সত্তর এর দশকের শেষের দিকে চারটা মেয়ে রেখে আরেকটি সন্তান জন্মদিতে গিয়ে রুবানার মা যখন মারা গেলেন তখন রুবানার বড়ো বোন মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ে আর মেঝবোন সিক্সে সেজ রত্না ক্লাস ফোরে আর সে ক্লাস টু এর ছাত্রী।

মা মারা গেলেন ঠিকই কিন্তু আরাধ্য ছেলে সন্তান টি বেঁচে গেল। অকালে স্ত্রী হারিয়ে রুবার বাবা চোখে অন্ধকার দেখলেন। তিনি এখন ঘর সামলাবেন না চাকরি! এমতাবস্থায় রূবানারর খালা এগিয়ে আসলেন।তিনি রুবার সদ্যোজাত ভাইটি কে নিজের কাছে নিয়ে গেলেন।বড়ো মামির কোনো মেয়ে না থাকায় রুবাকে বড়ো মামি নিজের কাছে নিয়ে গেলে বড়ো তিন বোন কে দেখাশুনা করার জন্য দাদি ওদের সংসারে এসে থাকতে লাগলেন। কিছুদিন পরে রূবানার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে নিলেন। এবং ছোটো দুই বাচ্চাকে নিজের কাছে নিয়ে আসলেন।

রুবা জন্মের সময় ই বড়ো মামামামী তাকে তাদের করে তদের করে চেয়েছিলেন। তখন কি এক অজ্ঞাত কারণে রুবানার মা তাকে দেন নি। তাই আজ যখন সে এখানে এসেছিল তখন থেকেই তাঁরা তাকে নিজের করে নেন।একটু বড়ো হবার পর তার নিজ ইচছা তেই সে শহরে মামা মামির কাছে রয়ে যায়।তারা তাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন।সে ছুটি তে কখনো কখনো দুই তিন দিনের জন্য বাড়িতে আসে বোনেদের সাথে মিলেমিশে থেকে আবার মামির কাছে চলে যায়।

বছর চারেক এভাবেই কাটে।বড়োবোন লুবনার মেট্রিক পরীক্ষার পর পর ই এক প্রবাসী পাত্রের সাথে বিয়ে হয়ে যায়।তার পরের বছর ই মেঝবোন ঝর্ণার ও বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়, তাদের নতুন মা এর ইচ্ছে তে।

ইতোমধ্যে নতুন মা এর কোলে দুই ছেলে হয়।তিনি রুবানার মা মরা ভাই শিমুল কেও আদর যত্ন করে আগলে রাখেন। বাইরে থেকে কেউ ই বুঝতে পারেনা যে এটা তার নিজের পেটের সন্তান না।

একসময় রত্নার এস এস সি পরীক্ষার সামনে এক পাত্র রত্নাকে দেখে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে বাবা ইতস্তত করতে থাকেন কেননা এই মেয়েটির রঙ একটু চাপা হলেও পড়াশোনায় তুখোড় ছাত্রী।

প্রাইমারী ও জুনিয়র দুটো বত্তি পরীক্ষায় সে ট্যালেন্ট পুলে বৃত্তি পাওয়া ছাত্রী। কিন্তু মা এর কাছে তার ইচ্ছার কথা তিনি বলতে গেলে তিনি বলেন, মেয়ে শিক্ষিত হয়ে কিছু হতে গেলে অনেক বছর লাগবে পড়াতে, তারপরও তো সেই বিয়েই দিতে হবে আর তার ইনকাম তার স্বামীর ই কাজে লাগবে। কাজেই এতো পড়িয়ে লাভ কি!আর তার নিচে এই তিন ছেলে কেও তো পড়াতে হবে, মানুষের মতো মানুষ বানাতে হবে।

এর পর আসাদ সাহেব আর কথা বাড়ান নি।পরীক্ষার আগেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন।সেদিন রুবানা দেখেছিল তার বোনের কান্না।রত্না তার হাতদুটো ধরে বলেছিল, ছুটকি তুই মামা-মামী র কাছে ভালো হয়ে থাকিস আর মন দিয়ে লেখা পড়া করিস।আমার তো হলো না তুই কিছু করিস।”

রুবানা লেখা পড়ায় মোটামুটি ছিলো। তখন থেকে সে মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতে লাগলো। স্কুল টিচার মামি তাকে অসম্ভব ভালো বাসতেন এবং প্রচন্ড সহযোগিতা করতেন।উৎসাহ দিতেন নানারকম কাজে। এভাবেই একটা কাদামাটির নরম দলা রুবানাকে নিপুন কারিগরের মত নিজ ছাঁচে ফেলে গড়ে তুললেন।

তার তিন তিনটে ছেলে ই ছিলো ভদ্র ও মার্জিত। লেখাপড়ায় তুখোড়। তাই তারা রুবানাকেও পড়ালেখায় সাহায্য করতো।রুবানা যখন কলেজ ছাত্রী তখন থেকেই মামাতো মেঝভাই জানিয়ে দিল সে তাকে পছন্দ করে এবং বিয়ে করতে চায়।মামীর ও সেই রকম ইচ্ছা। কিন্তু রুবানা এখন কি করবে! সে তো মেঝভাই এর বন্ধু পলাশ ভাই কে ভালোবাসে।পলাশ ও তাকে ভালোবাসে।রুবা অনার্সে ভর্তি হল ইংরেজি তে। বড়দা আগেই স্কলারশিপ পেয়ে ইউরোপে চলে গেছে। যাবার সময় ক্লাসমেট নোরা আপুকে বিয়ে করে নিয়ে গেছে।

ইতোমধ্যে মামা স্ট্রোক করে মারা গেছেন। এখন মেজদাও উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে যাবে।তাই মামি জানতে চাইলেন রুবানার কাছে তার ইচ্ছার কথা!সে তাঁর কাছে সময় চেয়ে নিল।

কি বলবে সে মামিকে, কিভাবে সে না করবে তার মাতৃসম মামিকে।পলাশের কথা কিভাবে বলবে সে!

চিন্তায় চিন্তায় তার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। চোখের তলায় কালি পড়েছে।এভাবে ক’দিন কাটার পর মামি আসলেন তার ঘরে। হাতে একটা খাম নিয়ে।মামিকে আসতে দেখে সে শোয়া থেকে উঠে বসলো।

মামি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,”কি হাল করেছিস চেহারার? ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছিস না কি হয়েছে তোর বলবিনা আমাকে?”

মামির স্নেহার্দ্র কথা শুনে সে চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলো না। মামিকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চললো। ও যতক্ষণ কান্নাকাটি করছিলো ততক্ষণ তিনি তাকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন। একসময় কান্না থামলে মামি তার সাথে আনা খাম টি তার কাছে দিয়ে বল্লেন, “আমি তোকে বড়ো ই করলাম রে, মা হতে পারলাম না। “
সে তখন জিজ্ঞাসু চোখে তার দিকে তাকালে তিনি আবারও বল্লেন, এতে একটা চিঠি আছে পলাশ দিয়েছে। তোদের সম্পর্কের কথা জানিয়ে।পরের ছেলে আমাকে জানালো আর তুই আমাকে জানাতে পারলিনা?”

“আমি তো দেখি ব্যার্থ! মামি ই রয়ে গেলাম মা হতে পারিনি।”

ঘটনার আকস্মিকতায় রুবানা বাকরুদ্ধ হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করতে লাগলো।

মামি বলে চলেছেন, তোর মা হলে তুই তাকে না জানিয়ে থাকতে পারতিস?”

“যাক চিন্তা করিস না আমি সব ম্যানেজ করে নেব।আমার একমাত্র মেয়ে অসুখী হবে মা হয়ে আমি কি করে সহ্য করবো।”

“তুই চুপচাপ থাক।আমি সব ব্যাবস্থা করছি।”

এই বলে মামি চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন।

রুবানা চিঠি হাতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইল।

ফাতেমা_হোসেন
৬/১২/২১

About

Fatema Hossain

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}