সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাসায় ফিরলাম।বাসায় ফিরতেই ইস্ত্রি উৎসুক হয়ে জানতে চায়,’কি গো বেতন পাইছো?

‘না’।

‘আজ দুই মাস হয়ে যাচ্ছে এখনো বেতন দিচ্ছে না?

তাহলে কিভাবে চলব। তোমরা কিছু বলতে পারো না?

কি বলবো, আমরাতো অফিস স্টাফ। আমরা চাইলেই ওয়ার্কার এর মত আচরন করতে পারিনা। স্টাফ বলে কি তোমাদের বউ বাচ্চা নেই? তারাকে না খেয়ে মরবে? স্ত্রীর এমন প্রশ্নের জবাবে কোনো প্রতি উত্তর নেই আমার কাছে।

মাস তিনেক আগে একটা এনজিও থেকে কিছু ঋণ নিয়েছিলাম। সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধের পর সপ্তাহ শেষে তেমন কিছু থাকে না। তাই মাস মাংস তেমন একটা কিনতে পারছি না।এমন কি মাস শেষেও না। মহামারির কারণে গত দু’ বছর ধরে খুব টানাপোড়েন চলছে। জিনিসপত্রের দামও লাগামহীন হওয়ায় অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেছে। মাস মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। ছেলের খেলনা কেনাও বাদ দিয়েছি। আর কোন দিক দিয়ে খরচ কমাবো বুঝতে পারছি না। এদিকে ধারকর্জ ও ঋণের জায়গাও বন্ধ হয়ে গেছে। আর সামলাতে পারছি না এ সংসার।’ এই বলে ঢুকড়ে ঢুকড়ে কাঁদতে থাকে।

আমি মিছেই সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করি।

জানো আজ কি হয়েছে, পাশের রুমের আম্বিয়ার মা গরুর মাংস রান্না করছে। তোমার ছেলে বায়না ধরেছে মাংস দিয়ে ভাত খাবে। কতবার বললাম,বাবা বেতন পেলে মাংস আনবে ছেলেটা শুনল না। ছেলে আমার না খেয়েই ঘুমিয়ে গেল।’ কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। মাসের বেতন যদি মাসেই দিত তাহলে কোন সমস্যাই ছিল না।’

পরের দিন সকালে নিত্যদিনের মত অফিসের উদ্দ্যেশ্যে রওনা হব। ছেলের কপালে চুমু খেয়ে আদর করে বললাম,বাবা বেতন পেলেই মাংস আনবে। ছেলে গলাটা জড়িয়ে ধরে বলল,বাবা বাবা, ও বাবা দেখনা আমার পকেটে কত টাকা। এই বলে ওর কচি হাতটা হ্যাফ প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে কিছু কাগজ বের করে বলল,বাবা আমার অংকের বইতে অনেক টাকার ছবি দেওয়া আছেনা? সে গুলো দেখে দেখে এঁকেছি। এই টাকা গুলো দিয়ে মাংস হবে না বাবা? এই মূহুর্তে কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শুধু চোখটা ঝাঁপছা হয়ে আসল। তারপর অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

একটা গ্রুপ অব কোম্পানিতে চাকরি করি। অফিসিয়াল কাজের পাশাপাশি আমাকে এমডি স্যারের ব্যক্তিগত ফুটফরমায়েশ খাটতে হয়। এমডি স্যারের সাথে একটি শাখা অফিস পরিদর্শনে যাচ্ছি। মহাখালি উড়াল সেতু পার হয়েই পড়ে গেলাম জ্যামে। মহা বিরক্ত দেখাচ্ছিল স্যারকে। এমন সময় দেখলাম এক অশীতিপর এক বৃদ্ধ,বয়সের ভারে ন্যুব্জ,চামড়া হাড়ের হাড়ের সঙ্গে সেঁটে আছে। লাঠিতে ভর দিয়ে ঠুক ঠুক করে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের গাড়ি সামনে এলো। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে স্বীয় অভাবের কথা প্রকাশ করে বলল,’স্যার আইজ ক’দিন হলে বউ পোলাপাইন লইয়া না খাইয়া আছি। দুইডা ট্যাকা দেবেন ভাত খাইতাম?’

স্যার মহা বিরক্ত হয়ে বললেন,’আহ্ ছুঁয়ে দেবে নাকি?’

না না সাব ছুঁমু ক্যান,ছুঁমু না। এবার স্যার পাঁচটা টাকা বৃদ্ধ লোকটার দিকে ছুঁড়ে মারলেন। বৃদ্ধ লোকটা তা কুঁড়িয়ে নিয়ে চলে গেলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর স্যারের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল।

ওপাশ থেকে,’ হ্যালো পাপা,মিন্টু না সকাল থেকে না খেয়ে আছে।’

স্যার সবিস্ময়ে বললেন,’ কি মিন্টু না খেয়ে আছে! বেলা বাজে বারোটা এখনো মিন্টু না খেয়ে আছে? তুই কোন চিন্তা করিস না মা, আমি এখনই মিন্টুর জন্য গোস্ত,ডিম, গলদা চিংড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ এরপর ড্রাইভারকে সুপার সোপ মিনাবাজারে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। স্যারকে খুব অস্থির দেখাচ্ছিল। এরপর মিনাবাজার থেকে সাত-আট কিলো টাটকা গোস্ত,ডিম,গলদা চিংড়ি কিনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললে,’ এ গুলো আমার বাসায় পৌঁছে দাও মিন্টু না খেয়ে আছে।’ বাধ্য হয়ে আমাকে স্যারের বাসায় যেতে হলো। বনানীতে আলিশান একটা বাড়ি। কয়েকটা গেটে জবাদিহি করে তবেই না পেলাম প্রবেশের ছাড় পত্র।

দরজায় নক করতেই ষোড়শী এক মেয়ে দরজা খুলে দিল। মেয়ে তো নয় যেন ইন্দ্রের অপ্সরী। মেয়েটির যুক্ত ভ্রুযুগোল যে কাউকে পাগল করে দিবে। এমন সৌন্দর্য যে তার রূপের বর্ণনার জন্য তার ভ্রুই যথেষ্ট। মেয়েটির কোলে ধবধবে বিলেতি কুকুর। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার দিকে এমনভাবে চেয়ে আছে ,যেন পারলে আমার ঘাড় মটকে দেয়। এবার মেয়েটিকে বললাম, স্যার এই বাজার গুলো পাঠিয়েছেন। আপনার ভাই বোধ হয় সকাল থেকে না খেয়ে আছে।

এবার মেয়েটি হাসতে লাগল। সে সে কি মধুর হাসি!!এমন বিরলপ্রজ হাসি আমি এ জগতে আর দেখিনি।
‘হাসছেন যে?’

‘হাসছি? কারণ আমার তো কোন ভাই-ই নেই।’

‘তাহলে মিন্টু কে?’

‘ও তো আমার এই কুকুরের নাম।

ওই তো সকাল থেকে না খেয়ে আছে। জানেন তো পাপা প্রাণী মেলা থেকে দু লক্ষ টাকা দিয়ে কিনে দিয়েছেন। এবার আমার অবাক হওয়ার সীমা রইল না। অফিসের এতো জরুরী কাজ ফেলে শুধু…..।

কেন যেন চোখটা লোনা জলে ভরে উঠল। কান্নাটা গলায় আটকে আসল।

আলাউদ্দিন লাভলু
কথা সাহিত্যিক।

About

Alauddin Lovelu

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}