October 24, 2021

প্রবাস জীবন (পর্ব-৫)

প্রবাস জীবনে সংসার আর পেশার দ্বন্দ্ব

হাসি আনন্দের পরিচায়ক এবং সাংঘাতিক সংক্রামক, মোটামুটি সকলেই হাসতে পছন্দ করে। হাসি নিমিষে কষ্ট বিলীন করতে পারে,হোক তা সাময়িক আর আমার হাসি যদি অন্য কারো মুখে মুহূর্তের হাসি আনন্দ এঁকে দিতে পারে তবে সেই হাসি ধন্য। কার জীবনে কষ্ট নেই তবে কষ্টগুলো একান্তই নিজস্ব এবং কোনো কোনো কষ্টকে মস্তিষ্কের এমন কুঠোরে রেখে দিতে হয় যাতে নিজেই তার খোঁজ সহসা না পাওয়া যায়। কষ্টে বুক ফেটে কান্না আসবেই এবং কান্নাটাও স্বাভাবিক মানুষ মাত্রেই। কেউ না কাঁদতে পারলেই বুঝতে হবে তার মানবিক কোনো সমস্যা আছে। কিন্তু কষ্ট দেখানোর বিষয় নয়, যারা বুঝবার তারা মুখের শব্দে বা চোখের চাহনিতে ঠিকই বুঝে নিবে। আর জীবনে বাবা মা ছাড়াও এমন আর একজন মানুষ থাকাই যথেষট, যাকে কিছুই খুলে বলতে হবে না। আবার যাকে খুলে বলতে হবে- কি কখন কিভাবে কোথা থেকে এবং কেমন করে সে কোনোদিনই কষ্টের পরিমাপ বুঝতে পারবে না, পাশে থাকা দূরের কথা। আমাদের দেশের মেয়েগুলি সাধারণত এক্ষেত্রে বড্ড অসহায় কারণ মেয়েরা জন্মগতভাবেই সংবেদনশীল তাই তারা অন্যের মানবিক চাহিদা নিজ থেকে যেঁচেই পূরণ করে। অন্যদিকে বেশীরভাগ ছেলেদের ছোট থেকেই তৈরী করা হয় শক্ত, আত্মনির্ভর অনেকটা স্বার্থচিন্তক হিসেবে। কারো কান্না দেখলে তাদের দূর্বল মনে হয় আর বেদনার ভাষা না জানলে কিভাবে করবে সমবেদনা পোষণ। আমি তাই বিদেশ বিভুঁই এ ক্রমশ কারণে বা অকারণে হাসতে শিখে গেলাম যা আমার বুকে কষ্টের পরিধি নিয়ত বাড়িয়েই চললো।

আমি সংসার করছি মন বেঁধে আর প্রচন্ড সফলতার সাথে তাই প্রমার বাবা দুই পার্ট ইউ এস এম এল ই পাশ করলো। তারপর শুরু হলো ক্লিনিকাল পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি। তার ফলে কিছু নতুন মানুষের সাথে যোগাযোগও তৈরী হলো-অবশ্য মূলত প্রমার বাবারই। আমি ঘরের বৌ ই থেকে গেলাম। তবে সুযোগ পেলে প্রমার মুখে এক লোকমা ভাত দিয়ে বা কখনো কখনো রান্না পুড়িয়ে হলেও বইয়ে ডুবে থাকতে পছন্দ করতাম। প্রমার বাবার বন্ধু কে ৩৬ নিপু ভাই আর হ্যাপী ভাবীর সাথে আমাদের সখ্যতা হলো। হ্যাপী ভাবী নামের মর্যাদা রেখে আমার সাথে দুর্দান্ত হাসতে পারতেন। খুব মজার মজার রান্না করতেন তবে পোলাও এর মাঝে কেনো যেনো উনি বুট মিশিয়ে দিতেন তা ছিল আমার বোধ আর আকাঙ্খার বাইরে। মাঝে মাঝে সপ্তাহানতে আমরা বেড়াতে যেতাম দূরে কোনো সমুদ্রতীরে নিপু ভাই ভাবীদের সাথে। উনাদের এক ছেলে ছিল অনিক, খুব কথা বলতে পছন্দ করতো। আমরা বেড়াতে যাবার সময় পাশে বসলে করতো হাজারো প্রশ্ন। একবার বেড়াতে যাবার সময় প্রমা আমি ঠিক বুঝে উঠবার আগেই গাড়িতে বমি করে ফেললো। প্রমার কোনো দিনই মোশন সিকন্যাস ছিল না। ওই প্রথম সে গাড়িতে বমি করলো, আর দশ বৎসরের দুষ্টু অনিক তিন সাড়ে তিন বৎসরের প্রমাকে পুরোটা পথ এ বিষয়ে মজা করেই ত্যক্ত করলো। অনিকের মা হ্যাপী ভাবী যখন গর্ভবতী হলেন , আমাকে বড্ড জ্বালিয়েছেন। হঠাৎ করে বাসায় এসে বলতেন ভাবী আমি কিছু গন্ধ সহ্য করতে পারছি না। আপনি আমার জন্য একটু রান্না করেন তো- পেঁয়াজ রসুন হলুদ মরিচ ধনে জিরার গুঁড়া কিছু দিবেন না।আমি বললাম তো কি দিয়ে রাঁধব? উনি নির্ধিধায় বললেন “শুধু কাঁচা মরিচ”- হায়রে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো আর অযাচিতভাবে মানুষকে আপন করে নেবার আমাদের অভ্যেস।

কে ৩৬ এর প্রমার বাবার আর এক বন্ধু মোদাসসির ভাইদের বাসায়ও আমাদের যাতায়াত আর তাদের সাথে আন্তরিকতা ছিল প্রথম থেকেই। ভাই ভাবী ফর্সা আর তাই তাদের টুকটুকে ফর্সা আর সুন্দর এক ছেলে এক মেয়ে ছিল। আমরা অকল্যানডে মাত্রই বাসা নিয়েছি, বিদেশী পরিবেশে একেবারেই নতুন। আমাদের ছোট্ট টেলিভিশন চলছে, আমি রাত ন’টার দিকে প্রমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে বসার রুমে আসতেই প্রমার বাবার উৎকন্ঠিত স্বর শুনতে পেলাম। পৃথিবী তো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে! আমি টিভির দিকে তাকিয়ে আমারও উৎকন্ঠা লুকোতে পারলাম না। আমি একবার টিভিতে খবর শুনছি,এসটেরয়েড এসে পৃথিবী ধ্বংস করছে, লোকজন সব আতঙ্কিত হয়ে রাস্তায় ছুটাছুটি করছে। আবার জানালা দিয়ে বাইরের পরিবেশ বুঝবার চেষ্টা করছি-শুনশান নিরবতা যেমনটি সবসময়। ওদিকে প্রমার বাবা মা বাবা ভাই বোনদের সাথে কথা শেষ করে মোদাসসির ভাইকে ফোন দিয়েছ। জানিস পৃথিবী যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে? “ কি বলিস?জানি না তো! “ সহজ সরল মোদাসসির ভাই তখন বউ বাচ্চাদের নিয়ে কোনো প্রশ্ন না করেই একেবারে গ্যারেজে অবস্থান নিলেন। অতঃপর প্রমার বাবা নিপু ভাইকে ফোন দিলো ভাগ্যিস। নিপু ভাই তড়িৎ টিভি দেখে বললেন “ তোরা কি পাগল হয়েছিস? এটাতো মুভি!” এখন পর্যন্ত বাচ্চারা সব একত্রিত হলে আমাদের নিয়ে বিশেষ করে মোদাসসির ভাইকে নিয়ে হাসাহাসি করে।

আমার বাবা মায়ের সাথে প্রায় প্রতিদিনই কথা হতো প্রতিবার বড়জোর মিনিট দুই তিন। উনারা আমাদের বিশেষ করে প্রমার খোঁজ নেন তারপর আমার পড়ালিখার! আমি তেমন সহজ করে জবাব দিতে পারি না। তখন ওভারসিজ ফোনের বিল ছিল কড়া আর মিনিট হিসেবে, কথা বিস্তারিত হতো না। বড়ভাই কাওসার আয়ারল্যান্ডের কর্ক শহরে কাজে নিয়োজিত, কথা হতো মাঝেমধ্যে। নিউজিল্যান্ডের ভিসা রক্ষার্থে ও আবার আসবার প্ল্যান করছে অকল্যানড। আমি একদিন সাহস করে বলেই ফেললাম “তুই কি আমাকে কিছু টাকা ধার দিতে পারবি?” ও বললো পারব, কত এবং কিসের জন্য? আমি খুলে বলতেই ভাইয়া সেদিনই এগারো শত ইউ এস ডলার পাঠিয়েছিল – আমি তার জন্য কৃতজ্ঞ। আমি দুঃসাহসিক কাজটা করেই ফেললাম। তাড়াতাড়ি ইউ এস এম এল এ পার্ট ওয়ান এর ফর্ম ফিলাপ করলাম নইলে পরের মাসে পরীক্ষা দিতে পারতাম না। প্রমার বাবা সেদিন ঘরে ফিরলে সব বলতেই সে বললো” তুমি টাকা পেলে কোথথেকে?” তার গলার স্বরে সেদিন আমি হয়তো নিরাশার স্বাদ পেয়েছিলাম, বা হতে পারে সেটা আমার নিছক কল্পনা।

চলবে…

About

Shahnaz Parveen

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}