এক্সাম শেষ হয়েছে আজ বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো। মনটা এই দিন গুলোতে প্রায়শই খারাপ যেতো। চেনা মানুষজনের এমন হুট করে পরিবর্তন যে কারো বুকে ঝড় তুলতে সক্ষম। খুব খারাপ একটা অনুভূতি আমাকে অনেক বাজে ভাবে গ্রাস করছে। যাদেরকে নিজের ভেবে এসেছিলাম, দুজনের কেউ আমার কাছে নেই এখন। একজন নিরুদ্দেশ তো অন্যজন আমার মুখ অবধি দেখতে নারাজ।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। হয়তো ভার্সিটি লাইফ শেষ হবার আগেই বন্ধু বিচ্ছেদের স্বাদ নেওয়াটা আমার ভাগ্যেই ছিল।
কিছুক্ষণ ওই দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎ ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম এক হাসির রেখার দেখা মিললো। এটা অবশ্যই আরহান এর জন্যই।
আরহান বলেছিলেন না, ‘ভালোবাসি’ না বলেই ভালোবাসার উপলব্ধি করাবেন! হ্যাঁ! ভালোবাসার সহস্র রং চিনিয়েছেন। উনি যখন হাসেন, ইচ্ছে করে পুরো দুনিয়া ভুলে শুধু এই একটি মানুষের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকি। আরহান আমাকে নিজ ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেওয়া শিখিয়েছেন। সব ভুলে আমি উনার দিকেই তাকিয়ে থাকি। এ দেখার মধ্যে আলাদা এক শান্তি আছে। ভালো লাগা আছে।
আরহান আমার সাথে রেগে কথা বলেননি কখনো। রাগ দেখাননি।
ইদানিং আমার কি যেন হয়েছে, রাতে ঘুম আসে না। নির্ঘুম আমি সারাটা রাত ভরে আরহানকে দেখতে থাকি। আরহানের কাছাকাছি এলেই আমার হৃদস্পন্দনগুলো বেড়ে যায়। অন্যরকম কিছু একটা অনুভূত হয়। নাম না জানা একটা টান কাজ করে। আরহানের সামান্য প্রশংসাতেই লজ্জায় আমার মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। আরহানকে খানিকক্ষণ না দেখলেই আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাঁসফাঁস করে। দুদিন ধরে শহরের বাইরে আছেন আরহান। আমি আরহানকে দেখতে পাইনি এই দুদিন। তবে যেনো মনে হচ্ছে, কতো জনম উনাকে দেখে চক্ষু তৃষ্ণা মেটাতে পারছি না।
“উহুম উহুম! ভাবি বুঝি ভাইয়ার বিরহে আকাশের তারা গুনছে?”
হালকা কেশে নিশা এই কথাটা বলে উঠলো। এতোক্ষণে খেয়াল করলাম, আমার পাশেই নিশা দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক কতক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তা জানা নেই আমার। খানিকটা অপ্রস্তুতভাবে হেসে বললাম, “এমা! তুমি! কখন এলে?”
নিশা হালকা হেসে বললো,“যখন তুমি তারা গুনতে ব্যস্ত ছিলে।”
লজ্জা লাগছে ভীষন। মেয়েটা কি না কি ভাবলো!
“ভাবি শোনো না!”
“হুঁ! বলো।”
“শাড়ি পরিয়ে দেবে? আমি না! শাড়ি পরতে জানিনা।”
তীক্ষ্ণ নজরে তাকালাম নিশার পানে। হঠাৎ মাথায় শাড়ি পরার ভূত কোত্থেকে উদয় হলো এর? আমার এরূপ চাহনি দেখে নিশা মেকি হেসে বললো,“এভাবে তাকাও কেনো ভাবি? ভয় লাগে।”
নিশার ছেলেমানুষী কথা বার্তায় আমিও হেসে ফেললাম।
___________________________
“মা! এসব কি?”
হাতের ডায়েরিটা দীপ্তি ওর মায়ের দিকে এগিয়ে এই কথাটা বললো। ওর মা একবার ডায়েরির দিকে তাকালো। এরপর আবার দীপ্তির দিকে।
গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো,“তোকে এই শিক্ষা দিইনি আমি। কাউকে না বলে তার জিনিস ধরাটা তোকে শেখাইনি।”
“দেখো মা! মানছি আমি এটা দেখে অন্যায় করেছি। সেজন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু এখন তোমাকে এর উত্তর দিতে হবে। বলো তুমি। এটা কি?”
দীপ্তির মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আজ আর কি করে লুকোবে? সত্য যে সবটা সামনেই আছে। মৃদু কন্ঠে বললো, “যা জেনেছিস, সবটাই সত্যি।”
“এসব লুকিয়ে এসেছো কেনো মা? কাউকে বলোনি কেনো?”
“দুনিয়া অনেক কঠিন। আর দুনিয়ার মানুষ নিষ্ঠুর, পাষাণ। এরা তোর ক্ষততে নুন আর সুখে নজর খুব ভালো করে লাগাতে জানে। কখনো দুর্বলতা প্রকাশ করতে নেই। এরা তোকে ভেঙ্গে চূরে শেষ করে দেবে। আবার তোর আনন্দময় জীবনও এদের সামনে প্রকাশ করবি না। এদের হিংসে হয়। মারাত্মক হিংসে। অতি সহজেই তোর সুখময় জীবনকে ক্ষণস্থায়ী করে দেবে। এদের জন্য শুধু থাকবে কৃত্রিম হাসি। যেটা তোর ঢাল হয়ে দাঁড়াবে। এজন্যই মূলত কিছু জিনিষ অপ্রকাশিত থাকাই শ্রেয়।”
“তাই বলে তুমি আমাকে বলোনি কেনো মা?”
দীপ্তির প্রশ্নে তার মা মৃদু হেসে বললো,“কী হতো বলে? পুরনো ঘা তাজা বৈ আর কী’ই বা হতো? যা পেছনে ফেলে এসেছি, তা পেছনেই থাক না! কেনো সেগুলো মনে করে কষ্ট পাবো?”
মায়ের কথায় দীপ্তি দমে গেলো। পুনরায় একটা কথা মস্তিষ্কে আসতেই বলে ফেললো,“মা! আপু কোথায়?”
“ওর মামার কাছেই রেখে এসেছিলাম। আমার ভাই ওর খেয়াল রাখায় কোনো রকমের অপূর্ণতা রাখবে না।”
__________________________
শাড়ি পরিহিত নিশা নিচে নামতেই ড্রইং রুমে রুদ্রকে বসে থাকতে দেখে মাথা নিচু করে হাসলো। নিশা জানতো রুদ্র আসবে, এজন্যই শাড়ি পরেছে। লজ্জা মাখা মুখশ্রী নিয়ে নিশা এগিয়ে গেলো রুদ্রের দিকে।
সামনে কারো উপস্থিতির আভাস পেয়ে রুদ্র চোখ তুলে তাকালো। একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলো। সেদিনের কথা ভীষণভাবে মনে পড়লো রুদ্রের। নিশাকে পাবার যেই এক চিলতে আশার আলো দেখেছিলো, তা নিমিষেই অন্ধকার হয়ে গেলো। নিশা যে অন্য কাউকে ভালোবাসে!
কোনো কথা না বলেই, ফোন কানে নিয়ে উঠে চলে গেলো। এমন ভাব ধরলো যেনো এখানে রুদ্র ব্যতীত অন্য কেউ ছিলো না।
হাস্যোজ্জ্বল নিশার মুখ নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। চোখ দুটো ছলছল করছে নিশার। এখানে আর একপলক না থেকে দৌঁড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। যার জন্য শাড়ি পরলো, সে যে ফিরেও তাকালো না।
রাতের খাবার খেতে নিশা যখন নিচের নামলো তখন ওর ফোলা মুখশ্রী দেখেই বুঝে ফেললাম ও কেঁদেছে। কিন্তু কেনো, তা বুঝতে পারলাম না।
নিশা এসে আমার পাশের চেয়ার টেনে বসলো। ধীরকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,“কি হয়েছে? চোখ মুখ ফোলা কেনো?”
অপ্রস্তুত নিশা বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললো,“আসলে ভাবি, অবেলায় ঘুমিয়েছিলাম তো! এজন্য।”
নিশার কথা বিশ্বাসযোগ্য ছিলো না। তবুও আর পাল্টা প্রশ্ন করলাম না।
আরহানের কথা খুব মনে পড়ছে। খাবার না খেয়ে বার বার নেড়ে যাচ্ছি। খাচ্ছি কম, আরহানকে ভাবছি বেশি। আমাকে এভাবে দেখে মা বললেন, “কিরে মা! খাচ্ছিস না কেনো? কোনো সমস্যা?”
বেশ গভীর ভাবনায় থাকার দরুন এভাবে ডাকায় চকিতে তাকালাম। মেকি হাসি দিয়ে বললাম,“না মা। তেমন কিছু না। খাচ্ছি।”
“কি খাচ্ছিস দেখাই যাচ্ছে। নে, এদিকে আয়।”
পাশের চেয়ারের দিকে ইশারা করে মা এই কথাটি আমাকে বললেন। এগিয়ে গিয়ে সেদিকে বসলাম। মা হালকা হেসে, খাবার মেখে আমার মুখের সামনে তুলে ধরে বললেন,“আমি যদি খাইয়ে দিতে চাই, তবে কি আমার মেয়েটা খাবে?”
আমি হাসলাম। আরহান একদম উনার মায়ের মতো হয়েছে। এভাবে কথা বলা তো আরহান উনার মায়ের কাছেই শিখেছে।
পাশ থেকে নিশাও ওর মন খারাপের রেশ সব পাশে রেখে বলে উঠলো,“আজ কেউ নেই বলে, নিজ হাতে খেতে হয়।”
আমি আর মা নিশার এমন অভিমান মিশ্রিত কথায় হেসে ফেললাম। মা হাসিমুখে বললেন,“তুইও এদিকে আয়।”
নিশাও এলো। এভাবেই মায়ের হাতে খেয়ে যাচ্ছি। না পাওয়া ইচ্ছেগুলো এভাবেই পূরণ হচ্ছে। মানুষের কোনো ইচ্ছে কখনো অপূর্ণ থাকে না। হয়তো তা আজ পূর্ণতা পাবে, কিংবা শতাব্দী বাদে। হয়তো সেটা বাস্তবে পাবে, কিংবা কল্পনায়। হয়তো সেটা নিজেকে ঘিরে পাবে, কিংবা সামনের মানুষটির মধ্যে নিজেকে দেখে।
______________________
আজ আবারও এই রুমটাতে একা থাকতে হবে। উনার স্মেল আছে, তবে মানুষটাই যে এই রুমে নেই। একটা শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলাম বেডের পাশে। সন্ধ্যায় নিশাকে শাড়ি পরিয়ে দেওয়ার দরুন রুমটা অগোছালো হয়ে আছে। গোছাতে গোছাতেই আমার ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের দিকে তাকাতেই ঠোঁটে হাসি চলে এলো।
এগিয়ে গিয়ে রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে আরহান বললেন,“মিস ইউ শুকতারা…”
একটা বাক্য! হ্যাঁ! এই একটা বাক্য কারো হৃদপিন্ডের স্পন্দন গতি বাড়াতে সক্ষম। কাতর কণ্ঠস্বর আরহানের। এভাবে কেউ বলে?
আমাকে চুপ থাকতে দেখে পুনরায় আরহান বললেন,“আচ্ছা সেসব বাদ দাও। খেয়েছো?”
“হুঁ, আপনি?”
“হ্যাঁ। কি করছিলে এখন?”
“এইতো কিছুনা।”
“ঘুমোবে না? রাত হয়েছে তো অনেক।”
আরহানকে এবার কি করে বলবো? উনি না থাকলে শান্তিতে দুচোখ এক করতে পারিনা। তবুও বললাম,“হুঁ, ঘুমোবো।”
“আমার ফিরতে আরো দুদিন লাগবে।”
রেগে গেলাম আমি আরহানের এই একটি কথায়। উনার তো কাল ফেরার কথা ছিলো। আরো দুদিন মানে?
ধারালো কন্ঠে বললাম,“সেখানেই থেকে যান। আরো তিনটে বিয়ে করে নিন না! আসতে হবে না আপনার।”
আরহান হাসলেন। শব্দ করেই হাসলেন। আমি তীব্র রাগে কল কেটে দিলাম। একেতো রাগিয়ে দিলেন, তার উপর হাসছেন!
কিছুক্ষণ বাদে আরহানের নম্বর থেকে কল এলো। কেটে দিলাম আমি। আবারো এলো। এবারও কেটে দিলাম। তৃতীয় বারের মাথায় কল এলে রিসিভ করে কানে তুলতেই, ওপাশ থেকে আরহান বললেন,“রাগ করবে, রাগ ভাঙ্গাবো। বকবে তুমি? চুপচাপ বকা খাবো। তবুও দূরে যাবার কথা চিন্তা করবে না। এখন আমি কাছে নেই তোমার, চাইলেও নিজের কাছে বেঁধে রাখতে অক্ষম আমি। তাই কল কাটার কথা ভুলেও ভাববে না। বাড়ি ফিরলে না হয় মেরো, আটকাবো না।”
পুরো কথাটা গম্ভীর ভাবে বললেও শেষ উক্তিটি হেসেই বলেছেন।
“আচ্ছা এবার ঘুমাও।”
“হুঁ, আপনিও।”
চলবে…