গভীর রাতে হঠাৎ ফোন বাজার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। বিরক্তি নিয়ে চোখ বন্ধ করেই ফোনটা রিসিভ করলাম ওপাশে একজন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। কান্নার শব্দে আমার ঘুম পুরোপুরি কেটে গেলো আর আমি তাড়াতাড়ি উঠে ফোনটা চোখের সামনে ধরলাম। আমার বান্ধবী রেশমা ফোন করেছে কিন্তু ও এভাবে কাঁদছে কেনো? জানার জন্য জিঙ্গাসা করলাম,

> এভাবে কাঁদছিস কেনো বলবি? বাড়িতে বকাবকি হয়েছে?

আমার কথার উত্তর আসলো না কিন্তু কান্নার বেগ তুলনামূলক বৃদ্ধি পেলো। কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে আবারও জিঙ্গাসা করলাম এবার ওপাশ থেকে একটা মোটা কন্ঠের আওয়াজ আসলো আমি সালাম দিয়ে জিঞ্জাসা করলাম,

> কে বলছেন?
> আমি রেশমার মা বলছি। বাবা জুনায়েদ রেশমা আর নেই।
> নেই মানে কি বলছেন?
> সন্ধ্যায় তোমার আঙ্কেল বকেছিল তাই দরজা বন্ধ করে ও গলাই দড়ি নিয়েছে। তুমি একটু আসবে আমাদের বাড়িতে এখন? কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা।
> আন্টি আমি এখুনি আসছি।

তাড়াতাড়ি ফোনটা রেখে কোনরকম শার্টটা গায়ে জড়িয়ে রেশমাদের বাড়ির দিকে ছুটলাম। এডমিশনের জন্য আমি শহরে থাকি। অনেকদিন পরে সন্ধ্যায় ফিরেছি তাই কারো খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। ওদের বাড়ি আমাদের থেকে দশমিনিটের রাস্তা যদিও তেমন আসা যাওয়া নেই। মেয়েটা ভীষন ভদ্র আর বেশ সুন্দরী। আমার ভালো বন্ধু বলা যায়। হঠাৎ ওর মৃত্যুর খবর শুনে বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটাচ্ছে।কিযে কষ্ট হচ্ছে বলে বুঝাইতে পারবো না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ওদের বাড়িতে চলে আসলাম। বাড়ির গেট খোলা আছে তাই ভেতরে আসতে সময় লাগলোনা। নির্জন পরিবেশ, পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। জানিনা শরীর হঠাৎ কেমন ভারী হয়ে উঠলো। পা চলছে না। সারা বাড়িতে আলো বলতে তেমন কিছুই নেই। চাঁদের আলো আর পাশের বিল্ডিংয়ের আলোতে কিছুটা আলোকিত হয়ে আছে। আমি একপা দুপা করে রেশমার রুমের সামনে গেলাম। দরজা খোঁলা ভেতরে দুজন মানুষের ফিসফিস কথা বলার শব্দ শুনে কিছুটা ভয় কমলো। তারপর দ্রুত ভেতরে গিয়ে আমি চমকে উঠে পিছিয়ে আসলাম। রেশমার লাশ ঝুলছে। ওর জিব্বা মুখের মধ্যে থেকে বাইরে বেরিয়ে সেখান থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরছে। ড্রিম লাইটের আলোতে সব বেশ ভালো করেই দেখা যাচ্ছে। পাশে আন্টি আর আঙ্কেল দাঁড়িয়ে আছেন। উনারা কেমন কাঠের পুতুলের মতো এক দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখছে। আমি উনাদের থেকে চোখ ফিরিয়ে আবারও রেশমার ঝুলন্ত লাশের দিকে তাকালাম। মেয়েটা মনে হচ্ছে হাসছে। ভয় লাগছে প্রচুর তবুও চোখ সরাতে পারছিনা। হঠাৎ পেছন থেকে আওয়াজ আসলো,

> চলো ওকে বাগানে দাফন করি।
আন্টির এমন কথায় আমি চমক উঠে পেছনের তাকাতেই আঙ্কেল তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে রেশমার লিশটা নিচে নামিয়ে আমাকে বলল,
> জুনায়েদ বাগানে আমি গর্ত খুড়েছি তুমি ধরো ওকে। তাড়াতাড়ি দাফন না হলে পুলিশ আসবে তখন ওকে কাটাছেড়া করবে।আমার মেয়ের কষ্ট হবে।
> আঙ্কেল এগুলো তো ঠিক না। পরে ঝামেলা হবে।
> কিছু হবে না তাড়াতাড়ি ধরো।

আমি রাজি না হয়ে পারলাম না আঙ্কেল আন্টির জন্য শেষমেশ রাজি হয়ে ওকে নিয়ে বাগানে চললাম। ভয়ে আমার সারা শরীর কাঁপছে। বাড়ির পেছনে ডালিম গাছের নিচে গর্ত করা হয়েছে। আমি আর আঙ্কেল রেশমার লাশ নিয়ে ওখানে রাখলাম আন্টি দাঁড়িয়ে আছেন। উনি কেমন নিরব হয়ে গেছেন।জানিনা কন্যা শোক পাথর কিনা। আঙ্কেল আর আমি গর্তের মধ্যে ঢুকে সুন্দর করে মেয়েটাকে রাখলাম। খারাপ লাগছে ওর জন্য। মেয়েটা একটু ভালো দাফনও পেলো না। গর্ত থেকে উঠে মাটিচাপা দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। বাড়িতে এসে কাপড় চেঞ্জ করলাম। সারা কাপড়ে ধুলাবালি কাদা লেগে আছে। বাকিটা রাত আর ঘুম আসলো না তারপর ফজরের আজানের কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালবেলায় সেই আবারও ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙলো। ওপাশ থেকে রেশমার আওয়াজ কানের কাছে বেজে উঠলো।

> বাড়িতে এসেছিস অথচ তোর খোঁজ নেই। তাড়াতাড়ি বাড়িতে আই আম্মা পিঠা তৈরী করেছে।

আমি ভয়ে ভয়ে নাম্বার মিলিয়ে নিলাম দেখলাম ঠিকই আছে। তারপর ভাবলাম স্বপ্ন দেখেছি কিন্তু কাদামাটি লাগা কাপড়গুলো পাশে পড়ে আছে। ভয়ে ভয়ে আবারও ওদের বাড়ির দিকে ছুটলাম। গিয়ে আমি অবাক কারণ রেশমা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যেতেই খাতির করে ভেতরে নিয়ে গেলো। আঙ্কেল আন্টি সবাই বেশ হাসিখুশি আছেন। আমি কথার ছলে রেশমাকে নিয়ে বাগানের দিকে গেলাম। গতকালের গর্ত করা জায়গাটা তুলনামূলকভাবে উঁচু আছে। তবে খোড়া নেই। আমি আর এক মূহুর্ত্তের জন্যও ওদের বাড়িতে থাকলাম না বাড়িতে চলে আসলাম। না জানি কি ছিল ওটা।

About

লাবণ্য ইয়াসমিন

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}