রাবেয়া বেগম এই নিয়ে তিনবার ডাকলেন, ওই লিমা, লিমারে এদিকে আয়, লিমা। তিনি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ডাকছেন। কিন্তু লিমার কোন সাড়াশব্দ নাই। লিমা নিশ্চয়ই কোন কাজে ব্যস্ত। লিমা হচ্ছে এই বাসার গৃহকর্মী।

রাবেয়া বেগমের বয়স সত্তরের কাছাকাছি হবে। বয়স হলেও তিনি সব ভালই বুঝেন। কিন্তু শরীর দূর্বল হওয়াতে বেশি হাঁটাহাঁটি করতে পারেন না।

লিমা এখন এসে বললো, কি হইছে এতো ডাক পাড়তাছেব কে?

  • তোর মামী কি রান্না করে? কি সুন্দর ঘ্রান বের হইছে।
  • আপনার নাক তো দাদী, ম্যালা বালা! মামী সর্ষে ইলিশ রান্না করতাছে।
  • ওই, ইরা আসছে ইস্কুল থেকে?
  • ইরা আফায় এহন ফাইভে পড়ে হের কুচিং আছে, এহন আইবে ক্যা!
  • ওহ। আয়ান ভাই কি করে।
  • হ্যা খেলতাছে। হের পিছন কি আমি থাকি! এহন যাই।
  • তুই দেখা যায়, বিরাট ব্যস্ত।
  • আপনের আযাইরা কতা হুনুবের টাইম নাই। খালি হুদা প্যাচাল।

লিমা হন হন করে সামনে থেকে চলে গেল। রাবেয়া বেগম বিছানায় পাশ ফিরে শুইলেন। কিন্তু এখন এমন এক অবস্থা সারাদিন বিছানায় থাকলেও ঘুম আসেনা।

রাতের বেলা খাবার টেবিলে বসে ছেলের বউ সাদিয়াকে বললেন বউ সর্ষে ইলিশ দুপুরে কোথায় ছিল?

  • আম্মা, ছয় পিস রান্না করেছি। ভাবলাম রাতেই খাবো। এজন্য দুপুরে তুলে রেখেছিলাম।
  • ওহ। সর্ষে ইলিশে সাদা সরিষা দিয়েছো? নাকি কালো টা?
  • শুধু সাদা টা দিয়েছি।
    জুবের বললো আম্মা, মজা হয়েছে নাকি?
  • বউয়ের রাব্দার হাত ভালো। মজা হয়েছে।
  • তাহলে আর খাও, কি দিয়ে রান্না করেছে, জেনে আর কি করবে!
  • জুবের একটু আগে দেখলাম কার সাথে কথা বলছিস? কার সাথে?
  • আমার ক্লাইন্ট এর সাথে।
  • হ্যা কি কয়?
  • আম্মা, কেন যে এসব প্রশ্ন কর? তুমি কি বুঝবে কি জানতে চেয়েছে ক্লাইন্ট?
  • না, এমনেই বললাম। রাগ করিস না।

সাদিয়া রাতের বেলা জুবের কে বললো, এই আম্মা এতো কথা বলেন সারাদিন। কারণ ছাড়াই প্রশ্ন করেন।

  • হুম।
  • আজ সকালে বলছেন, পাশের বাসার মমতা আমাকে কি দিয়ে গিয়েছে? বললাম মমতার দেওরের ছেলে হয়েছে এজন্য দিয়েছে ! এখন প্রশ্ন কেমনে হইলো? সিজার নাকি নরমাল? বাচ্চার ওজন কতটুকু হয়েছে? আচ্ছা আমি কি সব জানি বলো?
    -শুধু প্রশ্ন করা আম্মার এখন একটা অসুখ। আম্মাকে বলতে হবে, এজন্য আম্মার সামনে ফোন ধরতেই ভয় লাগে। হাজার প্রশ্নের ভেড়াজালে পড়তে হবে।

জুবেরের বুকের উপর বসে আছে তার ছেলে আয়ান, আয়ানের বয়স চার। সে বাবাকে বললো বাবা, তোনার ফোন আমাকে দিয়ে দাও।

  • তুমি কি করবে ফোন দিয়ে।
  • খেলবো।
  • আমার ফোনে অনেক কাজ আছে বাবা।
  • কি কাজ বাবা?
  • জরুরি কল আসবে।
  • কে দিবে?
  • ক্লাইন্ট দিবে বাবা।
  • ক্লাইন্ট কি?
  • কাস্টমার।
  • বাবা, তুমি মায়ের ফোন নিয়ে যাও, অফিসে।
  • এটা নিলে হবেনা, আমার নাম্বারেই কল দিবে।
  • তোমার নাম্বার কি?
  • আমার নাম্বার হচ্ছে, আমার সিমের নাম্বার!
  • সিম কি?

এভাবে আধা ঘন্টা ধরে, ছেলে জুবের কে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে, অথচ জুবের বেশ মজা করেই ছেলের উত্তর দিচ্ছে একবার ও বিরক্ত হচ্ছেনা। কারণ ছেলের এই বয়েসের উদ্ভট প্রশ্ন তার বেশ মজা লাগছে। বেশ মজা নিয়ে বলছে দেখেছো সাদিয়া, আমার আয়ান কেমন বুদ্ধিদীপ্ত! কত জানার আগ্রহ!

  • হ্যা। মাশাল্লাহ বলো। নজর লাগবে তো।
  • মাশাল্লাহ।
    মেয়ে ইরা হঠাৎ বললো আম্মু আমিও কি এভাবে প্রশ্ন করতাম?
  • হ্যা, তুই ও অনেক প্রশ্ন করতি এই বয়েসে।
  • বাবাও কি এভাবে প্রশ্ন করতে দাদুকে?
  • জানিনা, করতাম হয়তো!
  • দাদু ও আমাদের এতো এতো প্রশ্ন করে। আমরা দাদুর মতো প্রশ্ন করতে শিখেছি তাই না বাবা?
  • হুম, হ্যা হ্যা।

মেয়ের প্রশ্নের পর, জুবের চিন্তা করছে, আয়ান কত কত প্রশ্ন করে একবার ও খারাপ লাগেনা। সে নিশ্চয়ই তার মাকে এভাবেই প্রশ্ন করতো। তিনিও হয়তো এভাবেই হাসিমুখে উত্তর দিতেন। অথচ দিন শেষে মায়ের তিন চারটে প্রশ্নের উত্তর দিতেই কত বিরক্ত লাগে!
জুবের চিন্তা করছে ইশ মায়ের উপর বিরক্ত হওয়াটা তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন। কত কষ্টই হয়তো পেয়েছেন। আমরা নিজের সন্তানের প্রশ্ন আনন্দ নিয়ে দেই অথচ বৃদ্ধ পিতা-মাতার অতিরিক্ত দু/একটি প্রশ্নে বিরক্তি চলে আসে।

জুবেরের নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী লাগছে, নাহ! আর মায়ের প্রশ্নে কখনো বিরক্তি প্রকাশ করবেনা, চেষ্টা করবে মায়ের সব প্রশ্নের উত্তর ঠিক ঠাক উত্তর দিতে, কারণ তিনি তো তার সন্তানের হাজার প্রশ্নের উওর দিতে গিয়ে বিরক্ত হোন নি!

জুবের রাতের বেলা আস্তে আস্তে মায়ের রুমে গিয়ে দেখলো তিনি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন, সে আস্তে করে মাথায় চুমু দিয়ে এলো। মনে মনে বললো মাফ করে দিও মা, কত বার তোমার উপর বিরক্ত হয়েছি। কোন সন্তানই যেন তার বৃদ্ধ মা-বাবার কথায়, আচরণে বিরক্ত না হয়,কারণ তারা তো কখনো তাদের সন্তানের উপর বিরক্ত হোন নি। জুবের মনে মনে বলছে, সব সন্তানই পিতা-মাতাকে নিজের সন্তানের মতোই ভালবাসুক, মাথায় তাজ করে রাখুক৷ এই প্রার্থনা…

সমাপ্ত!

আন্নামা চৌধুরী।
২৫/১০/২০২১

About

Annama Chowdhury

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}