নিস্তব্ধ বাড়িতে বাবার অবাক কণ্ঠস্বর শোনা গেলো,“শেফালী!”
মা স্থির দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো। অসহনীয় যন্ত্রণা তার বুকে। প্রাক্তনকে সম্মান করা ভালো কথা। তাকে ভালোবাসা ভালো কথা। কিন্তু তার উপস্থিতিতে যদি নিজেরই সন্তানের প্রতি অবহেলা শুরু করে, তবে সেটা অন্যায়। ঘোর অন্যায়।
মা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। এতো যন্ত্রণা উপেক্ষা করে বললো,“সেদিন আমি যা বুঝেছিলাম, যখন শুনলাম সেটা মিথ্যে ছিলো। এক মুহূর্তের জন্য তখন ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। পরক্ষণেই যখন শুনলাম, তুমি পাল্টে গেছো। বিশ্বাস করো, সেদিনের চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছি। তোমার থেকে এটা আশা করিনি আমি।”
মায়ের কথার প্রেক্ষিতে বাবা চুপ। কিছুক্ষণ আগেই সবটা জেনেছে। রুদ্র বলেছে সবটা। সে যে নিজের মেয়ের প্রতি অন্যায় করে ফেলবে, বুঝতে পারেনি।
দীপ্তি কোনদিকে না খেয়াল করে এগিয়ে গেলো বাবার দিকে। মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,“বাবা!”
বাবা থমকে গেলেন। একবার দীপ্তির দিকে তাকিয়ে পুনরায় মায়ের দিকে তাকালেন। অবুঝ ভঙ্গিতে তাকালেন।
মা গম্ভীর কন্ঠে বললো, “বিয়ে করিনি আমি। তোমারই সন্তান।”
তখন রুদ্র সবটা বললেও, দীপ্তির ব্যাপারটা বলেনি। তাই এখন জানালো,দীপ্তির ঘটনাগুলো। বাবা অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে।
ছোটমাকে বেশ অনেকক্ষণ আগেই পুলিশে নিয়ে গেছে। তখন থেকেই মীরা আপু নিজেকে ঘরবন্দী করে নিয়েছে। ভয় পেয়েছে ভীষণ। ড্রইং রুমে আমি, আরহান, রুদ্র, দীপ্তি, মা ও বাবা দাঁড়িয়ে।
বাবা অপরাধীর মতো মায়ের সামনে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওভাবেই বললো,“আমাকে কি মাফ করা যায়না?”
মায়ের স্পষ্ট উত্তর,“না।”
তৎক্ষণাৎ মা বেরিয়ে গেলো দীপ্তিকে নিয়ে। বাবা আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো। চোখ ছলছল করছে তার। বাবা কখনো আমাদের সামনে কাঁদেনি। অগোচরে কেঁদেছে। আমি অনেকবার লক্ষ্য করেছি মায়ের ফটোফ্রেম সামনে নিয়ে বাবাকে নিজের ঘরে, লুকিয়ে কাঁদতে।
বাবা আমাকে কিছুই বললেন না। হয়তো বলার কোনো মুখ নেই। আলগোছে নিজের রুমে চলে গেলেন। আরহান ও আমাকে নিয়ে বেরোলেন। পিছে পিছে রুদ্রও এলো।
বাড়ির বাহিরে দীপ্তি আর মাকে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। আরহান রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“তুমি উনাদের নিয়ে, উনাদের বাড়িতে যাও। আমরা অন্য গাড়িতে আসছি।”
রুদ্র “জ্বি স্যার” বলেই মা আর দীপ্তিকে বললো,“আপনারা আমার সাথে আসুন।”
_____________
কারো জীবন হুট করেই থমকে যায়, আবার কেউ কেউ জীবনে নিজস্ব গতিতে চলতে থাকে। তবে বাধা বিপত্তিহীন জীবন কখনোই কেউ পায়না। বিগত আঠারো বছরের সত্য যখন আমার কাছে ক্ষণ মাত্র সময় নিয়ে তৈরি করা মিথ্যে কাহিনী প্রমাণিত হলো, আমি থমকে গিয়েছিলাম। এতকাল আমি আমার মাকে দোষী ভেবে এসেছি। তার জন্য ভীষন রাগ পুষে রেখেছিলাম মনে। কিন্তু…
কিন্তু, আজ মায়ের প্রতি কোনো ক্রোধ কিংবা অভিযোগ নেই। আমার বাবার প্রতিও আজ রাগ নেই। একসময় প্রচন্ড রাগ হতো। এখন নেই।
তবে ভাবনার বিষয় হলো, এখন তো আমার সবচেয়ে বেশি রাগ হবার কথা। হচ্ছে না কেনো? তবে কি আমি অতীতের সব ভুলে গেলাম? মা হীনা জীবনের প্রতিটি কষ্ট ভুলে গেলাম?
হয়তো তাই হয়েছে। তারা নিজেরাও তো ছোটমার খেলার গুটি ছিলো। হয়তো অতীতকে ছাড়িয়ে আজ আমার বর্তমান জিতে গেলো। জীবন যুদ্ধে জিতে গেলাম আমিও।
আচ্ছা, বাবা কি খুব কষ্ট পেয়েছেন আজ? যদি জীবনটাকে সেই আঠারো বছর আগের দিনে নিয়ে যেতে পারতাম! যদি সেদিন ছোটমা আর বাবার বিয়েতে মাকে দেখতে পেতাম!
আফসোস করে কী হবে এখন? যা হবার, হয়ে গিয়েছে। এখন আমার উচিত, বাবা মায়ের মধ্যেকার মনোমালিন্য সব দুর করা। আমি করবো এবং পারবোই। আমাকে যে পারতেই হবে।
খারাপ লাগার এসকল অনুভূতি নিয়ে আমি ড্রাইভ করতে থাকা আরহানের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলাম। একটা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছি। আরহান উনার কাঁধে আমার স্পর্শ পেতেই দ্রুত ব্রেক কষলেন। স্থির দৃষ্টিতে আমার পানে চেয়ে রইলেন।
অবুঝ ভঙ্গিতে বললেন,“ঠিক আছো শুকতারা?”
নীরস মুখে উত্তর দিলাম,“হু.. ঠিক আছি। এভাবে থাকলে আপনার ড্রাইভিং এ সমস্যা হবে?”
“না, কিন্তু…”
আরহানকে আর কিছু না বলতে দিয়ে আমি বলে উঠলাম,“তবে থাকি না এভাবে! বড্ড শান্তি পাচ্ছি আমি।”
আরহান বুঝতে পারলেন। হালকা হেসে আমার কপালে ওষ্ঠের উষ্ণ স্পর্শ এঁকে দিলেন। আবেশে আঁখি পল্লব বুজে ফেললাম। আরহান পুনরায় হেসে “থাকো” বলে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। আমি ওভাবেই চোখ বুজে আছি।
সত্যিই তো, আমি এখানেই শান্তি পাই। পরম শান্তি।
______________
ক্লান্ত সন্ধ্যেতে একসঙ্গে সবাই মিলে বসে আছি। আরহান বারবার তাগাদা দিচ্ছেন যাবার জন্য। যেনো কিছু থেকে পালাতে চাচ্ছেন। আমার মাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু আরহান থেকে যেতে পারবেন না, আবার আমাকেও রেখে যেতে পারবেন না।
অবশেষে মাকে বললেন,“আমাদের যাওয়া উচিত এখন।”
মা দ্রুত বললো,“আজ থেকে যাও না। মেয়েকে পেয়েছি, ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না।”
আরহান একটু হেসে বললেন,“আসলে, আমার কাজ আছে আর ওকে এখানে রেখে যেতে পারবো না, ভুল বুঝবেন না আপনি।”
মা উদাস মনে বললো,“আচ্ছা, তবে ডিনারটা আমাদের সাথেই করো। আজ বীনুর জন্য রান্না করবো আমি।”
কথাটি শেষ করেই মা আরহানের উত্তরের অপেক্ষা না করে কিচেনে ছুটলো। আমি কতো ভাগ্যবতী, এমন স্বামী পেয়েছি আমি। এমন মা পেয়েছি আমি।
আবারও আড্ডায় মশগুল হলাম আমি দীপ্তি আর রুদ্র। আরহান ফোনে কিছু একটা করে যাচ্ছেন। তখন কলিং বেল বাজায় দীপ্তি “আমি দেখে আসি” বলে উঠে গেলো।
আমার দৃষ্টি সামনের দিকেই। আমার সামনের সোফায় আরহান বসে আছেন। আর তার পেছনেই দরজা।
দীপ্তি হাসি মুখে দরজা খুলতেই আমি দরজার ওপাশে ব্ল্যাক টি-শার্ট, ব্ল্যাক জিন্স পরিহিত যুবককে দেখে বিস্ময়ে চোখ বড় করে ফেললাম।
সে সোজা যখন এদিকে তাকালো চমকের দরুন স্তম্ভিত হয়ে গেলো। হয়তো চোখের ভুল ভাবছে। বার দুয়েক চোখের পাতা এক করলো। পুনরায় আমাকে সামনে দেখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।
দীপ্তি তৃষ্ণাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,“ভেতরে আয় ভাইয়া। এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”
দীপ্তির কথা শুনে আরহান ফোন থেকে মাথা তুলে পেছনে তাকালেন। কপাল কুঁচকে ফেললেন আরহান।
বিড়বিড় করে বললেন,“এর এখনি আসার সময় হলো?”
তৃষ্ণা একবার দীপ্তির দিকে তাকিয়ে কম্পণরত ঠোঁট দিয়ে উচ্চরণ করলো,“উনি?”
দীপ্তি হাসি মুখে বললো,“আমার আপু।”
তৃষ্ণা অবাক চোখে তাকালো আমার দিকে। এগিয়ে এলো এদিকে। ততক্ষণে আমি ও আরহান দাঁড়িয়ে গিয়েছি।
দীপ্তি হেসে তৃষ্ণাকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। আমাদের সবার মুখেই “হ্যাঁ”, “হুঁ” ছাড়া কিছুই নেই।
কিছুক্ষণ বাদে দীপ্তি তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে “আমি মাকে বলে আসি, তুই এসেছিস” বলে চলে গেলো।
আরহান হালকা হেসে বললেন,“আই হোপ, পার্সোনাল প্রবলেম এখানে আসবে না।”
তৃষ্ণা মৃদু কন্ঠে “হুঁ” বলে সহমত প্রকাশ করলো।
তৃষ্ণা আরহানের পাশের সোফায় বসে পড়লো। একনজর আমাকে দেখে ফোনে মনোযোগী হলো। এই নজরে হয়তো কিছু চাওয়া ছিলো কিংবা ছিলো না পাওয়া।
আরহানও আমার সামনের পুনরায় ফোনে মুখ গুঁজে সোফায় বসলেন। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
মিনিট বাদে মা এলো। এসেই তৃষ্ণার কাছে গিয়ে বললো,“বাবাই, এসেছিস?”
তৃষ্ণা ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো,“হুঁ…”
মা এগিয়ে গিয়ে আমার হাত ধরে তৃষ্ণার সামনে নিয়ে দাঁড় করালো। মুখ ভরা হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে তৃষ্ণাকে বললো,“আমার বীনু।”
তৃষ্ণা মাথা তুলে তাকালো। চোখাচোখি হয়ে গেলো আমাদের। অতঃপর দুজনেই চোখ সরিয়ে নিলাম। তৃষ্ণা মৃদু হাসলো। অনুভূতিহীন হাসি ছিলো এটা।
________________
রাতের খাওয়া শেষে আমাকে নিয়ে দীপ্তি রুমে এলো। এখানে ভালো লাগছে না। কেমন যেনো হাঁসফাঁস লাগছে। হয়তো তৃষ্ণার জন্যেই এমনটা। আমি ভালোবাসা না পাবার যন্ত্রণা বুঝি। আমি ছোটবেলা থেকে পরিবারের ভালোবাসা পাইনি। তাই আমি কখনোই তৃষ্ণার ভালোবাসাকে অসম্মান করতে পারিনা। ইন ফ্যাক্ট করিও না। তবে চোখের সামনে কাউকে এক তরফা ভালোবাসা যন্ত্রণা পেতে দেখলে অস্থির লাগে ভীষণ। যেমনটা এখন লাগছে। সেই যে মায়ের সামনে একবার চোখ তুলে তাকিয়েছিলো, এরপর থেকে আর তাকায়নি। হয়তো মায়া বাড়ানোর প্রচেষ্টা করেনি।
আমাকে গভীর ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে দীপ্তি মিষ্টি হেসে বললো,“উফফ! বীনুপু! তোমাকে যে কী বলবো! কতো হ্যাপি আমি।”
“কেনো, কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে মানে? আমার বোনকে পেয়েছি আমি, হ্যাপি হবো না?”
“ওহ্, আচ্ছা!”
“হুঁ, তার উপর এতো মিষ্টি আর ভালো একটা বোন। আহা!” —বলেই দীপ্তি আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
আমিও মিষ্টি হেসে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। মিনিট দশেক পর দীপ্তি বললো, “ছাদে যাবে?”
আমি একটু ভাবুক ভঙ্গিতে বললাম, “উম… যাওয়া যায়।”
দুজনেই হেসে দিলাম একসাথে। এরপর ছাদের উদ্দেশ্যে এলাম। প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতেই দীপ্তি বললো,“আপু! তুমি যাও, আমি ফোন রেখে এসেছি। নিয়ে আসি।”
“আচ্ছা।”
এরপর একাকী ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। শেষ সিঁড়িতে উঠতেই আমি কারো কথা বলার আওয়াজ পেয়ে গেলাম। সামনে তাকিয়ে দেখি আরহান আর তৃষ্ণা রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি দুজনেরই ঐ দূর আকাশে নিবদ্ধ।
তৃষ্ণা গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“আমার পছন্দের সব কিছুই কেনো তোর হয়?”
“তুই ভুল বলছিস। তোর পছন্দের সব আমার হয়না। আমার সবকিছুই তোর পছন্দ হয়ে যায়।”
তৃষ্ণা বাঁকা হেসে বললো,“তুই ছিনিয়ে নিস।”
আরহানও তৃষ্ণার হাসির প্রেক্ষিতে হেসে বললেন,“তোর ভাগ্যে নেই।”
চলবে…