সকালে ফোনের কলিং টিউনে ঘুম ভেংগে যায় আমার। ফোন হাতে নিয়ে দেখি আননৌন নাম্বার থেকে একটা কল এসছে। এতো সকালে আমাকে কে কল দেবে?

কৌতুহল নিয়ে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ ভেসে এলো, “স’সরি বীনু। রিয়েলি ভেরি সরি।”

কান্না ভেজা কণ্ঠস্বরটা চিনতে আমার বিন্দু মাত্র সমস্যা হয়নি। এটা রুশী। মনের মাঝে অনেকগুলো প্রশ্ন চলে এলো। সেদিনের ব্যবহার, রাগ, কথা না বলা এসব কি ছিলো?

আমার কিছু বলার আগেই রুশী কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করলো,“আমাকে মাফ করে দে বীনু। তিন মাস আগে আমার লাইফ পুরোটা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গিয়েছে রে। আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।”

সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এই খবরটা শুনে মুহূর্তেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম আমি। কি বলছে রুশী এটা! বিয়ে? তবে অয়ন কোথায় আছে? অয়ন না ওকে ভালোবাসতো! রুশীও তো অয়নকে ভালোবাসে।

“কি হয়েছে, খুলে বল।”

রুশী একে একে সব কথা খুলে বললো। অয়নকে ছেড়ে চলে আসা, মারুফকে বিয়ে করা পর্যন্ত সবটা বললো। আমি নিশ্চুপ থেকে রুশীর কথা শুনলাম। নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে এসবের জন্য। কেনো সেদিন ওর পাশে ছিলাম না আমি?

আমার নিস্তব্ধতার মাঝেই রুশী বলে উঠলো,, আ’ আমি প্রেগন্যান্ট বীনু।”

অবাক হলাম না। বিয়ে হয়েছে, প্রেগন্যান্ট হওয়াটা স্বাভাবিক। অবাক হলে বরং ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগতো। খুব করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,‘সেদিন বলেছিলাম, দেরি হয়ে যাবে। শুনলি না আমার কথা।’ কিন্তু এটা বলা যাবে না এখন। মেয়েটা অনেক বাজে একটা পরিস্থিতির মধ্যে আছে।

তাই বললাম,“বিয়ে তো হয়ে গিয়েছে তোর, তার উপর তুই মা হতে চলেছিস। যদি ব্যাপারটা শুধু বিয়ে অবদিই থাকতো, তবে আমি যে করেই হোক, তোকে ডিভোর্স দিইয়ে অয়নের কাছে দিয়ে আসতাম। কিন্তু, তোর বাচ্চা! ও তো কোনো দোষ করেনি তাইনা? দেখ, আমি জোর করছি না। জাস্ট বলছি তোকে। পারলে নিজেকে এই সংসারেই গুছিয়ে নে। আর কারো জন্য না হলেও, তোর সন্তানের জন্য নতুন একটা জীবন শুরু কর।”

তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা হলো রুশীর সাথে। অয়নের এভাবে হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো আমার কাছে।

এখন, একসাথে কাটানো সেই দিনগুলোর কথা মনে হচ্ছে খুব। অয়ন যখন ক্যাম্পাসের পেছনের ঐ বকুল ফুল গাছতলায় বসে গান গাইতো, তখন রুশী কেমন মুগ্ধ নজরে দেখে যেতো! আর অয়নের অব্যক্ত সকল কথার ভীড়ে একটা এটাও ছিলো,“রুশী! আমার সব গান তোকে ডেডিকেট করে গাই আমি।”

আচ্ছা! সবাই তো সত্যিকারের ভালোবাসতে পারেনা। তবে যারা পারে, তাদের ভালোবাসা কেনো পূর্ণতা পায় না? অয়ন, রুশীকে কতটা ভালোবাসতো তা আমি জানি। আমি এ ও জানি, রুশী ওকে কতোটা ভালোবাসতো। ওদের একসাথে কাটানো প্রতিটি স্মৃতির সাক্ষী আমি নিজেই। ভাগ্য এরকম নিষ্ঠুরতা না দেখালেও পারতো।

________________________

নিজ বাড়িতে চিন্তিত তৃষ্ণা একাকী বসে রয়েছে তৃষ্ণা। তার নয়নতারাকে এখনও খুঁজে চলছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার আরহানের বাড়িতেও খোঁজ করেছে। কিন্তু টাইট সিকিউরিটির দরুন পারেনি। এখন তৃষ্ণার আরো বেশি সন্দেহ হচ্ছে ঐ বাড়ি নিয়ে। হয়তো সেখানেই আছে তার নয়নতারা।

ভালো লাগছে না তৃষ্ণার কিছু। এতো অপূর্ণতা নিয়ে একটা মানুষ কিভাবে বেঁচে থাকতে পারে?

কিছুক্ষণ বাদে তৃষ্ণার নম্বরে তার একটা লোকের কল এলো। রিসিভ করতেই বললো,“বস! আপনি ঠিকই ধরেছেন। ম্যাম ওখানেই আছে। কিন্তু…”

“কি?”

“ঐ বাড়িতে যাওয়া অসম্ভব।”

তৃষ্ণা কিছু একটা ভাবলো। তৃষ্ণাকে চুপ থাকতে দেখে, ফোনের ওপাশের ব্যক্তি বলে উঠলো,“এবার কি করবো স্যার?”

“অনেক কিছুই করবো। আমরা যেতে পারবো না, তবে কাউকে বাড়ি থেকে বের করা অতোটাও কঠিন হবে না।”

কথাটা বলে বাঁকা হাসলো তৃষ্ণা। খুব জলদি তার নয়নতারাকে পেয়ে যাবে।

কল কেটে দিয়ে বললো,“আপনাকে আমি শুধু পছন্দ করি না, শুধু মায়ায় জড়াইনি। ভালোবেসেছি আপনাকে। অন্যরকম ভালোবেসেছি। যেই ভালোবাসায়, আমি দৃষ্টিহীন হয়ে গেলেও, চোখের ক্যানভাসে আপনি থাকবেন। আমার হৃদ স্পন্দন বন্ধ হয়ে গেলেও, হৃদযন্ত্রে আপনারই বসত থাকবে। যেই ভালোবাসায়, এই তৃষ্ণা নিঃস্ব হয়ে গেলেও, তার একমাত্র সম্বলে, তার কল্পনায় আপনার অস্তিত্ব প্রতি ক্ষণে অনুভূত হবে। আমি আপনাকে সেই রকম ভালোবাসি নয়নতারা।”

তৃষ্ণা থেমে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ রইলো। মন থেকে যা চেয়েছে তৃষ্ণা, তা কি আদৌ পেয়েছে? হঠাৎ অস্থির হয়ে গেলো। কাতর কণ্ঠস্বরে শুধালো,“আপনাকে পাবো তো? আমি নিজের পছন্দের সবকিছু ছিনিয়ে নিতে জানি। বাই হুক অর বাই ক্রুক। কিন্তু…. আমি আপনাকে নিয়ে কোনো গেইম খেলতে পারবো না।”

_________________

গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে আমি নিজ রুমে বসে আছি। ভাবনাটা অবশ্যই আরহানকে ঘিরেই। অবশেষে উনার দুদিন পূর্ণ হলো। আজ আসবেন। আমি অভিমান নিয়েই উনার অপেক্ষায় বসে আছি। এতো অভিমান কখনো কারো প্রতি আসেনি আমার।

ফোনে আচমকা মেসেজের শব্দ একটু ঘাবড়ে গেলাম। হাতে নিয়ে দেখি আরহানের মেসেজ,“কি করো?”

আমি লিখে দিলাম,“কিছু না।”

ওপাশ থেকে আবারও মেসেজ এলো,“মন খারাপ?”

“জানিনা..”

“রাগ করেছো?”

“না…”

“অভিমান?”

“হুঁ”

আরহান খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আবারও মেসেজ পাঠালেন,“তবে তো হয়েই গেলো।”

ভ্রু কুচকে ফেললাম। কী হলো আবার? জিজ্ঞেস করলাম,“কী?”

“ভালোবাসা….”

“কিভাবে?”

“ভালো না বাসলে অভিমান আসে না।”

মেসেজটা দেখার সাথে সাথেই আমার হৃদস্পন্দন পরপর কয়েকটা মিস করে আবারও অস্বাভাবিক হারে বাড়তে লাগলো। কেমন যেনো লাগছে আমার! আমি গভীর ভাবনায় পড়ে গেলাম। সত্যি কি তাই? আরহানের শেষ মেসেজের আর কোনো প্রতিউত্তর করলাম না। ফোন রেখে দিলাম। ব্যালকনিতে গিয়ে এই গোধূলি বেলাটা উপভোগ করতে চাচ্ছি। কিন্তু আরহানের শেষ কথাটায় আর এদিকে মন দিতে পারছি না। আমি কি সত্যি উনাকে ভালো বেসে ফেলেছি?

অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না বিধায়,নিশার রুমে চলে এলাম।

ডোর নক করতেই নিশা খুলে দিলো। মিষ্টি হেসে বললো,“আরে ভাবি তুমি! আমি মাত্রই তোমার কাছে যাচ্ছিলাম। ভালো হলো এসেছো। ভেতরে এসো।”

আমি এগিয়ে গিয়ে বসলাম। হঠাৎ মনে হলো, আজ নিশার সাথে সরাসরি এই বিষয়ে কথা বলা প্রয়োজন।

নিশা আমার পাশে বসতেই জিজ্ঞেস করলাম,“ভালোবাসার মানে কী তোমার কাছে নিশা?”

আমার হুট করে এভাবে করা প্রশ্নে নিশা খানিকটা বিস্মিত হলো।

“হঠাৎ এটা জিজ্ঞেস করছো যে!”

“আহা! বলো না!”

“আচ্ছা। বলছি।”

“হুঁ”

“প্রথম দেখায় যদি কাউকে দেখে জানার আগ্রহ জন্মায়, এরপর তার সম্পর্কে এ টু জেড জেনে যখন বিশ্বাস-অবিশ্বাস নামক শব্দগুলো চলে আসে, ধীরে ধীরে তার প্রতি মায়া কাজ করা শুরু করে, তাকে নিজের কাছাকাছি দেখলে শান্তি অনুভূত হয়ে, অন্য কারো পাশে দেখলে বুকে যন্ত্রণা হয়, সারাজীবন নিজের করে না পেলেও চোখের সামনে দেখার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়, তবে এই অনুভূতি গুলোর নামই হচ্ছে ভালোবাসা।”

ভালোবাসা! তাই কি! নিশা এখন ভালোবাসার গভীর খেয়ালে ডুবে আছে। হয়তো ভাবছে তার ভালোবাসার মানুষটির ভালোবাসা নিয়েই। জিজ্ঞেস করে বসলাম,“কাউকে ভালোবেসেছো?”

বেখেয়ালি নিশা ভুলে বলে ফেলে, “হ্যাঁ। ভীষণ ভালো বেসেছি।”

পরক্ষণেই নিশার খেয়ালে এলো, ও কি বলেছে। তাই সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্ত করলো,“ইয়ে মানে না।”

আমি হাসলাম। নিশার চিবুকে হাত রেখে বললাম,“রুদ্র ভাইয়াকে কতটা ভালোবাসো?”

নিশা চমকালো। মুখশ্রীতেই ওর চমকের রেশ ফুটে উঠেছে। আমি আবারও মুচকি হাসলাম।

নিশা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,“তাকে ভালোবাসতে বাসতে দুনিয়া থমকে যাবে, তবুও তৃষ্ণা মিটবে না।”

________________________

অস্থির হয়ে নিজের রুমে পায়চারি করছি। আরহানকে কল দিচ্ছি, রিসিভ করছেন না। একটু আগেই আমার নম্বরে মেসেজ এলো,“আরহানকে বাঁচাতে চাইলে ***ঠিকানায় চলে আসুন।”

জাস্ট এই একটা মেসেজ। এই একটা মেসেজে আমার শ্বাস আটকে ফেলতে সক্ষম। অনেকক্ষণ ধরে আরহানের নম্বরে ট্রাই করেই যাচ্ছি।

পুনরায় সেই নম্বর থেকে আবারও মেসেজ এলো,“আরহানকে মেরে দেবো?”

সাথে সাথে রিপ্লাই করলাম,“নাহ্! আসছি আমি।”

আবারো মেসেজ এলো,“একা আসবেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাঁচ মিনিট দূরত্বে আমার গাড়ি আছে, ওটাতে চলে আসবেন। আর খবরদার, কাউকে জানালে কিন্তু আরহান যাবে…..”

মাথায় আর কোনো কিছু না এনে এভাবেই বেরিয়ে পড়লাম। এতোটা অস্থির কখনো লাগেনি আমার।

বেরোনোর সময় মা, নিশা দুজনেই নিজের রুমে থাকায় আমাকে কেউ দেখেনি। তবে বিপত্তি বাঁধলো গেইটের কাছে এসে। গার্ড আমাকে বের হতেই দিচ্ছে না। সামনের একজন বললো,“ম্যাম! স্যার আপনাকে বাহিরে যেতে না করেছেন। আপনার কিছু প্রয়োজন হলে, আমাদের বলুন।”

এদের কিভাবে বলি! যেতে হবে আমার। আমার আরহান বিপদে আছে

আরহানের যদি কিছু হয়ে যায়! কম্পিত কন্ঠে বললাম,“আ’আমাকে যেতে দিন। আরহান ন’নিজেই যেতে বলেছে।”

তাও আমাকে যেতে দিচ্ছে না উনারা। প্রচুর বিরক্তি নিয়ে উনাদের চাকরির হুমকি দিয়ে বের হলাম। বের হতে অবশ্য অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে। কিন্তু এখন আমার মূল লক্ষ্য আরহান।

অতিরিক্ত টেনশনে থাকায় আমার মাথায় পেইন শুরু হয়ে গিয়েছে। কিছুদূর যেতেই, ফাঁকা রাস্তায় একটা ব্ল্যাক মাইক্রো দেখে এগিয়ে গেলাম। আমি যেতেই দরজা খুলে গেলো। পেছনে একজন বসা আছে, আমাকে ইশারা করলো তার পাশে বসতে। এগিয়ে গিয়ে সেখানে বসে পাশের লোকটিকে অবলোকন করে নিলাম। সম্পূর্ণ কালো পোশাক পরা, মুখ গ্লাস-মাস্ক দিয়ে ঢাকা। আমাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই লোকটি মাস্ক খুললো।

অস্থির আমি, আরহানের চিন্তায় অবস্থা নাজেহাল হয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম,“আরহান কোথায় আছে?”

তখনই আমার ফোন বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখি আরহান কল দিয়েছেন। কপাল কুঁচকে এলো। রিসিভ করতেই পাশের লোকটি ফোন নিয়ে লাউডস্পিকারে দিলো।

আরহানের চিন্তিত কণ্ঠস্বরে শোনা গেলো,“কি হয়েছে? এতো কল দিয়েছো যে? আমি ফোনের কাছে ছিলাম না তখন। তুমি ঠিক আছো তো?”

পাশের লোকটি “এখন থেকে ঠিক থাকবে”—বলে কল কেটে দিয়ে ফোন সুইচ অফ করে দিলো।

আমি বড়বড় চোখ করে এই লোকটির দিকে তাকালাম। হালকা চেনা চেনা ঠেকলো। ততক্ষণে গাড়ি চলা শুরু হয়ে গিয়েছে।

রেগে চিল্লিয়ে বললাম,”কী হচ্ছে এটা?”

লোকটি বাঁকা হেসে বললো,“ধোঁকা…”

চলবে…

About

নবনিতা শেখ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}