ব্যাংকের কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন দেখে প্রমাদ গুনলাম। সবার পেছনে দাড়িয়ে কারন জানতেই ঠিক আমার সামনে দাড়ান মেয়েটা জানালো-সার্ভারের প্রবলেম।
–আপনি কতক্ষন দাড়িয়ে, আপনা্র আগেও তো জনা দশেক হবে।
–আধাঘন্টা ধরে শুনছি সার্ভারের সমস্যা, ঠিক করার কোনও গরজ নাই। বোরকাবৃত নারী কন্ঠে শুধু চোখের পানে তাকিয়ে কথাগুলো বলে দিলো।

পর্দার অন্দর থেকে শুধু কালো চোখের চোখাচোখিতে জেনে যাই,আড়ালে তার অপার সৌন্দর্যের শর্বনাষের আভাস।সামনে পিছনে এমন আগ্রহী চোখ আরও আছে তা বুঝতে সময় লাগে না।সার্ভার কখন ঠিক হবে, আর কতক্ষন অপেক্ষা করবো-ইত্যাকার শোরগোল। আমার খুব তাড়া নাই। আরও কিছুক্ষন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা যায়। ঠান্ডা ঘরে তাছাড়া সরকারী ব্যাংক-এটা এমন কিছু না।

সামনের তরুণী একবার আমার দিকে ঘুরে বলল-প্রাইভেট ব্যাংক হোলে এতক্ষন হুলুস্থুল বেঁধে যেতো, এখানে কারও কোনো গরজ নাই।
–আমি আগের দিনেও এমন ঝামেলায় পড়েছিলাম।
–আপনার জন্যেই বোধ হয় আজও আমাদের সবার এই ফাদে পড়তে হলো, বলে হেসে উঠলো। হাসিটি দেখতে পেলামনা বটে তবে শব্দের রিনঝিনই বলে দেয় তার ঝংকার কতখানি।

আপনার কলমটা দেবেন,চেকের পেছনে একটা সই করতে হবে বলেই হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। আমি তার হাতে কলমটা ধরিয়ে দিয়ে তাকিয়ে রইলাম-অনন্যসাধারন হাতের দিকে। ফর্সা আঙুলের ডগায় টকটকে মেহেদির উজ্জ্বল আভা। কি চমৎকার মানিয়েছে। হাতের তালুতে একটু ময়ালা নেই। আহা এক মুহুর্তে “পাকিজা’র” মীনা কুমারী আমার সামনে এসে উদয় হয়। পৃথীবীর কোনও ময়লা স্পর্শ করেনি এই হাতে। মেহেদীর রঙ যেন এমন হাতের জন্যই সৃষ্টি।

আপনার কলম, আমি হাতের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেই।এত দ্রুত কাজ শেষ? আর কি কোন কিছুতেই হাত বের করতে পারে না। চেক ধরা, কিংবা অন্য কিছু।সাথে ব্যাগ আছে কিনা কে জানে। এক হাতে সেটা ধরে রাখলে ক্ষতি কি?

নাহ! কিছুতেই প্রতিক্ষা শেষ হয়না। এবার লাইন সচল হতে থাকে, ধীরে এগিয়ে যাই কাঊন্টারের দিকে। উপরওয়ালা আমার মনের কথা বুঝতেই- মেয়েটার ফোন বেজে উঠে। ব্যাস,এবার একহাতে ফোন অন্য হাতে চেক। সেই সুন্দর মসৃন,ফর্সা মেহেদী রাঙানো হাতে মোবাইলটাও কি সুন্দর মানিয়ে যায়। এক মুহুর্তে “রাজকুমারে’র ভুমিকায় যেতে ইচ্ছে করে। এযুগে এমন কর্মে ধোলাই ছাড়া কপালে আর কিছু জুটবে বলে মনে হয়না, তাই পিছিয়ে আসি। মেয়েটি একগোছা টাকা নিয়ে বেরিয়ে যায়। কি নিষ্টুর,একটিবার ফিরেও তাকাতে নেই?

এই যে এতক্ষন একসাথে দাড়িয়ে রইলাম, কুড়িয়ে পাওয়া এমন মহেন্দ্রক্ষনের কোনও মুল্যই কি দিতে নেই। আমি আরও দ্রুত টাকা নিয়ে বাইরের হাটি, যদি দেখা হয় তো এবার নির্ঘাত-আজ পাকিজার রিমেক করেই ছাড়বো। এখানে না হয় লোকজন ছিলো। সুন্দরের প্রশংসা কি পাপ?

বাইরে এসে কোথাও দেখলাম না, সে কি আর আমার জন্য এই গ্রীষ্মের গরমে দাঁড়িয়ে থাকবে, আহাম্মক? হতাশ হয়ে লিফট দিয়ে নেমে আসি। বাইরে দাঁড়িয়ে দেখি তিনি। আহা! আমার জন্যই বোধ হয়। এমন দৃশ্যের জন্যেই রিক্সার উদ্ভব। কাছে গিয়ে দাড়াতেই রমনী বলল- যাক তাহলে দ্রুতই হয়েছে, আর কোন ঝামেলা হয়নি।
–ঠিক বলেছেন। আমি একটা কথা বলতে এলাম কিছু মনে করবেন না তো
–না না মনে করবো কেনো, কি কথা?
–আপনার হাতের আঙুলের ডগার মেহেদী খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল।
–ও মা, তাই নাকি, আপনি বুঝি আমার হাতের তালুর দিকে চেয়ে ছিলেন?
–হ্যাঁ, অল্প সময়ের জন্য।
–হুম, তা আপনি তো লোক সুবিধের না
–না, ঠিক খারাপভাবে নেবেন না দয়া করে।
আবার সেই হাসির অনুরণন
–তা হাতের উল্টো দিকের মেহেদী দেখেননি, আচ্ছা এই দেখুন। বলেই কনুই অবদি মেহেদী লাগানো হাতখানা বের করে দেখালেন।

আমি বিশ্ময়ে একবার হাতের দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে রইলাম। অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। মেহেদির লাল রঙের ফাকে উকি দিচ্ছে কালো হয়ে থাকা ফর্সা হাতের ক্ষতগুলো।
–দেখুন ভালো করে সুন্দর হাতের মেহেদী। বলেই রিক্সায় উঠে যায়।

না, এমন অসহ্য সুন্দর আর দেখতে চাই না, মনে মনে বলি। আরও অসংখ্য মীনাকুমারীদের গল্পটা কি প্রায় একই রকম, এমন উজ্জ্বল রঙের আড়ালে। জানা যায় না কিংবা জানা হয় না কোনোদিনও…

About

Asif Iqbal

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}