দিন গড়াতে লাগলো। দেখতে দেখতে আজ আমাদের বিয়ের তিন মাস পূর্ণ হলো। এই তিন মাসে আরহান আমাকে পৃথিবীর সমস্ত সুখের সাথে পরিচয় করিয়েছেন। মনের মণিকোঠায় প্রিয় মানুষটির জন্য যেই জায়গাটি থাকে, তা দখল করে নিয়েছেন। সেদিন বলেছিলেন না? ‘ছোট বড় সব সুখের দায়িত্ব নিলাম।’ সত্যি, উনি দায়িত্ব নিয়েছেন। বাবা-মার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো ভীষণ। কিন্তু তারা আমার সাথে কথা বলতে চান না। এই তিনমাসে অনেকের জীবনের অনেক কিছু পাল্টে গিয়েছে।

এ বাড়িতে আসার প্রথম এক সপ্তাহ, মাহী ছিলো আমাদের সাথে। খুব মিশে গিয়েছিলাম। এতো মিশুক একটা মেয়ে! না মিশে পারা যায়! সপ্তাহ বাদে, ওর মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। অগত্যা দুই বোনকে চলে যেতে হয়।

রুশী আর অয়নকে অনেক মনে পড়েছে। যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু দুজনেরই ফোন অফ পেয়েছি। তাও আবার বার বার!

তৃষ্ণার ঝামেলার জন্য ভার্সিটিতে যেতে পারিনি। দু সপ্তাহ বাদে এক্সাম শুরু আমার। তখন গেলেই দেখা হবে।

এরমধ্যে তৃষ্ণা অনেক ভাবে আমাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছে, কিন্তু আরহানের জন্য পারেনি। শুধু তৃষ্ণা না, দেখা গিয়েছে তৃষ্ণা বাদে অন্য আরও একজন আমার ক্ষতি করতে চেয়েছে। আরো একজন আমার ক্ষতির জন্য লোক লাগিয়েছে। কিন্তু আরহান তাকে এখনও ধরতে পারেনি। তাই আমার জন্য বাড়িতে এক্সট্রা সিকিউরিটির ব্যবস্থা করেছে।

ইদানিং নিশাকে দেখি মন মরা হয়ে থাকতে। রুদ্র খুব একটা এ বাড়িতে আসে না। তবে যখন আসে, দুজন দুজনকে লুকিয়ে যেভাবে দেখে, সেটা আমার চক্ষু এড়ায়নি। সবটা না হলেও, কিছুটা আন্দাজ করে নিয়েছি। আর দিনকে দিন নিশার এই মন মরা ভাবটা বেড়েই চলেছে। এই ব্যাপারে আজ আরহানকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি।

রুমে বসে নিজের ডায়েরিতে এসব লিখছিলাম। বিয়ের প্রথম মাসে আরহান আমাকে এই ডায়েরি গিফট করেছেন। ভীষণ সুন্দর এই ডায়েরিতে প্রতিদিনের সব ঘটনা লিখে রেখে দেই। আরহানের ব্যাপারে মনের মাঝে যেসব কথা খেলে বেড়ায়, সেসব তো মুখে আনতে পারিনা। তাই এই ডায়েরিতেই লিখে রাখি।

লেখা শেষ করতে না করতেই আমার ফোন বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে স্ক্রিনে নামটি দেখতেই ঠোঁটের কোণে হাসি এসে পড়লো। কেনো এলো? সম্পূর্ন অজানা আমার। তবে এটা প্রায়শই হয়।

রিসিভ করতেই আরহান বলে উঠলেন, “যদি বলি আজ শুকতারাকে নিয়ে তার ব্যক্তিগত চাঁদ ঘুরতে বেরোবে, তবে কি শুকতারা রাজি হবে?”

আরহানের এমন মিষ্টি ভাবে বলা কথায় আমি হেসে দিলাম। কে বলবে, এতো গম্ভীর একটা মানুষ তার প্রিয়তমার কাছে এতটা মিষ্টি হতে পারে! পরক্ষণেই আরহানের কথা মাথায় ঘুরলো, কি বললেন উনি? ঘুরতে নিয়ে যাবেন? চোখ দুটো বড় বড় হয়ে এলো। এই তিন মাসে উনি আমাকে বাড়ি থেকে বেরোতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছেন। উনি! নিয়ে যাবেন!

“ঘ’ঘুরতে ন’নিয়ে যাবেন?”

অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম। আরহান হাসলেন। শব্দবিহীন হাসি। তবে আমি অনুভব করে নিলাম।

“এক্ষুনি রেডি হয়ে নিন তো। আমি ফিরছি। আর শুনুন! পার্পেল কালারে কিন্তু আপনাকে দারুন লাগে।”

কথাটা শেষ করেই কল কেটে দিলেন। আরহান মাঝে সাঝেই ‘আপনি’ করে বলেন আমাকে। এটা দারুন শোনায় আমার কাছে। এতে দূরত্ব বা অভিমান নেই, আছে প্রিয়মানুষটির প্রতি অগাধ ভালোবাসা। যাই হোক, ভীষণ খুশি লাগছে আমার।

খুশি মনে রেডি হয়ে নিলাম। পার্পেল কালারের একটা শাড়ি পড়লাম। আমি সবসময় চুল বিনুনী গেঁথে রাখতাম। আজ ইচ্ছে হচ্ছে খুলে রাখতে। তাই করলাম। হাঁটু লম্বা চুলগুলো মুক্ত রেখে দিলাম। কানে ঝুমকো। এক হাতে কাঁচের চুড়ি আর কপালে ছোট্ট একটা টিপ। ব্যাস! রেডি আমি।

কিছুক্ষণ বাদেই আরহানের কল এলো আবার। রিসিভ করতেই বলে উঠলেন,“রেডি তুমি?”

“হুঁ”

“গুড! জলদি নিচে এসো, আমি অপেক্ষা করছি।”

কল কেটে দিলেন আরহান। নিচে আছেন? এতো জলদি চলে এলেন! আমি তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেরোলাম। যাবার আগে নিজেকে আরও একবার আয়নায় দেখে নিলাম।

বেরোনোর সময় ড্রইং রুমে মায়ের সাথে দেখা হলো। মা মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলেন,“কই যাচ্ছিস মা! আরহান কোথাও যেতে না করে দিয়েছে তো।”

গাল দুটো রক্তিম হয়ে এসেছে। কিভাবে বলবো,‘আমি আপনার ছেলের সাথেই ঘুরতে বেরোচ্ছি!’। কেমন যেনো লাগছে আমার। এ মা! লজ্জা পাচ্ছি আমি!

নিজেকে ধাতস্থ করে মাথা নিচু করে মিনমিনে কন্ঠে বললাম,“উনি বাইরে অপেক্ষা করছেন। আসলে, উনিই নিয়ে যাবেন।”

মা মুচকি হেসে যেতে বললেন। আমিও বেরোলাম।

বাড়ি থেকে বেরিয়েই দেখি, গেটের বাইরে উনার গাড়ি। দ্রুত পা চালিয়ে গাড়ির কাছে গেলাম। আরহান ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন। ফোন কানে, কারো সাথে কথা বলছেন। আমি ডোর খুলে বসে পড়লাম আরহানের পাশে। ডোর খোলার সাউন্ড পেয়ে এদিকে তাকাতেই আরহানের স্থির দৃষ্টি থমকে যায় আমার পানে। ফোনের ওপাশের ব্যক্তি কথা বলেই যাচ্ছে, সেদিকে খেয়াল নেই উনার। আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। মাথা নিচু করে মৃদু হাসলাম।

আরহান ওপাশের ব্যক্তিকে “আ’ল কল ইউ লেটার” বলেই কল কেটে দিলেন। পুনরায় মুগ্ধ নজরে আমাকে দেখতে লাগলেন।

“সময়টা এখানেই থমকে যাক। আমার দৃষ্টি স্থির থাকুক আমার প্রিয়মানুষটির উপর। যাকে দেখার সাধ এজনমে মিটবে না।”

আরহানের এরূপ কথায়, সত্যি যেনো আমার দুনিয়া থমকে গেলো। মানুষটা এতো আবেগী কথা কি করে বলে!

হালকা করে কেশে উনার মনোযোগ আকর্ষণের ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। উনি তো গভীর নজরে উনার শুকতারাকে দেখে যাচ্ছেন।

“সারাদিন কি এখানেই কাটানোর মতলব এঁটেছেন? যাবেন না?”

এবার আরহান নড়ে চড়ে বসলেন। বিরক্তির একটা শ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বললেন,“শান্তিতে একটু দেখতেও দেয় না!”

আমি হেসে দিলাম। আরহান গাড়ি স্টার্ট দিলেন।

নিজস্ব গতিতে চলমান গাড়ি, পেছনের সব রাস্তা ফেলে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলছে। প্রকৃতির প্রতিটি ঘটনা আমাদের কিছু না কিছু শেখায়। যেমন এটা আমাদের বোঝাচ্ছে, ‘অতীত শুধুই পেছনে ফেলে রাখার জিনিস। তবে ফেলে রাখা অতীতকে স্মৃতির পাতায় তুলে রেখে মাঝে মাঝে সেগুলো দেখতে হবে, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ভুল গুলো সূক্ষ্ম নজরে অবলোকন করতে হবে। চলমান রাস্তায় সেগুলো শুধরিয়ে নিতে হবে। যেগুলো শুধরাতে পারবে না, সেগুলোর জন্য রয়েছে এক অন্তরীক্ষ দীর্ঘশ্বাস। তবে অতীতকে আকড়ে ধরলে কখনোই গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে না।’

কিছুদূর এগোতেই আরহানকে জিজ্ঞেস করলাম,“আচ্ছা আমরা কোথায় যাচ্ছি?

“গেলেই বুঝবে।”

আমি আর এই নিয়ে প্রশ্ন করলাম না। যেহেতু উনি বলেছেন, গেলেই বুঝবো। তবে তাই হোক।

তখনই নিশার কথা মাথায় এলো। আরহানকে জানাতে হবে।

“শুনছেন!”

আরহান সামনে তাকিয়েই উত্তর দিলেন,“হুঁ!”

“কিছু বলতে চাই।”

“বলো..”

“কিছুদিন যাবত লক্ষ্য করছি নিশা কেমন যেনো মন মরা হয়ে থাকে।”

আরহানের মাঝে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম না। সেভাবেই বললো, “হ্যাঁ! তাই কি হয়েছে?”

“আচ্ছা আপনি বোনের ব্যাপারে এতোটা উদাসীন কেনো বলুন তো! কিছু বলছি তো আমি আপনাকে?”

আরহান হালকা হাসলেন। যেনো সব জানেন উনি। ঠোঁটে হাসির রেখা এঁকেই বললেন,“আচ্ছা! আমার বউয়ের দেখি রাগ ও আছে! সেইযে বিয়ের পরেরদিন রেগেছিলে। এরপর আজ। ভাল্লাগলো। এভাবে রাগতে পারো। শরীর ভালো থাকে।”

আসলেই, আমি এই তিনমাসে আর উনার সাথে রেগে কথা বলিনি। রাগ আসেইনি। তবে আজ উনার মুখে ‘বউ’ কথাটি শুনে কেমন যেনো একটা ফিলিংস এলো। আচ্ছা হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো কেনো? হৃদপিন্ড অসুস্থ হয়ে গেলো বুঝি!

কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলাম। বললাম,“আপনি কি আমার কথা শুনবেন না?”

“হু, হু, শুনবো। বউয়ের কথা না শুনে উপায় আছে? বলতে থাকো।”

আবারো একটু রাগ হলো। এভাবে বলার কি আছে? ইদানিং আমার রাগটাও বেড়ে যাচ্ছে। হয়তো রাগ ভাঙ্গানোর গ্যারান্টি আছে বলেই এই রাগের উৎপত্তি। নয়তো, ছোট মা বা আপুর উপরও কখনো রাগ আসেনি।

“আমার মনে হচ্ছে, নিশা আর রুদ্র ভাইয়া একে অপরকে পছন্দ করে।”

আরহান এবারও স্বাভাবিক। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না বলে, কপাল কুঁচকে এলো। জিজ্ঞেস করলাম,“এতো বড় একটা কথার প্রেক্ষিতে আপনার কি কিছুই বলার নেই?”

“নাহ্! কারণ আমি জানি এটা।”

অবাক, বিস্মিত আমি চোখ বড় বড় করে ফেলেছি মুহূর্তেই। জানেন মানে?

আর কোনো কথা হলো না। আরহান সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। আর আমি নিঃসংকচে উনাকে দেখে যাচ্ছি। আমার ব্যক্তিগত চাঁদকে দেখে যাচ্ছি আমি। নিস্তব্ধতার মাঝেই আরহান একটা গান ছেড়ে দিলো।

ওরে ইচ্ছে করে বুকের ভিতর, লুকিয়ে রাখি তারে।

যেনো না পারে সে যেতে, আমায় কোনদিনও ছেড়ে।

আমি এই জগতে তারে ছাড়া, থাকবো নারে থাকবো না।

তারে এক জনমে ভালোবেসে, ভরবে না মন ভরবে না।

আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি

ওরে এই না ভুবন ছাড়তে হবে, দুইদিন আগে পরে।

বিধি একই সঙ্গে রেখো মোদের,একই মাটির ঘরে।

আমি এই না ঘরে থাকতে একা,পারবো নারে পারবো না।

তারে এক জনমে ভালোবেসে,ভরবে না মন ভরবে না।

আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি,এই চোখ দুটো মাটি খেয়ো না।

আমি মরে গেলেও তারে দেখার সাধ, মিটবে না গো মিটবে না।

তারে এক জনমে ভালোবেসে,ভরবে না মন ভরবে না।

আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি….

গানটা গিয়ে সোজা বুকের বা পাশটায় আঘাত হানলো। কি আছে এতে? ভালোবাসা! নিশ্বাসের বেগ বেড়ে চলেছে। হৃদপিন্ড! এ তো ভীষণ অসুস্থ হয়ে গিয়েছে।

এরই মাঝে আরহান হুট করেই গাড়ি থামিয়ে দিলেন। সিটবেল্ট খুলে তড়িৎ বেগে আমার কাছে এসে পড়লেন। আমার সিটের দুই পাশে হাত রাখলেন। দূরত্ব আরো খানিকটা ঘুচিয়ে বললেন,“গান শুনে আমাকেই ফিল করছিলে? এখন কাছে এলাম। নাও ফিল মি!”

চলবে…

About

নবনিতা শেখ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}