রুবা বেশ কিছুক্ষণ ধরে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে, কথা বলছেনা। ঘরের বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে, ঘর একদম অন্ধকার। রুবার ছেলে মেহেক আরাম করে ঘুমাচ্ছে, একদম নিরবচ্ছিন্ন ভাবে।

আকাশ অনবরত বিভিন্ন কথা বলে যাচ্ছে, রুবার যতো দোষ আছে, আকাশ বলছে। রুবা কয়েকটি উত্তর দিয়েছে। কিন্তু শেষের কথা টা শুনে রুবার বুকের ভিতর বড় একটা পাথর আটকে গেছে, তা কিছুতেই আর নামছেনা, দম নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তবুও রুবা চুপ হয়ে বড় করে শ্বাস ফেলার চেষ্টা করছে।

রুবার আজকে দুইটা অপারাধ ধরা পরেছে আকাশের চোখে, এজন্য আকাশ কথা শুনিয়ে যাচ্ছে।

প্রথম অপরাধ হচ্ছে ফ্রিজের ভিতরে করলা লাল হয়ে গিয়েছে। কেন লাল হলো? এটা কেন আগে খাওয়া হয়নি! এই নিয়ে কথা চলছে, রুবা বার বার বলছে করলা সে গত কাল কিনেছে। আর কেনার আগেই বাঁধাকপি ভাজি করেছে, তাই করলা বের করা হয়নি। আর আজকে বাচ্চার পছন্দের লাল শাক ভাজি করায়, আর করলা বের করা হয়নি। তাছাড়া শুধুমাত্র লাল হয়েছে, নষ্ট হয়নি। কিন্তু তবুও এটাই রুবার অপরাধ।

রুবা বললো,
কাল করলা খাওয়া যাবেনা?

  • না, এই লাল করলা আমি খাবো না।
  • নষ্ট হয়নি তো!
  • অবশ্যই হয়েছে! তুমি উদাসীন, তুমি ফ্রিজের জিনিসের খেয়াল কর না।
  • কেন করবো না?
  • তর্ক করবেনা, একদম পছন্দ হয়না। বিরক্ত লাগে।

রুবা চুপ করে রয়েছে, কি দরকার তর্ক করে? এই সংসারে সব করলেও এই সংসারের কাজ গুলি আকাশের চোখে পড়েনা!!
দ্বিতীয় অপরাধ হচ্ছে এসির থেকে যে পানি বিকালে বের হয়েছে সেটা কেন এখন বালতিতে?
রুবা বললো, সামান্য আছে, রাতে এসি ছাড়লে আবার পানি ভরে যাবে, তখন ফেলে দিব!

  • দিনে কি সারাদিনের প্রস্রাব এক সাথে কর?
  • কেন?
  • তখন ছাড়তে পারলে, এখন ফেলতে পারবেনা কেন?
  • এভাবে নোংড়া করে কথা বলবেনা প্লিজ!
  • কাজ করার সময় মনে থাকেনা! যে এই সব শুনতে হবে।
  • প্লিজ আর কথা বলবে না, আমি পানি ফেলে দিচ্ছি!
  • তোমার সাহস দেখি অনেক বেড়ে গিয়েছে, আমাকে হুকুম কর?
  • হুকুম করিনি, বলেছি, কথা বলতে ভালো লাগছেনা।
  • তোমাকে প্রশ্রয় দেওয়াটাই ভুল হয়েছে। যেখানের মানুষ সেখানেই রাখা উচিত।
  • আমি কোন জায়গার মানুষ?
  • তুমি আমার পোষ্য। পোষ্য কোঠার মানুষ, সেভাবেই থাক।
  • বুঝে কথা বলো আকাশ!
  • এই রুবা, একদম সাহস দেখাবেনা, আর এটা তোমার বাবার সংসার না যে, সবার সাথে পন্ডিতি করবা। এটা আমার সংসার, আর এখানে এই সব পন্ডিতি আমি পছন্দ করছিনা।
  • এই সংসার শুধুই তোমার?
  • অবশ্যই, এটা চিরন্তন সত্য। ভালো লাগলে থাকবে, নয়তো…
  • চলে গেলে তুমি খুশি তাইনা?
  • এজ ইউর উইশ।

রুবার বুকে যে পাথর আটকে আছে, এখন কিছুতেই নামছেনা। শুধু ভাবছে, পুরো পরিবারকে বিয়ের জন্য, অনেক কষ্টে রাজী করিয়েছিল রুবা, শুধু আকাশ কে ভালবেসে। তার সেই ছোট্ট লাইব্রেরির আয়ে টেনেটুনে সংসার করেছে রুবা। কিছু টাকা কষ্ট করে জমাতে পারলে ঘরের জন্য জিনিস কিনেছে রুবা। আর তার প্রিয় আকাশের কি দরকার তাই নিয়ে ভেবেছে! নিজের জন্য কিছুই কখনো কিনতে ইচ্ছে করেনি! এখন আকাশ সফল ব্যবসায়ী, তাই এখন সবই ভুলে গিয়েছে।

রুবা অন্ধকার ঘরের চারপাশ দেখছে, তবে এই সংসারের সে কে? কি তার পরিচয় আকাশ সাহেবের পোষ্য কোঠায় থাকা একজন নারী?

সামান্য কিছু জিনিসের জন্য কত বড় বড় কথা কত সহজেই বলে দিল আকাশ। রুবার অন্ধকার ঘরে, দুচোখ পানিতে ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। গলায় কেমন যেন চিন চিন ব্যাথা লাগছে।

ঠিক সে সময়ই তার মা ফোন দেন, ঘড়িতে সাড়ে এগারো টা হবে।

রুবা হাসিমুখে কথা বলে,
আম্মু এতো রাতে?

  • তোর আব্বা আজ ইলিশ এনেছেন, ডিম রেখে দিয়েছি, তুই আসলে ভাজবো। কবে আসবি?
  • তাড়াতাড়ি আসবো আম্মু৷ আব্বু কি করেন?
  • এখন ইজি চেয়ারে বসে বসে আরাম করছে, খাওয়ার পর হাঁটতে গিয়েছিল। এখন ক্লান্ত হয়ে ফিরেছে। ইলিশ নান্নান কি করে?
  • মেহেক ঘুমাচ্ছে।
  • আকাশ?
  • ঘুমিয়েছে আম্মু।
  • আচ্ছা ডিমের খবর দিতেই কল দিয়েছিলাম রাখি রে মা। দুই/এক দিনের মধ্যে আয়, রুমান ও বলছে আপু আসলে ইলিশ খাবো।
  • আচ্ছা মা, আসার চেষ্টা করবো।
  • নান্নান কে আদর দিস।
  • আচ্ছা। ভালো থেকো মা, আসসালামু আলাইকুম।
  • ওয়ালাইকুম আসসালাম।

রুবার নিজেকে বেশ পাকা অভিনেত্রী মনে হয়। তার মা ফরিদা বেগম কিন্তু তার চোখ ভর্তি পানি, এবং গলার ভিতরে যে, প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে একদম ধরতে পারেন নি। প্রত্যেক টি মেয়েই হয়তো এক আকাশ কষ্ট নিয়ে, হাসিমুখে থাকতে পারে।

ফরিদা খাতুন এখনো আকাশ কে পুরোপুরি মেনে নিতে পারেন নি। কারণ বছর দুই হয়েছে আকাশের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু তার এমন চাঁদের মতো সুন্দর মেয়ের সাথে কালো আকাশ একদম বেমানান। এটাই তিনি মানতে পারেন না। তবুও তেমন একটা ভালো না লাগলেও মেয়ের জন্য আকাশ কে কিছুটা মেনে নিয়েছেন ফরিদার। সারাক্ষণই রুবা, মায়ের সামনে আকাশের কত কত প্রশংসা করে যায়, যাতে তিনি আস্তে আস্তে পুরোপুরি মেনে নেন।

রুবার বার বার মনে হয় এই মায়ার সংসার, সাজানো গোছানো পরিপাটি সংসারে সে কে? তার এতো এতে সময়, এই সংসারে সবই বৃথা!

রুবা দেখছে, আকাশ এতো কথা বলার পর ও এখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে, কারণ তার এতো বড় বড় কথা বলে খারাপ লাগা আসেনি, কারণ সে কিছুই মনে করেনা, যে তার কথায় একজন মানুষ কষ্ট পেতে পারে! তার জন্য একসময় সব ছেড়ে চলে আসতে চেয়েছিল, অথচ সেই এখন বলে, ভালো না লাগলে চলে যাও। কত্ত সহজেই বলা যায়!

সত্যি কথা, কন্যারা পিতার রাজ্যের রাজকন্যা হয়, বাবার আদুরে রাজকন্যা। তাইতো এখনো বাবা মেয়ের পছন্দ করা মাছটি এনেও মেয়ের জন্য অপেক্ষা করেন, মেয়েকে আদর করে খাওয়াবেন বলে!

মা ছোট্ট সময় একবার বেত দিয়ে পায়ে মারার জন্য পা সামান্য ফুলে গিয়েছিল। মা রাতে এসে কতবার ভেসেলিন লাগিয়ে দিয়েছিলেন, নীরবে চোখের পানি ও ফেলেছেন! আহারে, তার কন্যাটি কষ্ট পেয়েছে।

অথচ, আকাশ এতো কথা বলেও আরাম করে ঘুমাচ্ছে। তার কোন অনুশোচনা নাই। আজ রুবার ভিতরে যে ক্ষত হয়েছে তাতে মলম দেওয়ার কেউ নেই, সে খুবই একা!

রুবার ভিতরের পাথর টা কোন ভাবেই নামছেনা, ভেতর থেকে শুধুই দীর্ঘশ্বাস আসছে, আর বার বার একই প্রশ্ন মাথায় আসছে আমি কে? কোথায় আমার ঠিকানা? এই সংসার, এই ভালবাসার মানুষ সবই কি তবে মিথ্যা!

সমাপ্ত!

আন্নামা চৌধুরী
২৯/১০/২০২১

About

Annama Chowdhury

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}