ভীষণ চিন্তিত অবস্থায় তৃষ্ণা ব্যালকনিতে ডিভানে গা এলিয়ে বসে আছে। মন ও মস্তিষ্কের সবটা জুড়ে রয়েছে তার নয়নতারা। ড্রিংক করেছে প্রতিবারের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত। তবুও এই নেশা কাবু করতে পারেনি তাকে। মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বুলি আওড়াচ্ছে,“এই এতো বছরের জীবনে প্রথম কোনো নারীকে অন্য চোখে দেখলাম। আআমার কাছে তো নারী মানে ছিলো শরীরের ক্ষুধা। কিন্তু আজ! কারো চোখের মায়ায় আটকে গেলাম। কারো মিষ্টি এক হাসি পাগল করে দিলো আমাকে। নয়নতারা! আপনি কী করলেন এটা? আপনার শরীর নয়, আপনার মন পাওয়ার যে বড্ড তৃষ্ণা জেগেছে আমার। আপনার ভয়, জড়তা, চিন্তা সবটাকেই কেনো এতো মনে ধরলো? আপনাকে একরাতের শয্যাসঙ্গী নয়, সহস্র জনম এই দুনিয়ার বুকে চলতে গিয়ে পাশে রাখতে চাই। আচ্ছা, প্রথম দেখায় ভালোবাসা হয়? হয়না তো! তবে এটাকে কি বলবো? মনের সন্ধি? জীবনে যা চেয়েছি, সবটাই চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস রেখেছি, পাবো। আমি ভাগ্যে বিশ্বাসী নই। তৈরি করে নেওয়াতে বিশ্বাসী। নিজের যা লাগবে, সব নিজের করে নিয়েছি। কিন্তু আজ প্রথম, আপনাকে নিয়ে ভয় হচ্ছে। আপনাকে আমার লাগবে নয়নতারা। আমার একাকী জীবনের একমাত্র সঙ্গী হিসেবে, লাগবেই। পাবো তো?”

সেখানে হুট করেই আগমন ঘটলো আশিকের। তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে বললো,“স্যার! হাতে নতুন কিছু মাইয়া আছে। পাঠামু?”

তৃষ্ণা সোজা বাক্যে “না” করে দিলো। আশিক পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,“মাইয়া গুলো সবডি সুন্দর আছে। বড় ঘরের বেশিরভাগ গুলাই। আপনের লেইগা আইসে।”

তৃষ্ণা দাঁড়িয়ে পড়লো। ক্রুর কণ্ঠে বললো, “তুমি বেশি বলা শুরু করেছো আশিক। যেটুকু বলা হবে, সেটুকু করবে। নাও লিভ!”

শেষ কথাটিতে তেজ ছিলো অনেক বেশি। আশিক সেখান থেকে প্রস্থান করলো। তৃষ্ণা আকাশের পানে তাকিয়ে বললো,“হয়তো আমার জীবনের প্রথম নারীর জায়গা আপনাকে দিতে পারিনি। তবে শেষটা আপনিই।”

_____________________

“নিশা! এতো রাতে চেচামেচি কিসের দেখ তো!”

আরহানের মায়ের এরূপ কথার ভিত্তিতে নিশা নিচে চলে এলো। আসতেই নিশার কপাল কুঁচকে এলো। রূপ! মনে হয় পৃথিবীর একমাত্র মেয়ে এটাই, যাকে দেখলে সবার কপাল কুচকে আসে। অবশ্য বিরক্তিতেই। নিশা স্তব্ধ দাঁড়িয়ে, রূপের এখানে আসার কারণ খুঁজতে লাগলো। ও তো লন্ডনে ছিলো। এখানে হঠাৎ?

নিশাকে দেখে রূপ মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো,“কেমন আছো সুইটহার্ট?”

নিশা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললো,“এইতো ভালো আছি। তুমি কেমন আছো আপু? আর এখানে?”

“আ’ম ফাইন। আর এসেছি দুদিন আগেই। আরহানের সাথে দেখা করেই ফ্রেন্ডের বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। বোঝোই তো! এতবছর বাদে এসেছি।”

নিশা “হুঁ” বলতেই রূপ পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,“আচ্ছা! আরহান কোথায়? রুমে?”

নিশা মৃদু স্বরে “না” বললো।

“তবে কোথায়? রাত অনেক হয়ে আছে। এখন বলো না অফিসে, আমি জানি এই টাইমে ও অফিসে থাকে না।”

আরহানের ঘটনা ভাবতেই নিশার ঠোঁটের কোন ঘেঁষে হাসি ছড়িয়ে পড়লো। বললো,“ভাইয়া আমাদের ফার্মহাউজে আছে। জানো আপু কি হয়েছে আজ?”

“কি?”

“ভাইয়া বিয়ে করে নিয়েছে।”

রূপ চিৎকার দিয়ে উঠলো,“হোয়াট?”

নিশা, রূপের এই চিল্লানোর মানে তৎক্ষণাৎ বুঝে গেলো। যাই হোক, কিছু করার নেই এখন আর। নিশা, রূপকে গেস্ট রুমে নিয়ে গিয়ে বললো,“ফ্রেশ হয়ে নাও। মাকে ডেকে আনছি।”

নিশা চলে গেলো। রূপ বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো। অবাধ্য অশ্রুকণা লুকোতে অক্ষম সে। কি করবে এখন সে? মেয়ে হিসেবে যেমনই হোক, তার ভালোবাসাটা সত্যি ছিলো। অনেকক্ষণ বাদে ফোনে কল এলো রূপের। নামটা দেখে সাথে সাথে ফোন হাতে নিলো। এই মুহূর্তে একেই প্রয়োজন রূপের। মাহী! ছোট বোন হলেও, বেস্ট ফ্রেন্ড ওর। সবকিছুর সলিউশন থাকে এই মেয়েটির কাছে। হয়তো এটার সলিউশন ও আছে।

কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মাহীর আওয়াজ এলো,“দিভাই,কি খবর?”

রূপ কেঁদে দিলো। কান্নার সাউন্ড ওপাশে যেতেই মাহী অস্থির হয়ে পড়লো। অনবরত ভাবে জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে,“কি হয়েছে তোর? দিভাই! বল কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে? আরহান আবারও বাজে ব্যবহার করেছে? বোন আমার, বল না কি হয়েছে?”

রূপ কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বললো,“আমার আরহানকে হারিয়ে ফেলেছি আমি। কেড়ে নিলো আমার আরহানকে।”

মাহী থমকে গেলো। মিনিট খানেক পর নীরবতার অবসান ঘটিয়ে বললো,“ক্লিয়ারলি বল!”

রূপ আবারও কেঁদে দিলো। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,“আরহান বিয়ে করে নিয়েছে। ও অন্য কারো হয়ে গিয়েছে।”

মাহী স্তব্ধ, বিমূঢ়। কিছুক্ষণ পর নিজেকে ধাতস্থ করে শান্ত কন্ঠে বললো,“আরহানকে অন্য কারোর হতে দেওয়ার মতো দয়ালু আমি নই।”

কল কেটে দিলো মাহী। ওপাশে আবারও কাউকে কল দিয়ে বললো,“বিডি ব্যাক করবো।”

____________________

ঘড়িতে এখন দশটা বেজে মিনিটের কাটা পঁচিশের ঘরে ছুঁয়েছে। আমি কাবার্ড এর সামনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি। তখনকার ভাবনায় আসা ঐ কথাটি অনেক বাজে ভাবে পোড়াচ্ছে আমাকে। লোকটি কি আমার উপর জোর খাটাবে? আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নেবে? এতসব ভাবনা জেঁকে বসেছে মাথায়। বিয়ে যেভাবেই হোক, হয়ে গিয়েছে। আমাকে মেনে নিতেই হবে। হাজার হোক, বৈধ অধিকার আছে উনার আমার উপর। কিন্তু, আমি এসবে প্রস্তুত নই। আমার ভাবনা কাটলো আরহানের ওয়াশরুম থেকে বেরোনোর শব্দে। পুরো শরীর কেঁপে উঠলো আমার। কী হবে এখন?

আরহান আমার সমস্ত ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে, বেডের একপাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,“আমি জানি তুমি এসবের জন্য প্রস্তুত নও, জোর করবোনা কখনোই। আর ভয় পেয়োনা। তোমাকে শুধু একনজর দেখার জন্যই রাতে তোমার কাছে যেতাম। খুব বেশি ইচ্ছে হলে, কপালে চুমু খেতাম। এটুকুই।”

আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি। ভাবছি, সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ি। ভাবনা মতো তাই করতে যাবো, তখনই আরহানের আওয়াজ শুনতে পেলাম,“বেড যথেষ্ট বড় আছে। কারো এখানে শুতে ইচ্ছে না হলে, বলতে পারে। আমি গিয়ে সোফায় শুবো। যদিও আমি সোফায় ঘুমোতে পারি না।”

অগত্যা এখানেই শুতে হলো আমায়। কেনো যেনো চাইলাম না, আমার জন্য কারো ঘুম নষ্ট হোক।

চোখে একদমই ঘুম নেই। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক জায়গায়, অপরিচিত কারো সাথে শুয়ে, কি করে ঘুমোবো? চোখ দুটো বন্ধ করে ভাবতে লাগলাম,“নিয়তি কি অদ্ভুত এক জিনিস। মুহূর্তেই পুরো দুনিয়া এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে পারে। এইযে! আমার দুনিয়া পাল্টে গেলো। দুদিন আগেও, এই সময়টা আমি ব্যালকনিতে দাড়িয়ে অশ্রুপাত করতাম বা ছাদে চন্দ্রবিলাস। আচ্ছা বাবা, ছোট মা, আপু ঠিক আছে তো? এই লোকটিকে অতোটা খারাপ লাগছে না। খারাপ হলে, এতোক্ষণে অনেক কিছুই করে ফেলতে পারতো। উফ! মাথা কাজ করছে না আমার।”

গভীর রাতে ঘুমন্ত আমি উষ্ণতা পেলাম। একটা চেনা স্মেল পেলাম। এই স্মেলটা কিভাবে চেনা? মনে পড়ছে না। তবে খুব পছন্দের। আরো গুটিয়ে গেলাম সেদিকে। স্মেলটা অনুসরণ করে ঘ্রানেন্দ্রিয় সেদিকে নিলাম। শক্ত ও লোমশ কিছুতে ঠেকে গেলো। ওভাবেই রইলাম। দুই হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে নিলাম। সাথে সাথে অনুভূত হলো, কোনো কিছুর দৃর বন্ধনে আবদ্ধ হলাম আমি। কোথাও থেকে ধুক বুক ধুক বুক সাউন্ড ভেসে আসছে আমার কানে। কোমরে ঠান্ডা কিছু একটার স্পর্শ পেলাম। কিছু স্পর্শ বোধহয় ভীষণ ভালোবাসাময় হয়ে থাকে।

_______________

ব্যালকনিতে রাখা দোলনার উপর বসে গুনগুনিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছে রুশী। চোখ দুটো বন্ধ। ভাবনায়, তার ভাবনার রাজার আগমন হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। তাকে নিয়ে ভেবে চলেছে। তার কেয়ারিংস! খুব বেশিই পছন্দ রুশীর। এই “তার” কথাটি, অয়নকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে। অয়নকে নিয়ে ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে রুশীর। গতকাল থেকে একটা প্রশ্ন রুশীর এই ছোট্ট মাথাটিতে প্রেশার ক্রিয়েট করছে। আপন মনেই বার বার প্রশ্ন করে যাচ্ছে,“এই প্রশান্তিময় অনুভূতির নাম কি ভালোবাসা?”

“ছোট মনি! তোমারে বড় স্যার ডাকতাছে।”

মাসুরা খালার আওয়াজে রুশী চোখ মেললো। অয়নকে নিয়ে ভাবতে গেলে, রুশীর ঠোঁটের কোণে হাসি সর্বদা থাকেই। সেই হাসি মাখা ঠোঁটে মাসুরা খালার উদ্দেশ্য বললো,“আচ্ছা, আসছি।”

মাসুরা খালা চলে গেলো। রুশী কিছু সময় বাদে উঠে দাঁড়ালো। বাবার ঘরের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো।

দরজার সামনে গিয়ে নক করে বললো,“বাবা, আসতে পারি?”

রুশীর বাবা রুমে বসে বই পড়ছিলেন। ভীষণ সখ উনার বই পড়ার। কিশোর কাল থেকেই এই অভ্যেসটা তৈরি হয়েছিলো। আর পরিবর্তন করতে পারেননি, কিংবা চাননি পরিবর্তন করতে। উনি বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,“আয় মা। বস এখানে।”

রুশী এগিয়ে গিয়ে তার বাবার সামনে বরাবর খাটে বসে পড়লো। রুশীর বসতেই ওর বাবা বললো,“একটা কথা বলার ছিলো তোকে মা।”

রুশী মৃদু হেসে বললো,“তা বলো না!”

রুশীর বাবা, রুশীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “কালকে আমার বন্ধু আসবে। পরিবার সহ। তাই ভার্সিটিতে যাওয়া লাগবে না তোর।”

“ওহ্ আচ্ছা! এই কথা! তো বেশ। যাবো না।”

রুশীর বাবা আবারও হাসলো খানিকটা। রুশীকে উদ্দেশ্য করে বললো,“অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়। যা!”

রুশীও তার বাবাকে ঘুমোতে বলে চলে গেলো। কে জানে? হয়তো আরো এক ভাগ্য কাল পরিবর্তন হতে যাচ্ছে।

________________________

সকালে পিটপিট করে চক্ষুদ্বয় হালকা খুললাম। পুরোপুরি না, আবছা অন্ধকার দেখছি। একটু বাদেই বুঝতে পারলাম, আমি বালিশে শুয়ে নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখবো যে, সেই অবস্থায় নেই আমি। কোনো কিছুর শক্ত বন্ধনের আবদ্ধ আমি। কর্ণকুহরে, মিষ্টি এক শব্দ ঢেউ খেলছে। নাসিকা পথে সেই স্মেলটা পাচ্ছি। মিনিট খানেক যেতেই বুঝতে পারলাম আমি কোথায়! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি কারো লোমশ বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছি। শরীরের অধিকাংশ আরহানের উপর। শাড়ি অগোছালো হয়ে আছে। দ্রুত উঠে পড়লাম। আমার উঠার ধরনে আরহানও জাগনা পেয়ে গেলো।

আমি তেজী কন্ঠে বললাম,“আপনি! আপনি বিশ্বাসঘাতক। আপনি বলেছিলেন, আমার সুযোগ নেবেন না। আপনাকে বিশ্বাস করেছিলাম আমি। কিন্তু! কিন্তু আপনি!”

আরহানের কি যেনো হলো, আমার দিকে অন্যরকম একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আমার দিকে এভাবে তাকাতেই আমি খেয়াল করলাম, আমার শাড়ি ঠিক নেই। ঠিক করে উনার দিকে আঙুল তুলে কিছু বলতে যাবো, উনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,“যা বলছো, ভালো বলছো। এবার একটু খেয়াল করে ধন্য করো, কে কার জায়গা থেকে সরে এসেছে? আজ ছেলে হয়েছি বলে কিছু বলতেও পারলাম না।”

কথাটা শেষ করেই বেড থেকে উঠে একটা টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আমি ততক্ষণে খেয়াল করেছি, উনি উনার জায়গাতেই ছিলেন। আমিই উনার কাছে এসেছি। ইশ! কিভাবে বললাম। আর নিজের এমন কাজে লজ্জা লাগছে। কি করে একটা ছেলের এতোটা কাছে যেতে পারলাম?

চোখ ঘুরিয়ে আয়নাতে দেখতেই, শাড়ির ফাঁক দিয়ে অনাবৃত কোমরে জ্বলজ্বল কিছু দেখতে পেলাম।

চলবে…

About

নবনিতা শেখ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}