দেখতেই দেখতে আজ অনেকগুলো মাস পেরিয়ে গেলো। সময় যেনো ছুটছে হাওয়ার বেগে। দিনগুলো কাটছে, নাহ্! দৌড়চ্ছে। আজ ছয় মাস পেরিয়ে গেলো। আর সবচেয়ে মজাদার ব্যাপার হচ্ছে, আর তিনদিন বাদেই আরহান আর আমার বিয়ের প্রথম বছর পূর্ণ হবে।
এইতো সেদিন! সেদিন না আরহান আমাকে জোর করে, ভয় দেখিয়ে বিয়ে করলো! এতো দ্রুত সময় পেরিয়ে যায়! কেউ একজন বলেছিলো, সুখের সময় নাকি হাওয়ার বেগে ফুরোয়। সে আসলেই সত্যিই বলেছিলো।
হুট করেই মন খারাপ ছেয়ে গেলো। আজ বাবা নেই, ছয় মাস হয়ে গেলো। সাথে নেই, রূপ আপু। সে কেনো সুইসাইড করেছে, কেউ জানে না। অনেক চেষ্টার পরেও কোনো কারণের খোঁজ পাওয়া যায়নি। অবশ্য মাহী বলেছিলো, রূপ আপু নাকি অনেক ডিপ্রেসড ছিলো। আসল কারণ হিসেবে এটাও ফাঁস হয়েছে, রূপ আপু আরহানকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। হ্যাঁ! পাগলের মতোই। সে যেমনই ছিলো, তার ভালোবাসা যে খাঁটি ছিলো। তা বুঝতে পারা কারোর জন্যই কষ্টসাধ্য হয়নি।
কথায় আছে, প্রেম মানুষকে যেমনটা শক্তিশালী চরিত্রের অধিকারী বানায়; ঠিক তেমনই, সময় পড়লে ছ্যাঁচড়া হওয়াটাও শিখিয়ে দেয়। অতীব সুন্দর ভাবে।
ছোট মায়ের সাত বছরের জেল হয়েছে। তবে তার অপরাধের শাস্তি আরো কাম্য ছিলো। তার জন্যই বিগত আঠারোটি বছর আমাদের নষ্ট হয়েছে। আমি তাকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না।
এদিকে মীরা আপু মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। সে এতো কিছু সইতে পারেনি। এখন মানসিক হাসপাতালে আছে। সে ঠিক হবে কবে? এই আশায় কেউ বসে নেই। তার যে আসলেই কেউ নেই। তার মামার বাড়ির সবাই আগেই সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। আর তার আসল বাবার বাড়ি থেকে তো চলেই এসেছে। সেখানে কোনো দাম নেই।
কিছুদিন আগে রুশীর একটা মেয়ে সন্তান হয়েছে। নাম রেখেছে অরু। পরিবারের সবার সাথে নিজের মেয়েকে নিয়ে দিন ভালোই কাটছে। আমাকে প্রায়শই ভিডিও কল দেয়। বাড়ি থেকে বিনা প্রয়োজনে বের হবার সুযোগ নেই ওর। এদিকে আমিও যেতে পারবো না। তাই কলেই কথা হচ্ছে।
অয়নের এখনও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। জলজ্যান্ত একটা মানুষ হুট করেই এভাবে গুম হয়ে গেলো, এটা কল্পনাতীত ব্যাপার লাগে আমার কাছে।
এই কয় মাসে আমি তৃষ্ণা সম্পর্কে আমার মা ও শাশুড়ি মায়ের কাছে জেনেছি। শাশুড়ি মা বলেছিলেন,“স্কুল ও কলেজ লাইফে তৃষ্ণা আরহানের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো। একে অপরের কলিজা বলা যেতো। প্রখর মেধাবী ছিলো দুজনেই।
দুজনের ভাবনা চিন্তাও এক ছিলো। কিন্তু তৃষ্ণার একটু ফ্যামিলি প্রবলেম ছিলো। এরপর একদিন কলেজ থেকে বাড়ি গিয়েছিলো। পরেরদিন শুনি, তৃষ্ণার বাবা-মা মারা গিয়েছে। সেদিন ওদের বাড়িতে গিয়ে আর ওকে খুঁজে পাইনি। শুনেছি ওরা, ওখান থেকে চলে গিয়েছে। কোথায় গিয়েছে! তা জানতে পারিনি।”
এরপর আমার মায়ের কাছে শুনেছি সেই ভয়ংকর অতীত। সেদিনের ঘটনা। তৃষ্ণার ঘটনা। এসব শুনে সত্যিই ভীষণ খারাপ লেগেছে। আসলেই, একটা গল্পের,অনেক পর্ব থাকে। প্রতিটি পর্ব, একটার সাথে অন্যটা কানেকটেড। এক পর্ব মিস গেলে, গল্পের মানেটা আমাদের কাছে অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। জীবনটাও কোনো গল্পের চেয়ে কম না।
আমি সব মিলিয়ে তৃষ্ণার জীবনের গল্প জেনেছি। প্রতিটি পর্ব মিলিয়ে জেনেছি। একটা মানুষ কখনোই খারাপ পথে যায়না। সময় ও পরিস্থিতি সবটা করিয়ে দেয়।
ভাবতে ভাবতেই আরহানের নম্বর থেকে কল এলো। এখন বাজে রাত এগারোটা। আরহান কিছু কাজে দেশের বাহিরে গিয়েছেন বেশ কয়েকদিন হলো। মন খারাপ করেছে আমার। তবে সব মানিয়ে নিয়েছি আমি। আরহান আমার কাছে না থেকেও যেনো সারাটা ক্ষণ আমার পাশেই আছে। এইযে বুকের বা পাশে যেই যন্ত্রটা আছে, সেটা আমাকে আরহানের উপস্থিতির আভাস দেয়।
মুচকি হেসে ফোন তুলে কানে নিলাম। আরহান শুরুতেই জিজ্ঞেস করলেন, “খেয়েছো রাতে?”
“হুম। আপনি?”
“এখন এখানে কেবল বিকেল পাঁচটা।”
“ওহ্, হুম। কী করছেন?”
“শুকতারাকে তার চাঁদ গভীর ভাবে মিস করছে।”
“এমা! তাই? তবে চাঁদ আর তারা তো একই আকাশে থাকে। এতো ডিপলি মিস করছে কেনো?”
“হুম। তবে নয়নে নয়নে সাক্ষাৎ হচ্ছে না। সাক্ষাৎকারের সময়টুকুতে যখন শুকতারার অবাধ্য-অগোছালো চুলগুলো মুখের সামনে এসে বিরক্ত করবে, সেটা গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে, চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দেওয়া হচ্ছে না।”
“এটা আপনার ফ্যাভারিট স্টাইল বুঝি?”—ভাবুক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলাম।
“হুম, বলতে পারেন।”
আরহানের কথাটা বলতেই আমি তাকে ডাকলাম,“আচ্ছা শুনছেন!”
“বলো, শুনছি।”
“আসবেন কবে?”
আরহান ওপাশ থেকে হাসলেন। শব্দহীন হাসি। তবে অজ্ঞাত কারণবশত বুঝতে পেলাম, উনি হাসছেন। জিজ্ঞেস করবো? কেনো হাসছেন?
আমার জিজ্ঞেস করার আগেই আরহান বললেন,“মিস করছিলে বুঝি?”
হুট করেই হৃদপিন্ড কেঁপে উঠলো। শূন্যতা অনুভব করলো। সারাদিন দিব্যি চলছিলো আমার। তবে হঠাৎ এমন কেনো?
লজ্জা পেয়েছি। হ্যাঁ লজ্জারই কথা।
তবুও মুখ ফুটে বললাম,“মিস করছি কি না জানিনা, তবে অনুভব করছি। প্রখর ভাবে।”
“প্রিয় মানুষের অনুপস্থিতি, তাকে অনুভব করায় শুকতারা। আমিও করছি। যেমনটা তুমি করছো, তার চেয়েও কয়েক গুন বেশি। তোমার ভাষায় ‘প্রখর ভাবে’। বুঝতে পারছো কি?”
_______________________
ইদানিং শরীরটা বেশ খারাপ যাচ্ছে। দুর্বলতা দিনকে দিন অনেক বাজে ভাবে গ্রাস করছে। আজিব স্মেল ভালো লাগছে। খাবার খেতে ইচ্ছে হয় না। আবার অসময়ে অনেক উল্টা পাল্টা খাবারের বায়না ধরে বসি। আমার এসব বায়না এখন নিশা সামাল দিচ্ছে। গতমাসে পিরিয়ডও মিস গিয়েছে। সব লক্ষণ আমার কাছে একটা জিনিস বোঝাচ্ছে। যদি সত্যি তাই হয়?
ভেবেই আমি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠলাম। আরহান আসবেন কালকে। পাশ হাতড়িয়ে ফোন নিলাম। এখন বাজে সকাল নয়টা। আগে কতো সকালে উঠতাম! আর এখন কী অলস হয়ে গিয়েছি!
দীপ্তির নম্বর ডায়াল করলাম। কল রিসিভ করতেই জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় আছিস?”
সময়ের বিবর্তনে আমাদের সম্পর্ক আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়ে গিয়েছে। এখন ওকে আমি ‘তুই’ সম্বোধন করি, আর দীপ্তিও করে।
দীপ্তি বললো,“এইতো বাড়ি আছি।”
“মা কী করছে?”
“মা অফিসে আছে রে। খেয়েছিস আপু?”
“আর খাওয়া! উঠিইনি। আসবি না?”
এই কয়মাসে, দীপ্তি যেনো বেশির ভাগ সময় এই বাড়িতেই, আমার সাথে কাটিয়েছে। আমি জানতাম বোন মানে তার বেস্ট ফ্রেন্ড। সে ছোট থেকে সাথে থাকে। আমাদের ক্রাইম পার্টনার হয়। সেজন্য আমাদের সব জানে। কিন্তু আমি একটা জিনিস ভুল ভাবতাম। ছোট থেকে একসাথে থাকাটা জরুরি নয়। এটা দীপ্তি বুঝিয়েছে। এই ছয়মাসে আমার সাথে ওর এমন একটা সম্পর্ক হয়েছে, কেউ বুঝতেই পারবে না, আমাদের পরিচয় মাত্র কয়েক মাসের।
দীপ্তি হালকা হেসে বললো,“হ্যাঁ, আসবো তো।”
“কখন আসবি?”
“এইতো, আর দুই ঘণ্টার মতো।”
আমি “আচ্ছা” বলে কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম। এরপর বললাম, “শোন না!”
“হুম। বল।”
“আসার সময় একটা প্রেগন্যান্সি কিট নিয়ে আসিস।”
___________________
নিস্তব্দ, কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে বসে আছি আমি। মুখে কথা নেই। এদিকে সামনে দীপ্তি একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। কেনো এটা আনলাম, কী হয়েছে? ইত্যাদি প্রশ্ন ওর মুখে লেগেই আছে। অথচ আমার বলার কোনো ভাষা নেই।
মস্তিষ্কে অনেক কথারা ভিড় জমাচ্ছে। অথচ শব্দগুলো মুখে আসছে না। সব আওলিয়ে যাচ্ছে। আমার জীবনের মোড় ঘুরেছে।
হাতের প্রেগন্যান্সি কিটটা দীপ্তির দিকে এগিয়ে দিলাম। লাল দাগ দুটো জ্বলজ্বল করছে। হাতে নিয়ে তা দেখতেই দীপ্তি চকিতে চাইলো। আমার চোখ ছলছল করছে। এক ফোঁটা, দুই ফোঁটা করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কম্পণরত হাতটা নিজের পেটের উপর রাখলাম। একবার নিজের পেটের দিকে তাকিয়ে, পুনরায় দীপ্তির দিকে তাকালাম।
“আমি মা হবো? আমিই?”
কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্নটি করে ঠোঁট উল্টিয়ে কেঁদে দিলাম। এ যেনো পরম সুখের এক কান্না।
দীপ্তি স্থির কিছুক্ষণ কিটের দিকে তাকিয়ে হুট করেই মুখ উজ্জ্বল করে ফেললো। খুশিতে নাচতে শুরু করলো আমাকে নিয়ে। তারপর আমাকে ছেড়ে মাকে কল দিলো।
রিসিভ করতেই বললো,“মা! তুমি নানুমা হতে যাচ্ছ।”
ওপাশের মায়ের কথা আর শুনলো না। ফোন রেখেই রুমের বাইরে ছুটলো। ওর চিৎকারে মা-নিশাও ওখানে চলে এলো। আমিও এগিয়ে গেলাম। দীপ্তি উত্তেজিত কন্ঠে বললো,“খালামণি হবো। খালামণি হবো আমি।”
_________________
এখন বাজে রাত এগারোটা চল্লিশ। বাড়ির সবাই আমার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে জানার পর থেকে আমার ব্যাপারে আরো সচেতন হয়ে উঠেছে। রূপ আপুর মৃত্যুতে যেমন বাড়িতে শোক ছেয়ে গিয়েছিলো, জুনিয়রের আগমনের সংবাদে এখন শোকের রেশ মাত্র নেই।
তন্মধ্যে আমি এক ভয়াবহ কাজ করে ফেলেছি। এই বিশাল এক নিউজটা আমি আরহানের কাছ থেকে লুকিয়েছি। কাউকে বলতে নিষেধ করেছি। কাল, যখন আরহান আসবে, তখন আমি নিজেই তাকে বলবো এটা।
আচ্ছা কীভাবে বলবো? বলতে পারবো? উনি সামনে থাকলেই আমি উত্তেজিত হয়ে পড়ি। কথা বলতে পারিনা। কিছুই পারিনা আমি। মূর্তি বনে যাই।
তখন সেখানে নিশা এলো। এই বাড়িতে সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে নেয়। সে হিসেবে নিশাও। আজ হয়তো আমার কাছে থাকবে। দীপ্তি অনেক হৈ হুল্লোড় করে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। এখন বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।
নিশা এগিয়ে এসে ডাকলো,“ভাবি!”
আমি মুচকি হেসে বললাম,“হুম!”
“ছাদে চলো।”
“এখন? এই টাইমে?”
নিশা মেকি হেসে, অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো,“রাতের বাতাস অনেক ভালো। চলো যাই।”
আমি আর কিছু বললাম না। ওর সাথেই ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। শেষ সিঁড়িতে এসে খেয়াল করলাম, নিশা আমার সাথে নেই। বেশ অন্ধকার। এখন নিচে যেতে গেলে, পড়ে যাবো। এজন্য ছাদের দিকে অগ্রসর হলাম।
সম্পূর্ন অন্ধকার ছাদ দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। লাইট জ্বালানো নেই কেনো? কিছুদূর এগোতেই আমার পেছনে কারো অস্তিত্ব পেলাম।
আমি দ্রুত বেগে পিছু ঘুরতে গেলাম। তার আগেই সম্পূর্ণ ছাদ আলোকিত হয়ে গেলো। চারিপাশে দেখে বিস্ময়ে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। পুরো ছাদ ডেকোরেশন করা। এসব কে করলো? কেনো করলো?
সবকিছু ভাবনাতেই হুট করেই কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেলো।
“৩…২….১..”
শেষ হতেই সম্পূর্ণ আকাশ জ্বল জ্বল করে উঠলো। বিস্ময়ে সেদিকেই তাকিয়ে আছি। পেছনের মানুষটি তখন আরো কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো। আমার কাঁধে থুতনী ঠেকিয়ে বললো,“হ্যাপি এনিভার্সারি শুকতারা।”
আমি আরহানের আওয়াজ পেয়ে দ্রুত উনার দিকে ফিরলাম। আমাকে উনার দিকে তাকাতে দেখেই, আরহান মুচকি হেসে বলা শুরু করলো,“আমার জীবনে আসার জন্য ধন্যবাদ। আমার জীবনকে ঠিক এভাবেই আলোকিত করার জন্য ধন্যবাদ। আমাকে ভালোবাসার জন্যেও।”
আমার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,“এই হাত কখনো ছাড়বো না, আই প্রমিজ।”
আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না, কী হচ্ছে! উনার তো কাল আসার কথা! তবে আজ কী করছেন? এতো ভেবেও কিছু পেলাম না। খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলাম।
মুহূর্তেই মাথায় এলো, আরহানকে জানাতে হবে। কীভাবে জানাবো?
পা উঁচু করে দাঁড়ালাম। আরহানের হাতটি আমার পেটে রেখে উনার কানে বললাম,“শুভ বিবাহ বার্ষিকী আমার সন্তানের বাবা।”
তারপর একটু সরে গেলাম। আরহান বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। হয়তো বুঝে নিয়েছেন। আরহানের চোখে চোখ রেখে বললাম,“উই’ল বি প্যারেন্টস। জুনিয়র আসছে।”
চলবে…