February 24, 2022

নাকি অন্য কিছু?

by Alam M in STORY0 Comments

১৯৮৩ সাল। সবেমাত্র এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। থাকি সরকারী কোয়ার্টার মিরপুর ১৪ তে ২০ নম্বর বিল্ডিং এ। সুলতানারা থাকে আমাদের পেছনেই ১৭ নম্বর বিল্ডিং এ। মনের অজান্তেই ১৭ সংখ্যাটা আমার প্রিয় হয়ে গেছে। এই বিল্ডিং এর চার ধারে কতো যে চক্কোর কেটেছি! এই ১৭ নিয়ে অন্য কোনো একদিন বলবো। আজ বলি অন্য কথা।

একটি টিউশনির অফার পেলাম। পড়াতে হবে ১৭ নম্বর বিল্ডিং এর একটা বাসায়। যদিও সুলতানাদের বাসা অন্য সিড়িতে। তবুও ১৭ বলে কথা।

বিকেল বেলা। পড়াতে গেলাম। বারান্দায় ডাইনিং টেবিলেই পড়াতে শুরু করলাম। দুটো ছেলে – একজন ক্লাস সিক্সে আরেকজন এইটে। অংক পড়াতে হবে।

পড়াতে পড়াতে হঠাত টেবিলের ওপর একটা বইয়ের দিকে আমার নজর যায়। বইটা হাতে নেই। ছাত্রদের পড়াতে পড়াতে বইটার পাতা উল্টাতে থাকি। কিরোর লেখা হস্তরেখার বই – হাতের রেখা কথা বলে।

ঘন্টাখানেক পড়ানো শেষ করে বিদেয় দেবার সময় খালাম্মা’কে বললাম – বইটা আমি নেবো। উনি দিতে রাজি হলেন তবে একটা শর্তে। আগামীকাল পড়াতে আসার সময় বইটা ফেরত দিতে হবে আর আমি যেনো তার হাত দেখে দেই। আমি রাজি হয়ে গেলাম।

বইটা বেশি মোটা ছিলো না। রাতের মধ্যেই পুরোটা পড়ে শেষ করলাম।

পরের দিন পড়াতে গেলাম। বইটা সাথে নিয়ে গেলাম ফেরত দিতে। টেবিলে বসে অপেক্ষা করছি ছাত্রদের জন্য। কিন্তু খালাম্মাই চেয়ার টেনে নিয়ে আমার সামনে বসলেন। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন – দেখে দাও। আমি ধারনাও করিনি সত্যি সত্যি আমার হাত দেখে দিতে হবে। আমি লজ্জায় বারবার বলতে থাকলাম, এতো অল্প সময়ে আমি তেমন কিছু পড়ে বুঝতে পারিনি। তাকে বললাম, বইটা আজও নিয়ে যাবো। আরো ভালোভাবে পড়ে দেখবো। তারপর চেষ্টা করবো আপনার হাত দেখে দেবার।

উনি নাছোড় বান্দার মতো বললেন, – হাত দেখে দিতেই হবে। কোথায় পালাই বুঝতে পারছিলাম না। অগত্যা হাত দেখতে লাগলাম।

ঝরঝর করে বলে যেতে লাগলাম। উনি হা করে আমার দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন। কয়েক মিনিট বলার পর থাকলাম। দেখি উনার বিস্ময় যেনো কাটছেই না। অবশেষে বললেন, তুমি এক রাতের মধ্যে বইটা পড়ে এতোকিছু বললে কিভাবে। তুমি তো সব মিলিয়ে দিয়েছো। কিভাবে সম্ভব করলে।

…সেদিন বেশিক্ষন আর পড়ানো হলো না। ফিরে আসার সময় খালাম্মা আমাকে ডেকে বইটা আবার আমাকে দিয়ে বললেন, বইটা নিয়ে যাও। এটা তোমাকে দিলাম।

বইটার একেবারে মালিক বলে যাওয়ায় আমার খুশি আর দেখে কে। আমি নতুন উদ্যমে বইটা আবার পড়া শুরু করলাম। বই পড়ি – নিজের হাত দেখি আর মিলাই।

আমি আর এক বন্ধু মিলে বাংলাবাজারে যাই। পুরোনো বইয়ের ভিড়ে হস্তরেখার বই খুঁজি। পেয়েও গেলাম অনেকগুলো বই। কিনে নিলাম সব। পুরোনো বই তাই বেশি টাকা গুনতে হয়নি।
বই পড়ি আর হাত দেখে বেড়াই। যখন কথা মিলিয়ে দিতে পারি তখন মনে হয় এইতো শিখে গেছি হাত দেখা, হাতের রেখা দেখে ভাগ্য বলে দেয়া।

ছাত্রদের পড়ানো শেষে খালাম্মার হাত আমাকে প্রতিদিনই দেখতে হতো এক কাপ চা খেতে খেতে। আমি তার অতীত বলে যাই একের পর এক – উনি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন। ফিরে আসবার সময় প্রতিদিন একটাই কথা বলেন, তুমি এসব কথা বলো কিভাবে। আমি মাথা নীচু করে বলি, জানিনা।


ইতোমধ্যে রেজাল্ট বের হলো। পাশ করলাম। কলেজে ভর্তি হলাম। টিউশনিটা ছেড়ে দিলাম। খালাম্মার হাত দেখার সমাপ্তি ঘটলো। তবে সুযোগ পেলেই কারো না কারো হাত আমি দেখেই চলেছি। এ এক অন্যরকমের নেশা। মানুষের অতীত বলে দেবার নেশা, ভাগ্য বলে দেবার নেশা।


একসময় কলেজ পাশ করলাম। ভর্তি হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথম বর্ষে থাকতেই আমার ভারতে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছিলো। এটাই আমার এজীবনের একমাত্র বিদেশ ভ্রমন ছিলো মাত্র সাত দিনের জন্য। ফিরে আসার আগে আমি কোলকাতার বইয়ে দোকানে হস্তরেখার বই খুঁজতে থাকি। পেয়েও যাই অনেক বই। এবার পেয়ে যাই আরেক গুহার সন্ধান। সম্মোহন, হিপনোটিজম এর বই। বাংলা ইংরেজি দু’ধরনের বইই পেলাম। সেগুলোও কিনলাম। দেশে ফিরে এলাম একগাদা বই নিয়ে।

সেই খালাম্মার সাথে পরে আর কখনো দেখা বা কথা হয়নি। আমিও যাইনি দেখা করতে। এগিয়ে গেছি সামনে। জীবনের পর্বগুলো এভাবেই সব রয়ে যায় পেছনে। আজও মাঝে মাঝে নিজের মনেই শুধু প্রশ্ন জাগে, – সেদিন কি সত্যি সত্যিই খালাম্মার হাতের রেখা কথা বলেছিলো, নাকি অন্য কিছু?

এবার দেশে ফিরে ভাগ্য বলে দেবার পাশাপাশি শুরু করি সম্মোহন চর্চা। আত্ম-সম্মোহন এবং দুর-সম্মোহন।

ইন্ডিয়া থেকে আনা হস্তরেখার বইয়ের পাশাপাশি হিপনোটিজমের বই নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা শিখতে হবে। কয়েকদিনেই সব কটা বই পড়া শেষ। এবার অনুশীলনের পালা।

খুব ভোরে উঠে ঘরের অল্প আলোতে সাদা দেয়ালে একটা ছোট্ট কালো গোল চিহ্ন দিয়ে স্থির হয়ে বসে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা শুরু করে দিলাম। এক মিনিট যেতে না যেতেই চোখ আর খুলে রাখতে পারিনা। পলক পড়েই যায়। ঝরঝর করে চোখে পানি চলে আসে।
যে কোনোভাবেই চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকতেই হবে। প্রথমদিন বিফল হলাম। মনে হলো এটা একটা অসম্ভব কাজ।

এভাবে করে প্রতিদিন ভোরে অনুশীলন চালিয়ে যেতে থাকলাম। ব্যর্থতা আমার পিছু ছাড়ে না। আধা মিনিট চোখের পলক না ফেলে এক দৃষ্টিতে কোনো স্পটের দিকে তাকিয়ে থাকাও যেনো অসম্ভব বলে মনে হতে লাগলো। সারাদিন কোনো কিছুতেই মন বসে না। ইচ্ছেমতো যেদিকে সেদিকে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করি।

চেষ্টা আসলেই মানুষকে সফলতা এনে দেয়। ধীরে ধীরে আমার এক দৃষ্টে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকার সময়সীমা বাড়তে থাকলো। দুই মিনিট, পাঁচ মিনিট, পনের মিনিট, ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত চোখের পলক না ফেলে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকার সফলতা পেলাম। নিজেকে কমান্ড দিতাম যে আমার অনেক ক্ষমতা। আমি চাইলেই অনেক কিছু করতে পারি, ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজেকে সত্যিই ক্ষমতাবান মনে হতো। মনে করতে পারতাম আমি অনেক কিছু করে ফেলতে পারবো। সে এক অন্য রকম অনুভুতি।

এবার অন্যরকম অনুশীলনে মন দিলাম – Far hypnosis অর্থাৎ দূর সম্মোহন। যখন কারো সাথে কথা বলতাম তখন তার চোখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে কথা বলতাম আর মনে মনে তাকে নিয়ন্ত্রনের কমান্ড দিতাম। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং লাগেনি কেননা বুঝতে পারতাম না সামনের মানুষটা সত্যিই আমার নিয়ন্ত্রনে কিনা। আরো এক ধরনের দূর নিয়ন্ত্রনের প্রাকটিস করা শুরু করলাম। আমার সামনে হেটে যাওয়া কোনো মানুষকে মনে মনে ডাক দিয়ে বলতাম, এই পেছনে ফিরে তাকাও।

কাউকেই নিয়ন্ত্রন করতে পারছিলাম না। মনে মনে ডাকলেও কেউ পেছন ফিরে তাকাচ্ছিলো না। আমি আমার অধ্যাবশায় চালিয়ে যেতেই থাকলাম। অবশেষে আমি আমার বিশ্বাসের ভিত্তিপ্রস্তর করেই ফেললাম।

জানিয়ে রাখছি, আমার ২০ বছর বয়েসেই বিয়ে করতে হয়েছিলো। পারিবারিক ভাবেই বিয়ে। বিয়ের গল্প পর্ব অন্য কোনোদিন সময় হলে বলবো। মাত্র ১৬ বছরের ছোট্ট বউ আমার। একদিন দেখি আমার বউটা আক্কেল দাঁতের ব্যথায় অস্থির হয়ে গেছে। সে তার চোয়ালে হালকা স্পর্শ পর্যন্ত করতে দিচ্ছে না। এতোটা ব্যথা! তখন আমার মনে হলো দেখিতো আজ আমার বউটাকে নিয়ন্ত্রনে নিতে পারি কিনা। যেই ভাবনা সেই কাজ। আমার বউকে বললাম, আমি তোমাকে যা যা বলবো তুমি শুধু তা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনবে। তাহলে আমি তোমার ব্যাথা সারিয়ে দিতে পারবো। অল্প বয়েসি বউ আমার কথায় বিশ্বাস করলো। আমি ওকে সোফার ওপর শুতে বললাম। ও শুয়ে পরলো। চোখ বন্ধ করতে বললাম। ও চোখ বন্ধ করলো।

আমি আমার ভেতরের সমস্ত শক্তিকে একসাথ করার প্রচন্ড ইচ্ছেশক্তির প্রয়োগ করলাম। নিজেকে বিশ্বাস করাতে লাগলাম যে আমিই পারবো। মুখে শব্দ করে বলতে থাকলাম –

এই যে দেখো তোমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। তোমার কিছুই হয়নি। তোমার অনেক ভালো লাগছে। সুন্দর হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। এই যে দেখো তোমার দাঁতে এখন কোনোই ব্যাথা নেই। আছে কি? ব্যথা নেই তো! তোমার এখন অনেক ঘুম পাচ্ছে। তুমি এখনি ঘুমোবে। তোমার দাঁতে কোনোই ব্যথা নেই। তোমার এখন শুধু ঘুম আর ঘুম…

দুই মিনিটের মধ্যেই দেখি বউ আমার গভীর ঘুম। কোনো নড়াচড়া নেই। আমি ইচ্ছে করেই ওর চোয়ালে হাত দিয়ে চাপ দেই। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এরপর ডাকাডাকি শুরু করি। দেখি ঘুম আর ভাঙ্গে না। আমি ঘাবড়ে যাই। মনে মনে ভাবতে থাকলাম, আমি কি ওকে জাগাতে পারবো না! মগ ভরে পানি নিয়ে মুখে পানির ছিটা দিয়ে জোরে জোরে ডাকতে থাকলাম। অবশেষে ঘুম ভাঙ্গে। জানতে চাইলাম, দেখোতো তোমার দাঁতে এখন ব্যাথা আছে কিনা? সে বলে কোনো ব্যথাই নেই।
এবার আমার নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। আমার মনে হতে থাকে, আমি ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারি। আমার অনুশীলন আরো বাড়িয়ে দিলাম। আমি যাকে তাকে পেছন থেকে মনে মনে ডাকা শুরু করলাম, – পেছনে থাকাও। একসময় দেখলাম, যাকেই তাকাতে বলি সেই পেছন ফিরে তাকিয়ে কি যেনো ভাবে আবার আপন মনে চলে যায়।

ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। আমি যার তার ওপর হিপনোটিজম প্রয়োগ করতে থাকি। এ যেনো এক ভয়ঙ্কর খেলা…

আমার এ ভয়ঙ্কর অসুস্থ্যতা থেকে আমার নিজেকে নিজেই বের করতে হয়েছিলো। এবার নিজেকে উল্টো সম্মোহনের পালা, – আমার কোনোই ক্ষমতা নেই; আমি একজন অতি সাধারন মানুষ; আমি একজন অতি নগণ্য মানুষ; আমি একজন অতি সাধারন মানুষ; আমার কোনোই ক্ষমতা নেই…

আমার কোনোই ক্ষমতা নেই…

About

Alam M

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}