মাউন্ট মঙ্গানুয়ি শহর আর আমাদের প্রথম বাসা

নিউজিল্যান্ডর জনসংখ্যা অত্যন্ত কম জেনেই সেখানে গিয়েছিলাম। তবুও রাস্তায় বের হলে অস্বাভাবিক রকমের অস্বস্তি বোধ হতো যেনো কোথাও কেউ নেই। রাস্তা ঘাটে কাউকে তো দেখা যেতোই না, বাড়িগুলোও মনে হতো জনশূন্য কেমন নিশ্চুপ! বাচ্চাদের চিৎকার, বড়দের চেঁতামেচি বা কুকুরের ঘেউ ঘেউ কিছুই নেই। হাঁটতে বের হলে কেমন গা ছমছম করা ভুতূড়ে অনুভব! প্রথম দিকে গাড়ি না কেনার ফলে আমাদের হেঁটে বা বাসে চলাচল করতে হতো।আমি নিশ্চিত আমাদের দেখেও ওদেশীরা অদ্ভুত ভাবতো প্রথম প্রথম কেনোনা ওরা ঘুরতো হাল্কা পোশাকে আর আমরা ভারী লম্বা জ্যাকেট পরেও শীতে কাঁপতাম। প্রমাকে নিতাম স্ট্রলারে আর প্রমা খুব তাড়াতাড়ি তার বেল্ট খুলে ফেলা শিখে গেলো এবং সময় সুযোগ মতন খুলে ফেলতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করতো না। বিশেষ করে বাজারে বা শপিং মলে গেলে তাকে বসানো আমার দায় হয়ে পড়তো আর এটা সেটা দিয়ে ট্রলি বোঝাই করে ফেলতো সেগুলো জায়গামত রাখা আমার আর একটা বাড়তি কাজ ছিল।

আমরা, মূলত প্রমার বাবা সিদ্ধান্তে আসতে পারছিল না থাকবে না ফিরে যাবে দেশে। বিশেষ করে যেসব ডাক্তারদের সাথে দেখা হতো কবীর লোজে আর তার বাইরেও সবাইকেই বেশ হতাশ মনে হলো চাকুরীতে ঢুকার ব্যপারে। কারণ তাদের কাছে মনে হয়েছিল ওখানে (USMLE)আমেরিকার রেজিস্ট্রেশন, (IELTS) ইংরেজী পরীক্ষা পাশ করবার পরও ওদের ক্লিনিকাল পরীক্ষা পাশ করতে হতো কাজ করার জন্য। বাঙ্গালী ডাক্তারদের মনে হয়েছিল কাজে প্রবেশ করবার পদ্ধতি কৃত্রিমভাবে বিদেশী ডাক্তারদের জন্যে কঠিন করে রাখা হয়েছে। আমাদের খালা খালু( আম্মার চাচাতো বোন) পার্শবর্তী সুন্দর সমুদ্রপাড়ের এক শহরে থাকতেন। আমরা কিছুটা সময় কিনার জন্যে আর তাদের সাথে দেখা করে উপদেশ নেবার জন্যে কয়েক সপ্তাহের জন্যে সেই শহরে দুই রুমের একটা ফ্ল্যাটে থেকেছিলাম। আপনজনদের দেখলে কার না ভালো লাগে? তদুপরি ঝিমা খালা ছিলেন ‌অত্যন্ত হাসিখুশী সদালাপী বন্ধুবৎসল একজন মানুষ। উনাকে সবাই পছন্দ করতো আর সারাদিন কাজের পরে উনার বসার ঘরে অনেক গল্প জমতো। গল্প করতে দারুন মজা লাগতো ঠিকই আর উনার রান্নাও বেশ মজা করে কতদিন খেয়েছি। বিশেষ করে দেশী মুরগীর মতন হার্ড চিকেন রান্না উনার অনেক মজা হতো। খালুও অনেক অতিথিবৎসল ভালো মানুষ তবে উনি কথা অনেক কম বলতেন। আমি খেয়াল করেছি দাম্পত্য জীবনে একজন কথা বেশী বললে অন্যজন কথা কমই বলে থাকে বা সুযোগ পায় না। ঝিমা খালার ভাষ্য অনুযায়ী খালা রাগ করলে নাকি খালু খুশী হতেন কারণ তার সাথে আর কথা না বলে চুপচাপ থাকতে পারবেন।

আরও বেশকিছু বাঙ্গালী ডাক্তার,ইনজিনিয়ার, ডেনটিসট, এগ্রিকালচারিসট সহ অনেক প্রফেশনাল ঐ শহরে থাকতেন এবং কেনো যেন সারাদিন বাগানে অড জব করতেন। তাদের মধ্যে তখনো পরীক্ষা দেবার,ডাক্তারী বা প্রফেশনাল কাজ করবার উৎসাহ আর মানসিকতা তৈরী হয়নি।আনন্দের সাথে বলতে পারি পরে প্রায় সকলেই নিজ নিজ পেশায় কাজে নিয়জিত হয়েছেন। ওখানে আমাদের সাথে সখ্যতা হয়েছিল ডেনটিসট ববি ভাই ডেইজি ভাবীর সাথে যাদের সাথে পরে বহু বৎসর অকল্যানডে একসাথে কাটিয়েছি। খুবই ভালো মনের এবং এখন পর্যন্ত আমার প্রিয় দু’জন মানুষ শেলী ভাবী আখতার ভাইয়ের সাথেও ওখানে পরিচয়। আর ব্যচেলর তারিক ভাইয়ের কথা না বললেই নয়, উনি নিজ উৎসাহে আমাদের যে কি পরিমান সাহায্য করেছেন তা কোনোদিন ভুলবার নয়। উনি এবং অন্যান্য বড়ভাই আর আমার তিন বন্ধু আসিফ মোমিন আর ফারহান না থাকলে প্রথমদিকে আমাদের প্রবাসজীবন যন্ত্রণাদায়ক হতো কোনোই সন্দেহ নেই।

ইতোমধ্যে আমার ভাই কাওসারের আয়ারল্যানডের কর্ক শহরে কাজ পেয়ে যাবার সংবাদ পেয়ে একই সাথে আনন্দিত আর দুঃখিত হলাম। ও যাবার আগে মাউন্ট মঙ্গানুয়ি শহরে আসলে আমি শহরটি ঘুরে দেখালাম। ছেলেরা সারাদিন বাগানে কাজ করতে যেতো আর আমার সারাদিন কাটতো রাননা করে , প্রমাকে খাবার গোসল করানো আর ঘুম পাড়ানোতে, কাপড় ধুয়ে শুকিয়ে আর ঘর পরিষ্কার করে। যে কাজই আমি করতাম প্রমা আমাকে আঁকড়ে ধরে থাকতো, কোলে করেই বেশীরভাগ কাজ করতে হতো আর না হলে আমার কাপড় ধরে থাকতো।আমি এমনকি গোসল করতেও পারতাম না- বুঝতে পারতাম ওর ভয় যেনো ও আর কাউকেই জীবন থেকে হারাতে চায় না! যেনো আমিও কোথায় হারিয়ে যাব আর সকলের মত। আমি রীতিমত হতাশায় ভুগতে শুরু করলাম যে জীবনে আর কোনোদিন কি ডাক্তারী পেশায় যেতে পারব না?! ভাইয়ার কাজের ব্যপারটা অবশ্য আমাদের উজ্জীবিত করলো অকল্যানডে ফিরে আসবার জন্যে আর পড়াশুনা শুরু করবার জন্যে।
একদিন প্রমাকে স্ট্রলারে নিয়ে ভাইয়ার সাথে শহর হেঁটে হেঁটে ঘুরে সাংসারিক বাজার শেষে মাত্র ফিরলাম। দরজার লক খুলে ঢুকে বন্ধ করতে গিয়ে স্লাইডিং দরজা আমার হাতে বেশ জোরে এসে ধাক্কা দিল। আমি প্রচন্ড ব্যথায় আঁতকে উঠলাম, তারপর মনে নেই। কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে দেখি আমি মেঝেতে আর ভাইয়া আমার চোখেমুখে পানি দিচ্ছে। ভাবলাম হায়রে বিদেশ! ভাবলাম ভাইয়া যদি সাথে না থাকতো আমার প্রমার তখন কি হতো?! পুরো শহর ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই! চারিদিকে শূন্যতা।

চলবে…

About

Shahnaz Parveen

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}