রোগটি মরণঘাতী হলে কখনো জিজ্ঞেস করতে নেই ”ডাক্তার কি বলেছেন।” ডাক্তার যদি বলে দেন ”তোমার হাতে আর সময় নেই” এই কথাটি সে কিংবা তাঁর কাছের মানুষরা কি করে জানাবে ! কষ্টে বুক বিদীর্ণ হবে।

যে অসুস্থ রোগী প্রাণ পণ চেষ্টা করছে বেঁচে থাকার তাঁকে আহা, উঁহু বলে জীবনী শক্তিটুকু কেড়ে নেবেন না। তাঁকে সাহায্য করুন কিন্তু ভুলেও দয়া দেখাবেন না। একজন রোগী জীবনের শেষ পর্যন্ত বাঁচতে চেষ্টা করে তাঁকে সেই সুযোগটুকু দেন। মরার আগে মেরে ফেলেন না আর।

একজন মানুষ নিভৃতে কত শতবার যে মরে তাঁর হিসেব কে রাখে । অসহায়ত্বে মরে, অপারগতায় মরে,অপমানে মরে, অবহেলায় মরে, অনাদরে মরে, প্রেমে মরে, প্রেমহীনতায় মরে, সামাজিক লোক লজ্জার ভয়ে মরে, অতীব ভালো মানুষীতে মরে আবার মাত্রাতিরিক্ত ভদ্রতায়ও মরে। প্রতিযোগীতা পূর্ণ এই জীবনে মানুষ কেবল মরতে থাকে, সম্পূর্ণ একা । তাঁর মরার খবর, নিঃশব্দ কান্নার আওয়াজ দেওয়াল ভেদ করে পাশের মানুষরা জানতে পারে না কখনো ।
আনন্দ, সুখ আর সুস্থতাকে আমরা গ্রেন্টেড বা নিশ্চিত হিসেবে ধরে নেই। ভাবি এটা আমার প্রাপ্য। অসুখ হবে দূরের একজনের, কষ্ট পাবে অন্য কেউ। কিন্তু যখন নিজের উপর আসে তখনই সুস্থতা আর সুখের মর্মার্থ উপলব্ধি করি। বুঝি কি ভীষণ আশীর্বাদপুষ্ট জীবনই না কাটিয়েছি এতোকাল ।

আজ সকালে ঘুম ভেঙ্গেছে ফজর নামাজের আজানের সাথে। এক সময় এই আজান সাথে ঘুম ভাঙ্গা ঘড়ির অ্যালার্ম ক্লকের মত ছিল।নামাজী পরিবার সবার জন্য নামাজ বাধ্যতামূলক। কানাডায় জামালপুরের সবাই মিলে দোয়া করেছেন আজ আজাদ ভাই, পলাশ আর আমার রোগ মুক্তির জন্য। ভোর সাড়ে ৫ টায় আমি জয়েন করেছিলাম তাঁদের সাথে ।

দোয়ার আনুষ্ঠানিকতায় আমরা অভ্যস্ত। প্রতিটি দোয়ায় বলা হয়ে থাকে,”তোমার প্রিয় হাতের উছিলায় আমাদের দোয়া কবুল করে নাও।”

কেউ যদি মন থেকে কারো প্রতি কৃতজ্ঞ হয় কিংবা কারো জন্য শুভকামনা করে সেটাই দোয়া হয়ে সঙ্গে থাকে।

আজ আমার আব্বার মৃত্যু বার্ষিকী অথচ আমাকে নিয়ে ব্যস্ত পরিবারের সবাই বেমালুম ভুলে গেছে । যদিও ইসলামে চল্লিশা, জন্ম এবং মৃত্যু বার্ষিকী পালন করার কোন নিয়ম নেই তবুও আমরা ভাই-বোন মিলে কিছু একটা করার চেষ্টা করি প্রতি বছর । জনহিতকর কোন কিছু করা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়। কাল রাতেও আমাদের তিন ভাই বোনের আড্ডায় পুরোটা জুড়েই ছিল আব্বা-আম্মা। আব্বার কোলে চড়ে পার করেছি কতগুলো বছর। বুকের উষ্ণতায় বেড়ে উঠা আমি কি করে ভুলে গেলাম দিনটিকে !

আজ শুনলাম অন্য এক নারীর হিপ জয়েন্ট, ক্লটিয়াস ক্যান্সার । শরীরটা ভয়ে কেঁপে উঠলো। সবচেয়ে সুন্দর আর সুখকর অঙ্গে কেন ক্যান্সার হয় !

এতো বিষণ্ণতার মাঝেও শুভ সংবাদ হচ্ছে আমি ভালো আছি। কিমোর প্রথম চার দিন ভীষণ অসুস্থ ছিলাম । চারিদিকে গন্ধ, ঘেন্নায় কিছু খেতে পারছিলাম না। বাদাম, ডালিম, কলা দিয়ে দুধ ভাত, ডাবের পানি আর ডাবের নরম শাঁসই ছিল মুল খাবার।অনেকে এই সময় চিকেন ব্রোথ বা কম মশলায় মুরগীর পাতলা সুপ খেতে পছন্দ করেন । মূলত কঠিন এই সময়টাতে যে যা খেতে পারেন মূলত তাই খাওয়া উচিত।

হাইড্রো থেরাপি মানে হচ্ছে প্রচুর পানি পান ওই সময়টাতে শরীরকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করবে ।

কিমোর ৭ দিন পর আজ ব্লাড সিবিসি উইথ প্লাটিলেট কাউন্ট অর্থাৎ রক্ত পরীক্ষা করতে দিয়েছি। আমার কন্যা শ্রেয়া ইউটিউব থেকে বেছে বেছে আমার পছন্দের গান শুনাচ্ছে।

দীর্ঘ মেয়াদী এই চিকিৎসায় সবচেয়ে প্রয়োজন ধৈর্য । মরে তো আমরা একদিন সবাই যাবো তাই বলে মরার আগে মরে যেতে চাই না কিছুতেই।

১২ বছর আগে আমার স্বামীকে ডাক্তার যখন চূড়ান্ত বলে দিলেন বড় জোর ৮ থেকে ১৫ মাস সময় আছে তাঁর হাতে। ভীষণ অসহায় মনে হল নিজেকে। আমার সমস্ত ভাষা নিমিষে হারিয়ে গেল, মৃত্যু পথ যাত্রী মানুষকে কি বলে সান্ত্বনা দিব!!
দুই শিশু সন্তান সহ মাত্র ৪০ পেরোনো আমারই বা কি হবে !

নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম চল আজ থেকে আমরা নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করি। ধরে নেই আমাদের সবার জীবনের আয়ু কেবলই ৪৮ বছর । এই ১৫ মাসে সবচেয়ে ভালো লাগার কাজগুলো করি, সবাইকে নিয়ে উৎসবে আনন্দে মেতে উঠি।

পরবর্তী সময়টা সবাইকে নিয়েই কাটিয়েছে টিংকু । অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে স্বাভাবিকতায় মেনে নেই। আজ তুমি কাল আমি পরশু অন্য কেউ।

টিংকু, আমাদের কি আবার কোনদিন দেখা হবে অন্য আলোয় অন্য কোন অচেনা ভুবনে।

About

Khugesta Nur E Naharin

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}