তনু’র মা রক্ষণশীল পরিবারের বউ হলেও মনে প্রাণে একজন প্রগতিশীল নারী, তিনি সবসময়ই চেয়েছেন তার ছেলেমেয়েরা অন্তত উচ্চ শিক্ষায় যেনো শিক্ষিত হতে পারে, যাই হোক যেটা বলছিলাম পাত্রের মায়ের এই কথা শুনে তনু’র মা পরিস্কার বলে দিল আমার মেয়ের বিয়ে আপনার ছেলের সাথে হবে না, যদিও ঐ সময় বিয়ের কেনাকাটা থেকে শুরু করে বিয়ের কার্ড পযর্ন্ত ছাপানো হয়ে গিয়েছিল, তনু আর ওর মেজোবোন রাজিয়ার একই সাথে একই দিনে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।
রাজিয়ার বিয়ে হয়ে গেলো, তনু’র বিয়েটা আর হলো না, তনু’র অসুস্থ বাবা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো, তার করার কিছু ছিল না,রাজিয়ার বিয়ের অনুষ্ঠান তার চাচা আর মামারা মিলেই শেষ করলো,সাথে ছিল ওদের বড়আপু আর দুলাভাই, তনু’র বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার পর সবার মন খারাপ হলেও খুশী হলো অমিত আর তনু ওরা মনে মনে এটাই চেয়েছিল হয়তো দু’জন দু’জনের বাবার কথা মনে করে এ বিষয়টা নিয়ে আর কথা বলেনি,তনু ও আবার পড়াশোনায় মনোযোগী হলো।
অনেক দিন পরে আসল সত্য জানা গেলো, অমিতই পাত্রের মা’কে এসব কথা বলতে বলেছিল আর তাদের সম্পর্কের কথা জানিয়েছিল যাতে বিয়েটা না হয় তাই এই ব্যবস্থা। এতদিনে তনু’র বাবা শয্যাশায়ী, তনু ও প্রতিটা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে এথন ফাইনাল ইয়ারে, আর অমিতের বাবা হার্ট এট্যাক করে এরই মধ্যে মারা গেছেন, সংসারের দায়িত্ব এখন অমিতের উপর, ওর ছোট আরো দুটো ভাই বোন আছে, বাবার বিশাল ব্যবসা, সেটা দেখাশোনা করতে হবে।
তনু ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে,পড়ালেখার ব্যাপারে সে কোন কিছুর সাথে কম্প্রোমাইজ করে না,অমিতের সাথে প্রেম করুক আর যাই করুক সে লেখা পড়াকে বরাবর গুরুত্ব দেয়, এরই মধ্যে তারা বাসা পাল্টে অন্য এলাকায় চলে গেছে, বাড়ীতে এখন মা, ছোট ভাই আর অসুস্থ বাবা, বড় দুইবোন যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত।
অমিত তার ব্যবসার হাল ধরেছে,কিন্ত ব্যবসাটা বাবার মত করে সামলে উঠতে পারছে না এরই মধ্যে ব্যবসায় লাভ দূরে থাক মূলধনে ঘাটতি পড়া শুরু করেছে, এরকমই আশাংকা করছিল অমিতের মা,ওর তো ব্যবসায় মন নাই সারাক্ষন তনু’র ধ্যানে থাকে, এখন তনু’র ভার্সিটিতে যেয়ে প্রতিদিন তনু’র সাথে দেখা করে, ব্যবসায় সময় দেয় না বললেই চলে।
অমিতের মা তাকে বোঝাতে বোঝাতে এখন চুপ হয়ে গেছে, এখন বলারই বা কি আছে,ছেলে এখন মস্ত সেয়ানা, নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারে,কারো তোয়াক্কা করে না, এখন আবার একটু আধটু নেশা করা শুরু করেছে। তনু’র পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো, ওর ডির্পাটমেন্টে ফার্স্ট হয়েছে, এরই মধ্যে তনু নিজের মেধায় স্যারেদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে, ডির্পাটমেন্টের হেড স্যার বলেছে, মাস্টার্স শেষ করে ভার্সিটিতেই লেকচারার হিসাবে জয়েন করতে।
তনু’র অসুস্থ বাবা এরই মধ্যে একদিন মারা গেলো, ওর বাবার একটা দোকান ছিল, সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা ভাড়া দিয়ে দিল, এর আয় দিয়েই ওদের সংসারটা চলত। মাস্টার্স শেষ করার আগেই একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরী হলো তনুর, প্রথম ইন্টারভিউতেই চাকরী হয়ে গেলো, চাকরীর কারণে ঢাকায় এসে কর্মজীবি মহিলা হোস্টেলে থাকতে লাগলো।
তনু’র বড়আপু মাঝে মাঝে দেখে আসে,রান্না করা খাবার নিয়ে যায়, নিজ হাতে পরম মমতায় খাবার খাইয়ে দেয়, বেতনের কিছু টাকা নিজের জন্য রেখে বাকিটা মা’র কাছে পাঠিয়ে দেয়। একদিন বড়আপু হোস্টেলে যেয়ে দেখে তনু নাই, রুম মেটের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে সে তার কোন এক কাজিনের সাথে সিলেটে বেড়াতে গেছে, তাজি চিন্তা করেও খুঁজে পায় না এমন কোন কাজিন আছে যার সাথে তনু বাইরে যেতে পারে।
তাজির মাধায় কিছু ঢুকছে না,বাসায় এসে ও কিছু জানায়নি ওর স্বামীকে। দুদিন পর অমিত তনু’র বড়আপুকে ফোন করে দেখা করেতে চায়, তখনকার দিনে মোবাইল ছিল না পাশের ফ্ল্যাটে ফোন করে ডেকে দিলে তবেই কথা বলা যেতো, তাজির প্রতিবেশী ভালোই ছিল কোন ফোন আসলেই ডেকে দিত,যাই হোক অমিত যখন তাজির সাথে দেখা করতে চাইলো। তাজির বুকটা কেঁপে উঠল অজানা এক আশাংকায় কোন দুঃসংবাদ নয়তো!!! ক’দিন আগেই বাবাকে হারিয়েছে, তাজি আর চিন্তা করতে পারছে না, অমিতকে তার বাসায় পরের দিন আসতে বলল।
আজ আমিত এসেছে বড়আপুর সাথে দেখা করতে,
- কি রে খারাপ কোন কিছু? কোন কুশল না জিজ্ঞাস করেই সরাসরি জানতে চায় তাজি,
- না তেমন কিছু না বড়আপু, একটা কাজ করেছি, সেটাই আপনাকে বলতে এসেছি,
তাজি নিজের হার্টবিট নিজেই শুনতে পাচ্ছে - বল কি করেছিস অমিত
- আমি তনুকে বিয়ে করেছি
- মানে?
অমিত দুইটা কাগজ বের করে তাজির হাতে দিল, তাজির হাত পা কাঁপছে, মাথা ঘুরছে,সে এরকম কিছুই আশংকা করেছিল,প্রথম কাগজটা রোটারী পাব্লিকের যেখানে অমিত রায় এর নাম এবং ধর্ম পরিবর্তন করে এখন নতুন নাম আনোয়ার হোসেন, লেখা আর দ্বিতীয় কাগজটা বিয়ের কাবিন নামা। কাগজ দুটো পড়ে তাজি ফিরিয়ে দিল অমিত ওরফে আনোয়ার হোসেনের কাছে। - তনু কোথায়?
- ও হোস্টেলে আছে
- এরপর তোরা কি করবি?
- তোর ফ্যামিলির কেউ জানে? মানে অনিমা, মাসিমা এরা?
- জানে
- তারা কি বলেছে?
- বাড়ীতে ঢুকতে মানা করেছে,
- তো কি করবি এখন?
- জানিনা, তবে ঢাকা ছেড়ে চলে যাবো
- যেখানে খুশী যা তোরা তবে আমার মা’র কাছে যাস না,আমার মা সহ্য করতে পারবে না, যে কোন অঘটন ঘটে যাবে
- আচ্ছা বলে বিদায় নিল আনোয়ার, হ্যাঁ আজ থেকে ও অমিত নয় আনোয়ার
অমিত চলে যাওয়ার পর তাজি নিজেকে সামলাতে পারলো না হাউমাউ করে অনেকক্ষন কেঁদে নিজেকে হালকা করলো,রাতে ওর স্বামী বাসায় আসলে সব ঘটনা খুলে বলল।
আনোয়ার আর তনু নিজ জেলায় ফিরে যেয়ে ছোট একটা একরুমের টিনশেড বাসা ভাড়া নিয়ে শুরু করলো নতুন জীবন, তনু চাকরী ছেড়ে দিয়েছে, আনোয়ার কোন রকমে বিএ পাশ করেছিল,মফস্বল শহরে চাকরীর সুযোগ নাই,বাবার ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে, একটা দোকানে কর্মচারী হিসাবে যোগ দিল, তনু টিউশনি শুরু করলো, কোন রকমে দু’জনের সংসার চলে যায়।
তনু আবারো তার মাস্টার্স শুরু করলো, তখন তারা দৃই পরিবার থেকেই বিচ্ছিন্ন, বাবাহীন দুই পরিবারের দুই মা সমাজের কাছে মুখ দেখাতে পারে না, কাঁদতে কাঁদতে তাদের চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে, এরই মধ্যে তনু ওর মা’কে দেখার জন্য বাড়ীতে যায়, মা দেখা করেনি, বলেছিল আমার ছোট মেয়ে মারা গেছে, আমি ওর কথা মনে করতে চাই না, তনু’র ভাই গেট থেকেই তাকে বিদায় করে দিয়েছে, পাছে ওকে দেখে মা আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে, অমিতের ও একই অবস্থা ওর ছোটবোনটা বিয়ের পর আত্মহত্যা করেছে, এখন ছোট ভাইকে নিয়ে অমিতের মা থাকে।
দুই বছর পরে ওদের কোলজুড়ে আসে ওদের প্রথম সন্তান আনিকা, ওর যখন জন্ম হয় নার্সিং হোমে কাছের মানুষ বলতে কেউ ছিল না,তনু’র এক বান্ধবীর মা খবর পেয়ে এসেছিল,নার্স যখন বাচ্চা ধরার জন্য কাপড় চেয়েছিল,তনু তার ওড়না টা দিয়েছেল, সাথে করে কিছুই আনেনি বা আনার মত সামর্থ্য ছিল না। আনিকার বয়স যখন দশমাস ওকে নিয়ে তনু আবার ওর মা’র বাড়ীতে সাহস করে এলো, ভাবলো মা বুঝি এবার সব কিছু ভুলে বুকে টেনে নেবে, মা বুকে টেনে নিয়েছিল তবে তনুকে নয়, তনু’র মেয়ে আনিকাকে, সেই থেকে আস্তে আস্তে মায়ের বাড়ীতে যাওয়া আসা শুরু করলো।
এদিকে আনোয়ার সেই নেশাটাকে এখন আরো আপন করে নিয়েছে, বাবা হারিয়েছে, ছোটবোনকে হারিয়ছে,মা থেকে ও নাই এত বড় ব্যবসা থাকতেও আজ সে অন্যের দোকানের কর্মচারী,এর সাথে নতুন আরেকটা রোগ যোগ হয়েছে,যার নাম সন্দেহ, তনু নতুন করে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ায় তার মধ্যে সন্দেহ হয় রূপবতী, শিক্ষিত তনু অন্য কারো নজরে পড়বে নাতো, অহেতুক সন্দেহ নিয়ে প্রায়েই তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়, কখনও কখনও গায়ে হাতে তুলতে ও দ্বিধা করে না,তনু বুঝতে পারে ভুল করেছে, ভুলের মাসুল তো দিতে ই হবে, সব অত্যাচার, অপবাদ সহ্য করে মাস্টার্স পরীক্ষাটা শেষ করে, ফলাফল যথারীতি প্রথম স্থান।
চলবে…