! আমার একটাই বদভ্যাস আর তা হচ্ছে সূতি শাড়ি কেনা। সদ্য পাটভাঙ্গা সূতি শাড়ির নিজস্ব একটি ঘ্রাণ থাকে যা মনকে আহ্লাদিত করে।

প্রতিটি শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে কত প্রেম, কত না বলা কথা, কত সুখ স্মৃতি আর দীর্ঘশ্বাস যে লুকিয়ে থাকে মালিক ব্যতীরে কেউ তাঁর খবর জানে না।

বেশীরভাগ সময় আমার সূতি শাড়ি পরা দেখে অনেকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভরে কটু মন্তব্য করতে পিছপা হননি বিয়ের শুরুতে। কিন্তু সূতি শাড়ি জীবনের প্রথম প্রেম তাকে এতো সহজে ছাড়ি কি করে ? ২৯ বছর কেটে গেছে এক ফোঁটাও বদলাইনি । কেবল কোমর ছাপানো দীঘল কালো কেশ ঘাড়ের উপড়ে উঠেছে তাই বলে আমি নই বয়স দায়ী।

আভিজাত শ্রেণির বড় বড় ক্লাবগুলোতে এলিট রূপবতী নারীরা নানা রঙে নানা ঢঙে বাহারি শাড়ি আর অলঙ্কারে নিজেকে সাঁজায় । তাঁদের প্রসাধন, পোশাক আসাক, ব্র্যান্ডেড হ্যান্ড ব্যাগ, জুতা আর উপস্থাপন দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।

কিন্তু আমি তো কোন ধনী লোকের অদুরী বউ নই, তবে কেন তাঁদের সাথে এই প্রতিযোগিতায় যাবো ? সারা জীবন বইয়ের মাঝে আনন্দ খোঁজে ফিরেছি,পৃথিবীর জানা অজানা তথ্য সম্বন্ধে নিজেকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টায় মগ্ন থেকেছি । তাঁদের সাথে আমার দৃষ্টি ভঙ্গী আর পছন্দের ফারাক থাকা স্বাভাবিক। যে যা মন্তব্য করুক যা ইচ্ছা ভাবুক আমি সুতি শাড়িতেই স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করি। পোশাক মানুষের ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ, সব ফেশান সবার জন্য যেমন নয়, আবার ইচ্ছা করলেও সবাইকে সব কিছু মানায় না।

মনে মনে চিন্তা করলাম চুল পরে যাওয়ার আগে নতুন নতুন সূতি শাড়ি পরে প্রতিদিন একটি করে ছবি তুলবো। কিন্তু বিধি এবারও বাম, ২৫ তারিখ থেকে হাঁচি,কাশি, সর্দি, জ্বর । আহারে ভাইরাল ফিভার আমাকেই ধরতে হয় ! ২৮ তারিখে পেট স্ক্যানে ঢুকার আগে ভাইকে বললাম আমার প্রস্রাব আঁটকে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। ভাই বললেন তোমার মনের ভুল, অযথাই টেনশন করছো।

পেট স্ক্যান কয়েক ঘণ্টা ব্যাপী এক লম্বা প্রসেস। শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে রেডিয়েশন ঢুকিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর মেশিনের সাহায্য ডাই দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার পর ২৪ ঘণ্টা তাঁকে আইসলেসনে থাকতে বলা হয়। যত বেশী পানি খাবে প্রস্রাবের মাধ্যমে রেডিয়েশন বাইরে বের হবে। ২৪ ঘণ্টায় ৬ লিটার পানি খেয়ে সুস্থ হয়ে যখন অফিসের পথে রওনা হলাম পথি মধ্যেই বুঝলাম ভয়াবহ UTI অর্থাৎ ”urinary tract infection।” জ্বর আর তল পেট ব্যথায় কাঁদতে লাগলাম। ইতিমধ্যে জানলাম আমার শরীরে যে জ্বর তা মোটেও ভাইরাল ফিভার নয়। মূলত আমার চারিপাশের সবাই কোভিড আক্রান্ত । তারমানে আমারও কোভিড। রাজীব ভাই মানে ডাঃ হাসান শাহরিয়ার কবির কে ফোন দিলে বললেন সেফ ৩ তে কাজ হবে না নিনটোইন শুরু করো। ডাবল অ্যান্টি বাইওটিক আমার মেজো ভাই ও ডাঃ রিজভি ভাইয়ের দেওয়া সেফ ৩ ডিএস, ও নিনটোইন এস আর ১২ ঘণ্টা পর পর চলতে থাকলো। মোট ১৪ দিনের কোর্স।

চলবে…

About

Khugesta Nur E Naharin

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}