বিদেশে আমার প্রথম সংসার

খেয়াল করেছি মানুষের যখন অল্পতেই তুষ্টি তখন কোন কিছু খুঁজে পেতে বা কিনতে বেগ পেতে হয় না। আমাদের ও অকল্যান্ডে বাসা খুঁজে পেতে মাত্র এক সপ্তাহান্ত লাগল। বাসার ন্যুনতম নির্নায়ক ছিল এটি অকল্যান্ড হাসপাতালের কাছাকাছি হতে হবে যার লাইব্ররীতে প্রমার বাবা পড়তে যেতে পারবে পায়ে হেঁটে এবং সহজেই। দুপুরে ইচ্ছা করলে খেতে বাসায় আসতে পারবে। অন্যটি হলো দুই বেডরুম থাকতে হবে। আমাদের বাসা খোঁজা, পাওয়া, গাড়ী কেনায় তারিক ভাইয়ের সহায়তা অপরিহার্য় ছিল আর তাছাড়াও জুবায়ের ভাই, সায়েক ভাই, বাপ্পী ভাই ,মোমিন, আসিফ আর ফারহান সব সময় সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিতো। পার্নেল অকল্যানডের ‌অন্যতম দামী সাবার্ব বা শহরতলী হলেও মালিকের আমাদের জীবনের গল্প এবং আমরা দু’জন সংগ্রামরত ডাক্তার হওয়াতে ফ্ল্যাটটি আমাদের দিতে একটুকুও কুন্ঠাবোধ করলেন না। উপরন্তু পরে টের পেলাম খুবই কম ভাড়ায় এবং সামান্য নিরাপত্তা চুক্তি স্বরুপ টাকাতে উনি আমাদের বাসাটা দিয়েছেন।

উনার বয়স হয়তো পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে হবে। উনি দু’ সপ্তাহ পর পর ভাড়া নিতে নিজে আসতেন এবং তখন কিছু খাবার দিলে নিতান্ত মজা করে খেতেন। পরের দিকে অবশ্য রাতের খাবারের সময় আসতেন, রাজনীতি, খেলা পড়াশুনা আত্মীয় স্বজন এসব নিয়ে অনেক অনেক গল্প হতো এবং রাতের খাবার দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করতাম। আমার মনে আছে আমার ডাল রান্না উনার সবথেকে পছন্দ ছিল আর ডেভিড বোয়ি উনার প্রিয় মিউজিশিয়ান ছিল। বন্ধুত্বের কারণেই হোক বা নিজ উদারতা থেকেই হোক উনি দুই বৎসরের উপরের সময় কখনো বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর কথা একবারও বলেননি। আমরা আগাগোড়াই মাত্র দুইশ বিশ ডলার প্রতি সপ্তাহে দিয়ে থেকেছি এবং পুরো নিরাপত্তা চুক্তির টাকা উনি বাড়ি ছাড়বার সময় ফেরত দিয়েছেন। প্রমার বাবার চাকুরী হওয়াতে উনি সাংঘাতিক রকম খুশী হয়েছিলেন।

আমাদের বাসা নেয়া হলো, প্রয়োজনীয় সাংসারিক জিনিষপত্র কেনা হলো, পুরনো একটা গাড়ীও কেনা হলো- মনে আছে হোল্ডা সিভিক সাদা রঙ্গের। ঢাকা থেকে ড্রাইভিং একটু শিখে আসাতে লাভ হয়েছিল আর তাছাড়া সাহস বেশী থাকাতে অভ্যাস সামান্য ঝালাই করে নিয়েই লার্নার লাইসেন্স নিয়েই আমি ড্রাইভিং শুরু করে দিলাম অকল্যানডে। আমাদের বাসায় আমার বড়ভাইয়ের বন্ধুরা সবাই আর আমার বন্ধুরা প্রায়ই আসতো আর আমাদের নির্ভেজাল আনন্দে গল্প করে সময় কাটতো। আমি পরীক্ষামূলক বিভিন্নরকম রান্না করতাম, মিষ্টি বানাতাম মুড়ি ভাজতাম- ওরা সবাই খেয়ে প্রশংসা করতো আর আমার উৎসাহ আরও বাড়তো। প্রমার বাবা পড়াশুনা করার জন্যে সারাদিন লাইব্রেরি থাকা শুরু করলো আর তার পরেও গ্রুপ করে পড়াশুনা বিভিন্ন বাসায় ঘুরে ঘুরে যার মধ্যে আমাদের টার্ন ও আসতো। যারা আসতো দীনা আপা আর সিনিয়র জুবায়ের ভাই, বুলা ভাবী তাদের মধ্যে অন্যতম।

আমি নিয়ম মাফিক প্রায় সপ্তাহেই ঝিমা খালার বাড়ী যেতাম, যদিও উনারা মাউনট এলবার্ট থাকতেন,আমাদের থেকে বেশ দূরে। প্রমা খালার ছেলে সানিমের সাথে খেলতে পছন্দ করতো আর আমি পছনদ করতাম খালার সঙ্গ। খালা খালুও আসতেন আমাদের বাসায় মাঝে মধ্যে। আমি তখন বেশ সাংসারিক, নিউজিল্যান্ড সরকার আমাদের একটা ভাতা দিতো তা দিয়ে প্রমার ন্যাপীসহ প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র আগে কিনতাম আর বাকীটাকা দিয়ে বেশ সুন্দর সংসার সামলাতাম। আমার মনে আছে যেদিন আমরা টাকাটা হাতে পেতাম সেদিন ভালোমন্দ খেতে যেতাম। কেন যেন তখন কে এফ সি আমাদের ভীষণ প্রিয় খাবার ছিল। আমার নিত্য কর্ম ছিল প্রমাকে সাথে নিয়ে বাজার করা, লন্ড্রি রুমে গিয়ে কাপড় ধুয়ে ড্রাই করা, রান্না করা, প্রমাকে খাওয়ানো, টয়লেট, গোসল করানো, ঘুম পাড়িয়ে ঘর পরিষ্কার! অতঃপর নিজের যত্ন নেবার সময় হতো খুব কম।

জাপানী এক প্রবাদ আমি বিশ্বাস করি, তা অনুসারে আমরা সকলেই মুখোশ পরে থাকি তিনটি স্তরে। বাইরের মুখেশটা সুখ বা দুঃখের যা আমরা সবাইকে দেখাতে চাই, দ্বিতীয় মুখোশ খুব কাছের লোকজন জানতে পারে বা দেখতে পারে আর তৃতীয়টি একান্তই নিজের। কিছু গোপনীয় জিনিষ বা কথা সব মানুষেরই অন্তরে লুকায়িত থাকে যা সে কোনেদিনই কারো সাথে হিস্যা নিতে পারে না। আমি এসব তখন না জানলেও নিশ্চিত সুখী এক মুখোশ তখন পরা শুরু করেছিলাম। আসলে প্রমাকে খাওয়াতে বসে বা রান্না চড়িয়ে আমি গ্রেইস এনাটমি বা মুরতাগের মেডিসিন বই নাড়াচাড়া করতাম আর গভীর বিষন্নতায় ভুগতাম। যদি কখনো এ বিষয়ে প্রমার বাবার সাথে আলাপ তুলতাম তবে তা তর্কযুদ্ধে পরিণত হতো। কারণ স্বাভাবিকভাবেই পড়াশুনার ব্যপারে প্রমার বাবার প্রাধান্য পাবার কথা- সে ছেলেমানুষ, বয়সে আমার থেকে অনেক বড় আর সর্বোপরি আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও এতো ভালো নয় যে দুজনের পরীক্ষার বিশাল অংকের টাকা আমরা বহন করতে পারব। সুতরাং আমি তখন নিজের পরীক্ষা বা পেশার কথা চিন্তা করা বা তুলা কতটা অযৌক্তিক ছিল তা খুব সহজেই বোধগম্য!! আমি গভীর বিষন্ন আর একাকী দিন যাপন করতে থাকলাম আর তাই আমার হাসি খুশী মুখোশটা ব্যবহারও বেশ জরুরী হয়ে পড়লো।

চলবে…

About

Shahnaz Parveen

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}